১১ মে ২০১৬, বুধবার

শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। ২০১০ সালের ২৯ জুন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বানোয়াট-ঠুনকো অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। ৯টি হয়রানিমূলক মামলায় জড়ানো হয় মাওলানা নিজামীকে। এসব মামলায় তাকে ২৪ দিন রিমান্ডে নেয়া হয়। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান ও শীর্ষ স্থানীয় আলেমকে রিমান্ডে নিয়ে মানসিক নির্যাতনের ঘটনা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে করেছে কলঙ্কিত।

অন্যান্য মামলায় জামিন পাওয়ার পরও সরকার হীন উদ্দেশ্যে কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১০ সালের ২ আগস্ট তাঁকে গ্রেফতার দেখায়।

কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার : রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকার জামায়াত নেতৃত্বকে সাজা দেয়ার আয়োজন সম্পন্ন করে। ১৯৭৩ সালের আইনে সংশোধন এনে দলীয় তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে মিথ্যা অভিযোগ ও সাজানো সাক্ষী দিয়ে কথিত মানবতাবিরোধী বিচারের রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই বিচারের জন্য প্রণীত আইন ও বিধিমালা নিয়ে শুরু থেকেই দেশে-বিদেশে বিশেষজ্ঞগণ গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র্যাগপ, আইনজীবীদের বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইট্স ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ও সংস্থা এ নিয়ে আইন সংশোধনের জন্য নানা সুপারিশও দিয়েছে। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাতই করেনি। সরকার তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চিরতরে শেষ করে দেয়ার জন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দকে একের পর এক হত্যা করেই চলছে। ইতোমধ্যে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল স্বীকার করেছেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই বিচার হচ্ছে।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হত্যার জন্যই আইন : যুদ্ধাপরাধের জন্য প্রণীত আইনটি নিজেই ন্যায়বিচারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এটি মূলত এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে রাষ্ট্রপক্ষ সবক্ষেত্রেই আইনি পন্থায় বেআইনি সুবিধা লাভ করতে পারে। ট্রাইব্যুনাল গঠন থেকে শুরু করে তদন্ত, বিচারক নিয়োগসহ সাক্ষ্যগ্রহণ এমনকি ফাঁসি কার্যকর করা পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই এ বিশেষ সুবিধার প্রতিফলন ঘটেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ৬ নং ধারা অনুযায়ী সরকার চাইলে এক বা একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। যেখানে সরকার নিজেই বাদি সেখানে ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিচারক নিয়োগের এখতিয়ার সরকারের হাতে থাকায় নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনাল গঠন বা ন্যায়বিচার কোনটি-ই সম্ভব না। পাশাপাশি ট্রাইব্যুনাল চাইলে দ্রুত বিচারের স্বার্থে কোনো সাক্ষ্য ছাড়াই বিচারকার্য সম্পন্ন করতে পারবে আবার চাইলে রায় দেয়ার জন্য একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যই পর্যাপ্ত মনে করতে পারবে।

শুধু তাই নয়, দেশীয় আদালতে বিচার হলেও সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধির মত মৌলিক আইনগুলোকে বাতিল করে পত্রিকায় ছাপানো খবর বা প্রবন্ধ, সাময়িকী, সিনেমা, টেপ রেকর্ডারসহ সব ধরনের অনির্ভরযোগ্য প্রমাণপত্র গ্রহণের এখতিয়ার আদালতের রয়েছে, যা ন্যায়বিচারের পথকে বন্ধ করে দিয়েছে। যখন একজন বিচারকের স্কাইপ কেলেঙ্কারি জনসাধারণের নিকট প্রকাশ পায় তখনই স্পষ্ট হয়ে যায় যে এটি মূলত বিচারের নামে প্রহসনের নাটক ছাড়া আর কিছুই নয়।

