১৪ জুলাই ২০২৪, রবিবার, ৬:৩৪

কেন ডুবছে ঢাকা

একটা সময় রাজধানীর জলাবদ্ধতার জন্য ওয়াসাকে দায়ী করতো সিটি করপোরেশন। ওয়াসার অবহেলার জন্য ঢাকায় জলবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে বলে দাবি করতেন ঢাকার দুই মেয়র। এমন প্রেক্ষাপটে ২০২১ সাল থেকে সরকার ঢাকার খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয় দুই সিটি করপোরেশনকে। এরপর সময় গড়িয়েছে ৪ বছর। কিন্তু বদলায়নি ঢাকার চিত্র। সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় রাজধানী জুড়ে। কোমর পানিতে থই থই। চলে না যানবাহন। নৌকা নিয়ে চলতে হয় কোথাও কোথাও। সব মিলিয়ে নগরবাসীর কষ্টের সীমা থাকে না।

অথৈ পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। সামান্য বৃষ্টিতে কেন ডুবছে ঢাকা, কবে মিলবে এর থেকে প্রতিকার-প্রশ্ন নগরবাসীর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে বছরের পর বছর জলাবদ্ধতায় ভুগতে হচ্ছে নগরবাসীকে। সমস্যা সমাধানে দুই সিটির সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। তারা যা করছে তাতে কেবল সাময়িক সমাধান মিলতে পারে। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে রাজধানীর ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ বর্জ্য সিটি করপোরেশন সংগ্রহই করতে পারে না। যেগুলো পরবর্তীতে ড্রেন ও খালে গিয়ে পড়ে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে মহাপরিকল্পনাকে গুরুত্ব না শুধু টাকা খরচ করলে সমাধান মিলবে না। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন বলছে, রাজধানীতে জলাবদ্ধতার মূলে নগরবাসীর সচেতনতার অভাব। যত্রতত্র ময়লা ফেলে, পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার নগরে জলাবদ্ধতার মূল কারণ। তাই নগরবাসীর সচেতনতাই পারে ঢাকাকে এমন পরিস্থিতি থেকে নিরাপদ রাখতে। এসব ময়লা ও প্লাস্টিক ড্রেন ও খালে গিয়ে ব্লক তৈরি করে। যার কারণে পানি নামতে পারে না। আর যখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখন জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এ ছাড়াও সর্বোচ্চ ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে তা দ্রুত নিষ্কাশন করার সক্ষমতা রয়েছে সিটি করপোরেশনের। এর থেকে বেশি হলে হিমশিম খেতে হয় তাদের। পশ্চিত তেজতুরী বাজার গার্ডেন রোডের মো. রাখু নামের এক বাসিন্দা বলেন, বৃষ্টির পানি নেমে যাওয়ার পর আমাদের এলাকায় দেখা গেছে তোশক, বালিশসহ বিভিন্ন গৃহস্থালী জিনিসপত্র ড্রেনের সামনে জমে আছে। মূলত এসব কারণেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। সিটি করপোরেশন যেমন তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করে না আমরা জনগণও নিজেদের দায়িত্বের প্রতি যত্নশীল নই। হলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। গত শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় ৬ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ১৩০ মিলিমিটার। আর সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় রাজধানীতে ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি শুধু রাজধানীতে নয়, দেশের সব জায়গায়ই হয়েছে। আর এতেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। বৃষ্টিতে রাজধানীর নিউমার্কেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ধানমণ্ডি, গ্রিন রোড, পুরান ঢাকা, মতিঝিল, আরামবাগ, নটরডেম কলেজ, কাজীপাড়া, মিরপুর মাজার রোড, রোকেয়া সরণি, দক্ষিণখান, কল্যাণপুর, বিজয় সরণি, ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, নিমতলী, এলিফ্যান্ট রোড, কাওরান বাজার, মালিবাগ, মৌচাকসহ বেশির ভাগ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। অনেক এলাকায় সড়ক ছাড়াও পানি জমেছে বসতবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। ডিএমপি’র বার্তায়ও ২২টি এলাকায় জলাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ১২ ঘণ্টা পরও পানি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মতিঝিল, কমলাপুর, গ্রিন রোড, নিউমার্কেট