১৪ মে ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:৫০

মধুখালীতে শ্রমিকরা প্রতিমায় আগুন দেয়নি

ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী গ্রামে মন্দিরে অগ্নিসংযোগ ও দুই শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা তদন্তে গঠিত জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে প্রতিমার শাড়িতে আগুন দেওয়ার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে শ্রমিকেরা আগুন দেননি বলে নিশ্চিত হয়েছে কমিটি। এ ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহ্ আসাদউজ্জামান, সদস্য অজিত বিশ্বাস ও অমৃত কুমার বসু নামের এক গ্রাম পুলিশ সদস্যের সম্পৃক্ত থাকার সত্যতা পেয়েছে কমিটি। শ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশ মারধর শুরু করলে শ্রমিকদের ওপর আক্রোশে ফেটে পড়েন গ্রামবাসী। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রটে (এডিএম) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য ‘সর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়া’র ভূমিকায় ছিলেন। তাদের নিখুঁত অভিনয় প্রথমে ধরা যায় নি। এ ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য ও গ্রাম পুলিশ দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তারা দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখলে ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল। তাদের উচিত ছিল, শ্রমিকদের থানায় নিয়ে যাওয়া।

গত ১৮ এপ্রিল রাতে মধুখালীর পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে মন্দিরে প্রতিমার গায়ের কাপড়ে আগুন দেওয়ার অভিযোগে দুই নির্মাণশ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে রটানো হয় যে মন্দিরে আগুন দেওয়ায় গণপিটুনিতে দুই সহোদর নিহত হয়েছেন। ঘটনার পর এডিএম মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার। কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। পরে দুই দফা সময় বাড়িয়ে গত বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্দিরে প্রতিমার শাড়িতে আগুন লাগার ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায় নি। আগুন নেভাতে গ্রামবাসীর সঙ্গে মন্দিরসংলগ্ন পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকেরাও বালতি হাতে অংশ নেন। এলাকাটি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত হওয়ায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় গ্রামবাসী নির্মাণশ্রমিকদের সন্দেহ করেন। ওই সন্দেহ থেকে গ্রামবাসী শ্রমিকদের বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে নিয়ে বেঁধে রাখেন। খবর পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য ও গ্রাম পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জনপ্রতিনিধিরা আগুন লাগানোর জন্য শ্রমিকদের দায়ী করে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করেন। তখন দু’জন জনপ্রতিনিধি ও এক গ্রাম পুলিশ সদস্য শ্রমিকদের কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড় মারেন। তাদের এই আচরণ উসকানি হিসেবে কাজ করে। এতে গ্রামবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ওই কক্ষে শ্রমিকেরা ছাড়া ইউপি চেয়ারম্যান, গ্রাম পুলিশ ও স্থানীয় তিন শিক্ষকসহ ৮-১০ জনের বেশি লোক ছিলেন না। গ্রামবাসী কক্ষের বাইরে থেকে ইট ছুড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ঘটনাটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ইউপি চেয়ারম্যান পুলিশকে খবর দেন।

ঘটনার পর জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সবার পাশে থেকে আহত শ্রমিকদের উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করেন ইউপি চেয়ারম্যান। পরে তদন্তকাজেও সাহায্য করেন। এ ঘটনার তিনটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে দুই জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশের কর্মকাণ্ড ফাঁস হয়ে যায়। এরপর ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য আত্মগোপন করলেও গ্রাম পুলিশ সদস্যকে হেফাজতে নেয় পুলিশ।

ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনা এড়াতে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। সুপারিশগুলোর মধ্যে আছে, প্রতিটি মন্দির ও বিদ্যালয় সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা; মসজিদ-মন্দিরসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা জোরদার করতে উঁচু প্রাচীর তৈরি করা; এমন ঘটনা মোকাবিলায় জনপ্রতিনিধি, গ্রাম পুলিশ ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; কোনো এলাকায় একই ধর্মের লোক বেশি বাস করলে সেখানে অন্য ধর্মের কেউ কাজ করতে গেলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জানিয়ে রাখা এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে প্রতিনিয়ত প্রচার-প্রচারণা চালানো।

মধুখালীর ঘটনায় হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা ও প্রতিমায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত পুলিশের ওপর হামলার মামলায় ৩১ জন ও হত্যা মামলায় ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের ওপর হামলার মামলায় চারজন ও হত্যা মামলায় সাতজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন।