২১ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, শুধু আসামিপক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। আইনটি এরকম ছিল কারণ তারা নিশ্চিত ছিল যে, আদালত অভিযুক্তদের ফাঁসি দেবে। কিন্তু পক্ষপাতদুষ্ট বিচারক নিয়োগ দেয়ার পরও যখন শহীদ আবদুল কাদের মোল্লাকে শুধু যাবৎজীবন কারাদন্ড দেয়া হয় তখন বিচারিক হত্যা নিশ্চিত করার জন্য ধারাটি সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষকেও আপিল করার অধিকার দিয়ে সংশোধনীর ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা প্রদান করা হয়, যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। তখন বুঝার আর বাকি থাকে না যে, এটি আসলেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আইনের মাধ্যমে একটি বিচারিক হত্যার আয়োজন ছাড়া আর কিছুই নয় এবং এর শিকার মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। এ দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ সকল ইসলামী নেতৃবৃন্দ তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।

আমীরে জামায়াত মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অসঙ্গতি-

১. আল বদর কমান্ডার হিসেবে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় চাপানো হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের যত পত্রিকা এবং গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট আছে, তার কোথাও আল বদর বাহিনীর সাথে মাওলানা নিজামীর দূরতম কোনো সম্পর্ক আছে বলে প্রমাণ নেই। এসব পত্রিকা ও গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট সরকার পক্ষই আদালতে দাখিল করেছিল।

২. সাক্ষী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ও সালমা হক বলেছেন, ১৯৭১ সালের পত্রিকায় দেখেছেন মাওলানা নিজামী আল বদর বাহিনীর প্রধান, কিন্তু সরকারপক্ষের দাখিল করা ১৯৭১ সালের কোনো পত্রিকায়ই এ ধরনের খবর নেই। এ ব্যাপারে আদালতের যুক্তি, পত্রিকায় না থাকলেও তারা ২ জন যেহেতু সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি, ধরে নিতে হবে তারা পত্রিকায় দেখেছেন।

৩. বলা হয়েছে ছাত্রসংঘ মানেই আল বদর। যেহেতু মাওলানা নিজামী ছাত্রসংঘের প্রধান ছিলেন, সেহেতু তিনি পদাধিকার বলে আল বদর বাহিনীরও প্রধান। মাওলানা নিজামী ছাত্রসংঘের প্রধান ছিলেন ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এর পর থেকে তিনি ছাত্রসংঘে ছিলেন না। বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা সেপ্টেম্বরের পরে হয়েছে। সেই হত্যাকান্ডের দায় দায়িত্ব তার ওপর চাপানো হয় কিভাবে?

৪. এ ব্যাপারে আদালত বলেছেন, মাওলানা নিজামী ৫ বছর ছাত্রসংঘের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাই তিনি ছাত্রসংঘ থেকে অবসর নিলেও একদিনে তাঁর এই সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না। এর চেয়ে খোঁড়া অজুহাত আর কী হতে পারে?

৫. বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড নিয়ে দুইজন মহিলা সাক্ষী বলেছেন, তাদের স্বামীকে যারা ধরে নিয়ে যায়, তারা বলেছে, হাইকমান্ড নিজামীর নির্দেশে তারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এ দু’টি ঘটনা নিয়ে মামলা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড নিয়ে এ রকম আরো ৪০টিও বেশি মামলা হয়েছিল। এসব মামলার কোথাও মাওলানা নিজামীর নাম তখন আসেনি। ওই দুই মহিলা সাক্ষী তাদের স্বামীদের হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অসংখ্যবার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। একজন সাক্ষী তার স্বামীর হত্যাকান্ড নিয়ে বই লিখেছেন। আরেকজন শাহরিয়ার কবিরের মতো চরম জামায়াতবিদ্বেষী মানুষের বইয়ে তার স্বামীর হত্যাকান্ড নিয়ে বিশদ বর্ণনা দেন। এ সবের কোথাও তারা এ ঘটনার সাথে মাওলানা নিজামীর দূরতম কোনো সম্পর্ক ছিল, তা বলেনি। এমনকি এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছেও তারা মাওলানা নিজামীর নাম বলেনি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তারা আদালতে এসে প্রথমবারের মতো মাওলানা নিজামীর নাম বলে।

