১৪ মে ২০২৪, মঙ্গলবার, ১২:০৭

গবেষণার জাহাজ আসা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি

গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণ প্রকল্প

গভীর সমুদ্রের কোন অংশে কী পরিমাণ টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ রয়েছে, তা নিয়ে গবেষণার জন্য প্রায় সোয়া ২১ কোটি টাকায় দু’টি জাহাজ কেনার টেন্ডার হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জাহাজ আসা নিয়ে ফের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ‘গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণে পাইলট প্রকল্প’ শীর্ষক প্রকল্পের মূল ফোকাস গবেষণার এই জাহাজ কেনা। উদ্দেশ্য, গভীর সমুদ্র ও আন্তর্জাতিক জলসীমায় টুনা ও সমজাতীয় মাছের প্রাপ্যতা যাচাই ও আহরণে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান মৎস্য অধিদফতর ২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রায় ৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি হাতে নেয়। প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল গত বছরের (২০২৩) ডিসেম্বরে। কিন্তু শুরুতেই হোঁচট খাওয়ায় প্রকল্প মেয়াদ দেড় বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়।

আগামী বছরের জুনে শেষ হবে প্রকল্পটি। কিন্তু এখনো অনিশ্চয়তা কাটেনি মূল লক্ষ্য বাস্তবায়ন নিয়ে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গভীর সমুদ্র ও আন্তর্জাতিক জলসীমায় টুনা ও সমজাতীয় মাছের প্রাপ্যতা যাচাই ও আহরণে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণে তিনটি গবেষণার জাহাজ কেনার কথা ছিল; কিন্তু ডলার সঙ্কটের কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে একটি বাদ দিয়ে দু’টি জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রকল্পের প্রায় চার বছর অতিবাহিত হতে চললেও গবেষণার জাহাজ এখনো সমুদ্রে ভাসেনি। মাঝখানে দুইবার তথা ২০২২ ও ২০২৩ সালের অক্টোবরের মধ্যে এই জাহাজ আসার কথা বলেছিলেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসেনি। অক্টোবর মাস টুনা আহরণের সময়। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন আসছে অক্টোবরের আগেই গবেষণার দু’টি জাহাজ বঙ্গোপসাগরে ভাসবে। প্রায় সোয়া ২১ কোটি টাকায় দু’টি জাহাজ কিনতে টেন্ডার হয়েছে অনেক আগে। প্রকল্প মেয়াদের মধ্যে আগামী অক্টোবরই শুধু একটি মৌসুম টুনা আহরণের। এই সময়ের মধ্যে জাহাজ আনা সম্ভব না হলে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাহাজ দু’টি সরবরাহ করছে সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠান।

চীনের আরেকটি প্রতিষ্ঠান জাহাজ তৈরি করছে। এখনো জাহাজ দু’টি সরবরাহের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। গত ফেব্রুয়ারিতে জাহাজ দেখতে চীন সফর করে আসেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। আগামী জুন মাসে ফের সফরে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক মো: জুবায়দুল আলম। তিনি জানান, আমরা একবার পরিদর্শন করে এসেছি। জুন মাসে আবারো যাবো। যদি দেখি শিপমেন্ট (জাহাজ) করার মতো অবস্থায় রয়েছে, তাহলে বলব যে, এখন শিপমেন্ট করতে। তিনি বলেন, অক্টোবর থেকে টুনা আহরণ মৌসুম শুরু হয়। যদি জুন মাসের শেষের দিকেও জাহাজ নিয়ে আসতে পারি, তাহলেও কোনো সমস্যা হবে না। দেখা যাক।

মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানায়, গবেষণায় সহযোগিতা করার জন্য জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং জাপানের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল; কিন্তু তারা রাজি হয়নি।

মৎস্য অধিদফতরের যে জাহাজ আছে, সেটি দিয়েও গবেষণা করা সম্ভব নয়। গভীর সমুদ্রে গবেষণার জন্য দেশে এ ধরনের কোনো জাহাজ নেই। তাই বাধ্য হয়ে সিঙ্গাপুরের কোম্পানি থেকে চীনের তৈরি দু’টি জাহাজ কিনতে হচ্ছে। জাহাজ দু’টি হবে লং লাইনার ধরনের, যা দিয়ে গভীর সমুদ্রে (আন্তর্জাতিক জলসীমায়) মাছ ধরা যায়।

জানা যায়, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার ২০ শতাংশ উপকূলীয়, ৩৫ ভাগ অগভীর সাগর ও ৪৫ ভাগ গভীর সাগর। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশের জলসীমা। এর পর থেকে আন্তর্জাতিক জলসীমা শুরু, যাকে গভীর সাগর হিসেবেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে যে জাহাজগুলো রয়েছে তা আন্তর্জাতিক জলসীমায় গিয়ে মাছ ধরে না।

সঠিক সময়ে ফের জাহাজ আসা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে কি নাম জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো: জুবায়দুল আলম বলেন, সেটি তো বলা কঠিন। এই যে, বাসায় ফিরছি, এটা নিয়েও তো অনিশ্চয়তা থাকতে পারে!

তিনি বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা। যখন তারা দেখবে যে, বঙ্গোপসাগরে পর্যাপ্ত টুনা মাছ আছে, এটা ধরা যায়, লাভজনক, তখন বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হবে। ইতোমধ্যে ২৮টি কোম্পানি টুনা মাছ ধরার জন্য অনুমোদন নিয়ে রেখেছে। যখন লাভজনক দেখবে, তখন তারা বিনিয়োগ করবে।

গত ৩০ এপ্রিল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ও নির্দেশনাগুলোর ওপর সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার কার্যবিবরণী সূত্রে জানা যায়, দু’টি লং লাইন পদ্ধতির জলযান (ফিশিং বোট, ফিশিং গিয়ারসহ) ক্রয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। জলযান সরবরাহকারীর অনুকূলে ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে দু’টি জলযান সরবরাহ করা হবে মর্মে জলযান সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অবহিত করেছে।

এ দিকে, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তথ্য থেকে জানা যায়, ‘গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণে সক্ষমতা অর্জন, সংরক্ষণ ও বিপণন এবং বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ’ শীর্ষক প্রস্তাবিত প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ইনফ্র্যাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটাশন কোম্পানিকে (আইআইএফসি) প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তারা ৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা প্রাক্কলনসহ একটি প্রস্তাবও প্রেরণ করেছে। পরবর্তী সময়ে গত ১৪ জানুয়ারি আর্থিক প্রাক্কলন সংশোধনপূর্বক পুনরায় ১৬ কোটি ৭৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকার প্রাক্কলন প্রেরণ করে। এই আর্থিক প্রাক্কলন যাচাই কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, গভীর সমুদ্র ও আন্তর্জাতিক জলসীমায় অনাহরিত টুনা ও সমজাতীয় মৎস্য আহরণের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন; গভীর সমুদ্র থেকে টুনা ও সমজাতীয় মৎস্য আহরণে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল তৈরি এবং টুনা ও সমজাতীয় মৎস্য আহরণে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণের জোর দেয়া হয়েছ এ প্রকল্পে। দু’টি ফিশিং বোট/জাহাজ কেনার পাশাপাশি সাতজন আন্তর্জাতি ও ৩৭ জন দেশীয় পরামর্শক ও জনবল নিয়োগ, ১০০ জন টুনা আহরণকারীকে প্রশিক্ষণ, ২৬ জনের বৈদেশিক প্রশিক্ষণ/শিক্ষা সফরসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্কশপ করার কথা এই প্রকল্প মেয়াদে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/834836