এরিয়াতে। এমনকি গতকালও এসব এলাকার বিভিন্ন জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল ঢাকার আবহাওয়া অধিদপ্তর আগামী শুক্রবার থেকে রাজধানীতে ফের ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে। অধিদপ্তরের এক ব্রিফিংয়ে আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ১৮ই জুলাই পর্যন্ত বৃষ্টিপাত কমে যাবে। পরদিন ১৯ই জুলাই থেকে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা আস্তে আস্তে বাড়তে পারে। মাস জুড়েই এ বৃষ্টি থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে আবারো ঢাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে সহসাই নগরবাসীর জন্য সুখবর নেই। এদিকে ঢাকায় জলাবদ্ধতার জন্য সিটি করপোরেশন দায়ী করেছে নগরবাসীর যত্রতত্র ময়লা, পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্য ফেলা। জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেল) মো. খায়রুল বাকের মানবজমিনকে বলেন, জলাবদ্ধতার মূল কারণ ড্রেনেজ সিস্টেম ময়লা জমে ব্লক সৃষ্টি হওয়া। ড্রেনের লাইন খুললেই ময়লা ভর্তি দেখা যায়। প্রচুর পরিমাণ প্লাস্টিক এবং পলিথিন পাই। কোনো কোনো ড্রেনেজ থেকে ১ থেকে ২ ট্রাক পর্যন্ত প্লাস্টিক এবং পলিথিন পাওয়া যায়। এ ছাড়াও লেপ, তোশক, ডাবের খোসা, বোতলসহ নানা আসবাবপত্র পাওয়া গেছে। এসবের কারণেই মূলত ড্রেনেজ সিস্টেম অকেজো হয়ে গেছে। পানি সরতে সময় লাগছে। এগুলো নগরবাসীর সমস্যা। তাদের পরিবর্তন হতে হবে। সবাই সচেতন হলে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন বৃষ্টির পরপরই পানি নিষ্কাশনে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে। আগে শান্তিনগর, মতিঝিলে এমন বৃষ্টির পর নৌকা চলতো। বর্ষা হলেই দুই থেকে ৫ দিন পানি জমে থাকতো। এখন দুই ঘণ্টায় পানি নেমে যায়। এগুলোও সম্ভব হয়েছে নগরবাসীর জন্য। নিউমার্কেট, বুয়েটসহ আশপাশের এলাকার সমস্যা থেকে উত্তরণে শিক্ষা বোর্ড থেকে শুরু করে সোয়ারীঘাট পর্যন্ত ড্রেনেজ লাইন করবো। এর আশেপাশের এলাকা থেকে এই লাইনে সংযোগ দেয়ার চেষ্টা করবো। টেন্ডার হয়েছে দ্রুত বাস্তবায়ন হবে। তিনি বলেন, ২০২১ সাল থেকে যখন ড্রেনেজ ও খাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আমাদের হাতে তখন আমরা দুই সিটি করপোরেশন ১৬১টি জলাবদ্ধতা প্রবণ এলাকা চিহ্নিত করি। এরপর পর্যায়ক্রমে আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করি এবং ১০৯টি এলাকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান করতে না পারার জন্য সিটি করপোরেশনের এ কর্মকর্তা লোকবল সংকটকে দায়ী করেছেন। এদিকে এতদিন জলাবদ্ধতার জন্য ওয়াসাকে দায়ী করলেও এখন নিজেদের হাতে দায়িত্ব আসার পরও এ সমস্যার সমাধান করতে না পারায় নগরবাসী সিটি করপোরেশনকে দুষছেন। ২০১৭ সালের ২৫শে এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক অনুষ্ঠানে দক্ষিণ সিটির তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন রাজধানীতে বৃষ্টিতে জলবদ্ধতার জন্য ঢাকা ওয়াসাকে দায়ী করেন। তখন তিনি দাবি করেন, সংস্থাটিকে হয়তো সিটি করপোরেশনের সঙ্গে একীভূত করতে হবে, না হলে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে হবে। তিনি বলেন, ওয়াসা কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারছে না। এজন্য নগরীর মানুষের চরম দুর্ভোগ হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ওয়াসাকে সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হোক অথবা ঢেলে সাজানো হোক। এরপর সরকার ২০২০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব দেয় দুই সিটি করপোরেশনকে। কিন্তু আদতে পরিস্থিতি বদলায়নি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন গত ৪ বছরে ঢাকার খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা খরচ করেছে। গেল অর্থবছরেও প্রায় ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় জলাবদ্ধতা নিরসনে। কিন্তু শুক্রবারের বৃষ্টিতে দেখা যায় পরিস্থিতির খুব একটা উন্নয়ন ঘটেনি।

https://mzamin.com/news.php?news=118565