এ ব্যাপারে আদালত বলেন, হয়তো এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছে, অথবা ভুলবশত বলার পরও লিখেনি। যেখানে মাওলানা নিজামী একমাত্র আসামি, সেখানে তার ব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তার জিজ্ঞেস করতে ভুলে যাওয়া বা লিখতে ভুলে যাওয়ার কথা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে?
পাবনার ঘটনা

৬. ১৯৭১ সালে মাওলানা নিজামী পরিচিত ছাত্রনেতা ছিলেন, তিনি সে সময় বাংলাদেশের যে স্থানেই গিয়েছেন, পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট এসেছে। এমনকি সরকারের গোপন গোয়েন্দা রিপোর্ট, যা সরকার আদালতে দাখিল করেছে, সেখানেও বর্ণিত রয়েছে। ১৯৭১ সালে তিনি পাবনা গিয়েছেন, এ মর্মে কোনো রিপোর্ট পত্রিকায়ও আসেনি। গোয়েন্দা রিপোর্টেও ছিল না। এমনকি কট্টর জামায়াতবিদ্বেষী ড. এম এ হাসান তার লিখিত বই ‘যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ’ চার্জে বর্ণিত পাবনার ঘটনাসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা দিলেও কোথাও মাওলানা নিজামীর নাম উল্লেখ করেননি।

সরকার ১৯৭২ সালে পাবনা জেলার রাজাকার, আল বদর ও স্বাধীনতাবিরোধীদের যে তালিকা তৈরি করে, সেখানে কোথাও মাওলানা নিজামীর নাম নেই। এ ব্যাপারেও আদালত বলেন যে, ১৯৭২ সালে প্রস্তুতকৃত রাজাকার, আল বদরের প্রাথমিক তালিকা ছিল, সেখানে সমস্ত রাজাকার, আল বদরের নাম থাকা জরুরি নয়। এটা কি বাস্তবসম্মত যুক্তি হতে পারে? কেননা, এই মামলায় মাওলানা নিজামীকে রাজাকার আল বদরদের নেতা হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। এমনকি দাবি করা হয়েছে, পাকিস্তানি আর্মি তার কথায় অপরাধ সংঘটিত করতো।

এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় যে, সরকার পক্ষের দাবি সত্য হলে, এমনকি প্রাথমিক তালিকায় তার নাম থাকবে না।
সর্বোপরি ১৯৮৬ সালের আগে, প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনপ্রিয় ইসলামী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন, তার আগে কোথাও কোন পত্রিকা/বই, মামলার নথিতে আল বদর প্রধান বা সদস্য অথবা বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত অথবা পাবনা বা ঢাকায় ১৯৭১ সালে সংঘটিত কোনো অপরাধের সাথে জড়িত বলে কোথাও মাওলানা নিজামীর নাম আসেনি।

প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশে করে যা বললেন : 

মাওলানা নিজামীর আপিল শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেন। এতে তিনি জিজ্ঞেস করেন, নিজামীর সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়ে আপনাদের কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। এতে তাঁকে ফাঁসি দেয়া যাবে কি? প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে জানতে চান, “এটা কি কারেক্ট যে ১৯৮৬ সালের আগে নিজামী সাহেবের বিরুদ্ধে নাকি কিছুই নাই? আমাদেরকে একটা কিছু দেখান যেটা ১৯৮৬ সালের আগে প্রকাশিত।” অ্যাটর্নি জেনারেল কোনো কিছু দেখাতে ব্যর্থ হন।

