১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৬:৫০

বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমেছে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত : তীব্র তাপপ্রবাহে দুর্ভোগ চরমে

চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু তাপপ্রবাহ। তাপপ্রবাহের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। চট্টগ্রামের ২৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ফলে খরতাপে অস্থির জনজীবনে চলছে হাঁসফাঁস অবস্থা। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। তীব্র গরমে ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে সর্দি, জ্বর, ডায়রিয়াসহ নানা রোগ।

সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ২৬টি। এসব কেন্দ্রের বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা চার হাজার ৪০৪ মেগাওয়াট। কিন্তু গত মঙ্গলবার দিনের বেলায় ১৮১০ মেগাওয়াট এবং সান্ধ্যকালীন পিকআওয়ারে ১৬১৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে আবার বন্ধ রয়েছে মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন, রাউজানের ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২ নম্বর ইউনিট, শিকলবাহা ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং, জুলদা ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দু’টি ইউনিটসহ বেশ ক’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। তা ছাড়া তেলনির্ভর অধিকাংশ কেন্দ্রই নামমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি না পাওয়ায় অধিকাংশ তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র দিনের বেলায় বন্ধ রাখা হচ্ছে। এই কারণে উৎপাদন কমে গেছে। তা ছাড়া চট্টগ্রামের কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আবার নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় গ্রিডে। ফলে চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি বিদ্যুৎ মিলছে চট্টগ্রামে। ভাপসা গরম ও বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার ভেল্কিবাজিতে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বিদু্যুৎযন্ত্রণা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে । এমনিতেই দৈনিক গড়ে ১০-১২ বার বিদ্যুৎ যাচ্ছে, পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পকারখানার তথ্য অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ৯-১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকতে হয়। বিদ্যুৎ সঙ্কটে চট্টগ্রামের শিল্পকারখানার উৎপাদনে যেমনি বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে, তেমনি জনজীবনে তীব্র অস্বস্তি শুরু হয়েছে।

চট্টগ্রামের বৃহৎ ২১০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন রাউজান তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২ নম্বর ইউনিট এবং শিকলবাহা ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্যাস সঙ্কটে শাটডাউনে রয়েছে। পাশাপাশি শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদনও শূন্যের কোঠায়। এ ছাড়া বেসরকারি জুলদা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি ইউনিটের মধ্যে দুইটির উৎপাদন শূন্যের কোঠায় এবং অপর ইউনিটে ৪৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। ইউনাইটেড পাওয়ারের আনোয়ারা ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মাত্র ১৬ মেগাওয়াট উৎপাদন হয়েছে। চিটাগাং ১০৮ মেগাওয়াট পিপি ইসিপিভি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মাত্র ১২ মেগাওয়াট, ১০৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার শিকলবাহা বারাকা সিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সর্বোচ্চ ৩৪ মেগাওয়াট উৎপাদন হয়েছে। আর বাঁশখালীর কয়লাভিত্তিক এসএস পাওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ২৬৯ মেগাওয়াট। ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রাউজান তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এক নম্বর ইউনিটে উৎপাদন হয়েছে ১১৮ মেগাওয়াট। ফলে পরিস্থিতির তীব্র অবনতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পিডিবি সুত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামে দৈনিক প্রায় ১৫ শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। গতকাল বুধবার দিনের বেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ মিলছে এক হাজার ৭৮ মেগাওয়াট। এর মধ্যে আবার শিল্পকারখানার জন্য বরাদ্দ প্রায় আড়াই শ’ মেগাওয়াট রিজার্ভ রাখতে হয়। ফলে কার্যত চট্টগ্রামের জন্য বিদ্যুৎ মিলেছে ৮০০ মেগাওয়াট। পিডিবি’র জাতীয় গ্রিড থেকে সরাসরি এই লোডশেডিং করা হচ্ছে। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের নামে স্থানীয়ভাবেও লোডশেডিং করা হয়। ফলে দৈনিক লোডশেডিংয়ের পরিমাণ কত তারও হিসাব মেলানো দায় হয়ে পড়েছে।
ভুক্তভোগী নাগরিকরা জানান, গত কয়েকদিন ধরে বন্দরনগরীতে তীব্র তাপপ্রবাহের সাথে বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার ভেল্কিবাজি চলছে। এতে এক দিকে অসহনীয় লোডশেডিং আর ভাপসা গরম জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে, অন্য দিকে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান বৈদ্যুতিক সামগ্রী। তা ছাড়া বিদ্যুতের অভাবে এক দিকে ওয়াসার পানি শোধনাগারগুলোর পাম্প বন্ধ রাখতে হচ্ছে, অন্য দিকে ওভারহেড ট্যাংকে পানি তুলতে না পারায় দেখা দিচ্ছে পানির সঙ্কটও। এ বিষয়ে পিডিবির চট্টগ্রাম বিতরণ অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) মো: হুমায়ুন কবির মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, গরমের কারণে এক দিকে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে, চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি তেল না পাওয়ায় বেশকিছু তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এটা ন্যাশনাল ক্রাইসিস। বর্তমানে দৈনিক লোডশেডিং কত এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা নির্দিষ্ট নয়। একটা সময় লোডশেডিং থাকে আবার কিছু সময় থাকে না। বিদ্যুতের চাহিদা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি পরিবর্তনশীল বিষয় (মুহূর্তেই ফ্লাকচুয়েট করে)।

এ দিকে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের তথ্যানুযায়ী, গতকাল চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু তা অনুভূত হয়েছে প্রায় ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি। বায়ুমণ্ডলে আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় এত বেশি গরম অনুভূত হচ্ছে।

গেল কয়দিন ধরে চট্টগ্রামে তাপমাত্রা বেড়েই চলছিল। সর্বোচ্চ ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও পৌঁছে চট্টগ্রাম ও আশপাশের জেলাগুলোর তাপমাত্রা। এতে জ্বর, কাশি, হিট স্ট্রোক, ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরাসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছে মানুষ। হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বেড়েছে। চিকিৎকদের মতে, প্রচণ্ড গরমের মধ্যে কিছু ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসসহ অণুজীবগুলো বংশ বিস্তার করার অনুকূল পরিবেশ খুঁজে পায়। দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে অণুজীবগুলো বেশির ভাগ রোগ ছড়ায়। তাই খাদ্য ও পানীয় গ্রহণে মানুষকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

প্রচণ্ড গরমে মানুষ যখন অতিষ্ঠ এর সাথে ঘন ঘন বিদ্যুৎবিভ্রাট নগরবাসীর যন্ত্রণা বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। অসহ্য গরমে বাসাবাড়িতে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে।

পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মো: জহিরুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, গতকাল বুধবার চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও গরমের তীব্রতা বেশি হওয়ার পেছনে কারণ হলো বায়ুমণ্ডলে আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়া। গতকাল বেলা ৩টায় চট্টগ্রামে আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল ৭৫ শতাংশ। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল নাগাদ বৃষ্টির আভাসও দিয়েছেন তিনি।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/828700