এদিকে দুই নির্মাণশ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার ২৫ দিন পার হলেও এখনো অভিযুক্ত ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান ও সদস্য অজিত বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই দুই জনপ্রতিনিধি আগুন লাগানোর জন্য শ্রমিকদের দায়ী করে স্বীকারোক্তি আদায় করতে কিল-ঘুষি ও চড়থাপ্পড় মারেন।

শাহ আসাদুজ্জামান ডুমাইন ইউনিয়নের ডুমাইন গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ২০১২ সালে প্রথমবার ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য হন। ২০২২ সালের ইউপি নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী খোরশেদ আলমকে পরাজিত করে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে পুনরায় ইউপি চেয়ারম্যান হন। শ্রমিকদের পিটিয়ে হত্যার ঘটনার তিনটি ভিডিও ক্লিপ গত ২৩ এপ্রিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান।

মধুখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এবং হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শফিউল আলম গতকাল সোমবার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তারের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হয়েছে। তবে সফলতার মুখ আমরা দেখতে পারি নি। আমাদের বিশ্বাস, তিনি দেশেই আছেন। তার কোনো পাসপোর্ট নেই। তা ছাড়া তিনি আত্মগোপন অবস্থায় কোনো মুঠোফোন ব্যবহার করছেন না।’ তিনি জানান, আসাদুজ্জামানকে গ্রেপ্তারের জন্য দেশের সব থানায় বার্তা পাঠানো হয়েছে।

২০২৩ সালে দুই দফা ইউএনওর ওপর হামলার মামলা ও টিসিবির কার্ড আত্মসাতের ঘটনায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে বরখাস্ত হন ডুমাইন ইউপির চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান। তবে দু’বারই তিনি উচ্চ আদালতের মাধ্যমে পদ ফিরে পান। এসব ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছিল। এসব মামলার কোনোটিরই অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়নি পুলিশ।

১৮ এপ্রিল রাতে পঞ্চপল্লী মন্দিরের প্রতিমার শাড়িতে আগুন দেওয়া এবং সন্দেহের বশে পাশের পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওয়াশ ব্লক নির্মাণে নিয়োজিত চার নির্মাণশ্রমিককে একটি কক্ষে আটকে পিটুনি দেওয়া হলে আশরাফুল ও আসাদুল নামের দুই সহোদর মারা যান। নির্মাণশ্রমিকদের পিটুনিতে ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান, সদস্য অজিত বিশ্বাস ও অমৃত কুমার বসু নামের এক গ্রাম পুলিশ সদস্যের সংশ্লিষ্টতা পায় তদন্ত কমিটি।

তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য ‘সর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়া’র ভূমিকায় ছিলেন। তাদের নিখুঁত অভিনয় প্রথমে ধরা যায় নি।

পঞ্চপল্লীর ঘটনায় মধুখালী থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। দুই ছেলেকে হত্যার ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামী করে মামলা করেন নির্মাণশ্রমিকদের বাবা মো. শাহজাহান খান। মন্দিরের প্রতিমায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামী করে মামলা করেন ওই মন্দিরের পূজারি তপতী ম-ল। এ ছাড়া পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন মধুখালী থানার উপপরিদর্শক শংকর বালা। প্রথম দু’টি মামলায় সব অজ্ঞাত আসামী হলেও পুলিশের মামলায় ৩১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামানের নাম নেই।

মধুখালী থানার ওসি মো. মিরাজ হোসেন বলেন, ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে মামলাগুলো হওয়ায় তখন চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান সন্দেহের তালিকায় ছিলেন না। পরবর্তী সময়ে তদন্ত করে এবং ভাইরাল হওয়া ভিডিও ফুটেজ দেখে ইউপি চেয়ারম্যানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘আসাদুজ্জামান অত্যন্ত চতুর ব্যক্তি। তা ছাড়া ওই এলাকা মোবাইল প্রতারণার জন্য বিখ্যাত, সে কারণে তিনি মোবাইল টেকনোলজির ক্ষেত্রে দক্ষ। এ জন্য তাকে গ্রেপ্তার করতে বেগ পেতে হচ্ছে।’

https://www.dailysangram.info/post/556098