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং হত্যাও সংঘটিত হয়েছে এ বিষয়গুলো তো নিজামীর আইনজীবীরা স্বীকার করেছেন। কিন্তু নিজামী সরাসরি হত্যা, ধর্ষণে জড়িত ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ আপনাদের কাছে আছে? প্রধান বিচারপতি আবার প্রশ্ন করেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি অংশগ্রহণ না থাকলে তাঁকে ফাঁসি দেয়া যাবে কি? (সূত্র : শীর্ষ নিউজ, এনটিভি অনলাইন ০৭ ডিসেম্বর ২০১৫)

রায়ে মাওলানা নিজামীর আইনজীবীর প্রতিক্রিয়া
খন্দকার মাহবুব হোসেন

মৌলিক অধিকারবিহীন, অসাংবিধানিক ও একটি কালো আইনে বিশেষ উদ্দেশ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের এবং নিজামীর বিচার হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তাঁর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। ৫ মে রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনটি করা হয়েছিল ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনার বিচারের জন্য। কিন্তু মূল হোতাদের বাদ দিয়ে তাদের সহযোগীদের বিচার করা হচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এর মূল্যায়ন করবে। এখনো বলছি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন যে এই আইনে বিচার সঠিক হয়েছিল কি না। তিনি বলেন, এই আইনে এমন কিছু বিধান আছে যা আমাদের সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধি কার্যকর না। তিনি বলেন, এখানে সাক্ষী দেয়া হয় শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে। তাই এই শিখানো সাক্ষীর ভিত্তিতে যখন যার বিরুদ্ধে খুশি মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়।

শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর প্রধান আইনজীবী
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক

মাওলানা নিজামী রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার তাঁর রক্ত বৃথা যেতে পারে না। আজ থেকে ৬ বছর আগে ২৯ জুন ২০১০ সালে ধর্ম অবমাননার মামলায় মাওলানা নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়, এটা বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। মাওলানা নিজামীকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে অনেক যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে নুরেমবার্গ থেকে সিওরালিয়ন কিন্তু মাওলানা নিজামী ৪০ বছর দেশে থাকার পরও কেউ কোনো দিন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনেননি। সরকার আইন ভঙ্গ করেছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।
(সূত্র: মাওলানা নিজামীর শাহাদাতের পর লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে অনুষ্ঠিত গায়েবানা জানাজায় দেয়া বক্তব্য।)

ছোট্ট অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মাওলানা নিজামী : মাওলানা নিজামীর মেজো ছেলে ডা: নাঈম খালেদ শেষ সাক্ষাতের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমরা কনডেম সেলে শেষ সাক্ষাতের দিন আব্বুর কক্ষের সামনে যাই। সেলটির নাম রজনীগন্ধা। সেলের সর্বশেষ কক্ষ ৮ নম্বর প্রকোষ্ঠে আব্বু ছিলেন। রুমটি জানালাবিহীন, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে আনুমানিক ৮/৮ ফিট, একদিকে লোহার গরাদ দিয়ে ঘেরা আর তার সামনে ছোট একটি আধো অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রাঙ্গণ।

রুমের ভেতরে সবুজ একটি জায়নামাজে বসে আব্বু আমাদের উল্টোদিকে কেবলামুখী হয়ে দোয়া করছিলেন। শান্ত ও স্পষ্ট উচ্চারণে আরবিতে দোয়া করছিলেন, খুব উচ্চস্বরেও না আবার খুব নিচুস্বরেও না। প্রতিটি বাক্যের মাঝে স্বভাবসুলভ একটু বিরতি। ঠিক যেমনটা আমরা আমাদের ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। পাশে হালকা বাদামি রঙের একটি বাচ্চা বিড়াল বসা। যেন উনার সাথে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাচ্ছে। মুয়াজ (উনার তিন বছর বয়সী নাতী) সিঁড়ি বেয়ে উঠে লোহার গরাদ ধরে বলল, “দাদু দরজা খোলো আমরা আসছি”। আব্বু শান্তভাবে মোনাজাত শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। আমাদের দেখে লোহার গরাদের কাছে এসে বললেন, “তোমরা আসছো? এটাই তাহলে শেষ দেখা?”

উনি সিকের ওপার থেকেই সবার সাথে হাত মেলালেন। উনার পরনে ছিল সাদা সুতি পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরমে আর জানালাবিহীন রুমের কারণে উনার পাঞ্জাবিটি ঘামে ভেজা, কিন্তু মুখটা প্রশান্ত; কষ্ট বা উদ্বেগের লেশমাত্র নেই। দেখে কে বলবে একটু পরে উনার ফাঁসি দেবে এই জালিম সরকার।

এসময় সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আব্বু আম্মুকে বলেন আজ থেকে তুমি ওদের বাবা ও মা দুটোই। তোমার মাঝে যেন ওরা আমাকে দেখতে পায়। আর তুমিও আমাদের সন্তানদের মাঝে আমাকে খুঁজে পাবে।

আব্বু আমাদেরকে বলেন, “তোমরা ভাইবোনেরা মিলেমিশে থাকবে, আল্লাহ ও রাসূলের (সা) পথে চলবে, মায়ের খেদমত করবে। তোমরা তোমাদের মায়ের মাঝেই আমাকে খুঁজে পাবে। আর তোমাদের আম্মা যেন তোমাদের মাঝে আমাকে খুঁজে পায়। তোমরা তোমাদের আব্বুকে যেভাবে দেখেছো সেটাই মানুষকে বলবে, আমার ব্যাপারে বাড়তি কথা বলা থেকে বিরত থাকবে। আমার বয়স এখন ৭৫ বছর, আমার সহকর্মীদের অনেকেই আমার মত লম্বা হায়াত লাভ করে নাই, তোমরা তোমাদের বাবাকে দীর্ঘদিন পেয়েছ, হায়াত মাউত আল্লাহর হাতে, আমার মৃত্যু যদি আল্লাহ আজকে রাতেই লিখে রেখে থাকেন তাহলে বাসায় থাকলেও মৃত্যু হতো। সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখবে আর শুকরিয়া আদায় করবে।”

এরপর আব্বু বিশেষ করে যারা তার জন্য, অন্যান্য নেতৃবৃন্দের জন্য সর্বোপরি ইসলামী আন্দোলনের জন্য কষ্ট করছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ ও সালাম জানাতে বলেন। সকলের কাছে দোয়া কামনা করেন যেন আল্লাহ তায়ালা তার শাহাদাত কবুল করেন।

তখন আম্মু বলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে দুনিয়াতেও সম্মানিত করেছেন, আখেরাতেও সম্মানিত করবেন ইনশাআল্লাহ’। আব্বু তখন বলেন, আমি সামান্য অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে। আল্লাহর রহমতে আমার জন্য গোটা দুনিয়া ও বড়-বড় আলেমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, দোয়া করেছেন। আমার মুক্তির ব্যাপারে ওআইসিতে আলোচনা হবে দেখে শেখ হাসিনা ওআইসি সম্মেলনে যায়নি, এগুলোতো পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।

আমরা আব্বুকে বলি, আমাদের জন্য কাল কেয়ামতের দিনে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবেন, যেন আমরা জান্নাতে যেতে পারি। আব্বু বলেন, “তোমরা জান্নাতে যাওয়ার মতো আমল কর, তাহলে ইনশাআল্লাহ জান্নাতে যেতে পারবে।”

শাহাদাতের পূর্বে মাওলানা নিজামীর দীর্ঘ মোনাজাত : এরপর আব্বু আমাদের অনুরোধে আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে দোয়া করেন। প্রায় ঘন্টাখানেক এই মোনাজাতপর্ব স্থায়ী হয়। আল্লাহর প্রশংসা ও নবী করীম (সাঃ) এর প্রতি দুরুদ পাঠ করার পর প্রথমে প্রায় ২০ মিনিট, রাসূল (সা)-এর শিখিয়ে দেয়া মাসনুন দোয়াগুলো, যেগুলো আব্বুকে সারা জীবন করতে দেখেছি সেগুলো পাঠ করেন।

অতঃপর তিনি বলেন, “হে আল্লাহ আমি তোমার এক নগণ্য গুনাহগার বান্দাহ, তুমি আমাকে যতটুকু তোমার দ্বীনের খেদমত করার তাওফিক দিয়েছো তা মেহেরবানি করে কবুল করে নাও। আমাকে ইসলাম ও ঈমানের ওপর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকার তাওফিক দাও আর শাহাদাতের মৃত্যু দান কর। হে আল্লাহ তুমি আমাকে আর আমার বংশধরদেরকে নামায কায়েমকারী বানাও আর আমাকে আমার পিতা-মাতাকে আর সকল মুমিনদেরকে কাল কিয়ামতের দিনে ক্ষমা কর।

হে আল্লাহ আমাদেরকে পরিপূর্ণ ঈমান দান কর, তোমার ওপর সত্যিকারের ভরসা করার তাওফিক দান কর। আমাদের জিহবাকে তোমার সার্বক্ষণিক জিকিরকারী বানাও। আমরা তোমার কাছে, তোমার ভয়ে ভীত অন্তর, উপকারী জ্ঞান, হালাল প্রশস্ত রিজিক, সুস্থ বুদ্ধি ও দ্বীনের সঠিক বুঝ ভিক্ষা চাচ্ছি। হে আল্লাহ আমাদেরকে মৃত্যুর পূর্বে তওবা করার তাওফিক দাও, মৃত্যুর সময় আরাম দান কর, মৃত্যুর পরে তোমার ক্ষমা লাভ করার তাওফিক দাও ও দোজখের আগুন থেকে রক্ষা কর।

হে আল্লাহ তোমার হালালকৃত জিনিসের মাধ্যমে হারাম থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দাও, তোমার আনুগত্যের মাধ্যমে তোমার নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দাও আর আমাদেরকে তুমি ছাড়া কারও মুখাপেক্ষী করো না। আল্লাহ তোমার নুর দিয়ে আমাদেরকে হেদায়াত দান কর। আমাদের সকল গুনাহ খাতা তোমার সামনে পরিষ্কার, তোমার কাছেই ক্ষমা চাচ্ছি ও তোমার নিকট প্রত্যাবর্তন করছি। ইয়া হান্নান ইয়া মান্নান।”

তিনি আরো দোয়া করেন, “হে আল্লাহ তুমি এই দেশকে তোমার দ্বীনের জন্য কবুল করে নাও, এই দেশের জন্য শান্তির ফয়সালা করে দাও। এ দেশকে গুম, খুন, রাহাজানি ও আধিপত্যবাদীদের হাত থেকে রক্ষা কর”। তিনি দেশ ও দেশবাসীর সুখ সমৃদ্ধির জন্যও দোয়া করেন। এই আবেগঘন মোনাজাতের সময় আমার মেয়ে কয়েকজন জেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর চোখে পানি দেখেছে বলে পরে আমাকে জানায়।

ব্যক্তিজীবনে একজন চিকিৎসক হওয়ায় আমাকে এর আগে বহু মৃত্যু দেখতে হয়েছে। বহু লোককে দেখেছি রোগে শোকে মৃত্যুর প্রহর গুনতে। আমি দেখেছি তাদের চেহারায় মৃত্যুর ছায়া, কিংবা একটি মুহূর্ত বেশি বেঁচে থাকার আকুতি। কিন্তু আব্বুকে শেষ সাক্ষাতে দেখতে গিয়ে আমি জীবনে প্রথম দেখলাম নির্ভীক একজন জান্নাতি মেহমানকে, তাঁর মহান রবের সাথে মিলিত হওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি নিতে। আব্বুর কাছে সুযোগ ছিল রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া নিয়ে কালক্ষেপণ করার। মৃত্যুর সময় আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত তা আমরা সবাই জানি। আজ দেখলাম অন্তরে সেই বিশ্বাসকে ধারণ করে কিভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়।

সাক্ষাতের শেষপর্যায়ে আব্বু জিজ্ঞেস করলেন সাঁথিয়ায় দাফন করতে কে কে যাবে? আমি বললাম আমি আর মোমেন যাবো। তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সাবধানে যেতে বললেন আর মিঠু ভাইকে সাথে রাখতে বললেন। আম্মাকে রাতে সাঁথিয়া যেতে মানা করলেন। মোমেনকে জানাযার নামাজের ইমামতি করতে বললেন। মোমেন প্যান্ট শার্ট পরে ছিল, তিনি বললেন পাঞ্জাবি পরে জানাজা পড়াতে।

তিনটি বই পড়তে বললেন মাওলানা নিজামী : সাক্ষাতের শেষ দিকে মাওলানা নিজামী বলেন, আমার অসিয়তগুলো তোমরা আমার লেখা বইগুলোতে পাবে। বিশেষ করে জেলে বসে লেখা দু’টি বই- কুরআন হাদিসের আলোকে রাসূল মুহাম্মদ (সা) ও আদাবে জিন্দেগি এবং আগে লেখা বই ‘কুরআনের আলোকে মুমিনের জীবন’ প্রভৃতি বইগুলো পড়তে বলেন।

বাবার কাছ থেকে শেষ বিদায় : সবশেষে আমার সবচেয়ে বড়বোন মহসিনা আপাকে বললেন, “আম্মু আমি তোমাকে নিয়ে বেশি চিন্তিত, তুমি আমার মা, আমার সবচেয়ে বড় সন্তান, তোমার মুখেই প্রথম আমি আব্বু ডাক শুনেছি। তুমি শান্ত থেক।” আম্মুকে বললেন, “আমার সোনার টুকরা ৬ ছেলেমেয়েকে রেখে গেলাম তুমি এদের মাঝেই আমাকে খুঁজে পাবে। তোমরা যাও, আমি তোমাদের যাওয়া দেখি।”

আমরা একে একে হাত মিলিয়ে আমাদের জান্নাতি বাবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ছোট্ট বিড়ালটিও আমাদের পিছু নিলো। শেষ সময়ের দেখা আব্বুর উজ্জ্বল চেহারাটি সারাটি পথ চোখে ভাসছিল। কোথায় যেন শুনেছিলাম some birds are not meant to be caged, their feathers are just too bright.

জীবিত বাবাকে রেখে চললাম দাফনের প্রস্তুতি নিতে : জেল থেকে বের হয়ে রওয়ানা হলাম সাঁথিয়ার উদ্দেশে, জীবিত বাবাকে রেখে চললাম তার দাফনের প্রস্তুতি নিতে। রাসূল (সা)-এর সেই হাদিসটি তখন বার বার মনে পড়ছিল, যখন তোমরা কোন বিপদ মুসিবতে পড়বে তখন স্মরণ কর সবচেয়ে বড় মুসিবতের কথা। সেটা হবে আমাকে হারানোর মুসিবত। (ইবনে মাজাহ)। এই উম্মত রাসূল (সা)কে হারানোর কষ্ট সহ্য করেছে। এই উম্মত সবই সহ্য করতে পারবে। রাব্বানা আফরিগ আলাইনা সাবরাও ওয়া সাব্বিত আকদামানা ওয়ানসুরনা আলাল ক্বাওমিল কাফিরিন।

আমি প্রস্তুত : পরিবারের সাথে শেষ সাক্ষাতের সময় সবাইকে নিয়ে মোনাজাত শেষে মাওলানা নিজামী তার ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমেনকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি ফাঁসির মঞ্চে লুঙ্গি পরে না পাঞ্জাবি-পাজামা পরে যাবেন? মোমেন বললেন, পাঞ্জাবি-পাজামা পরে যাবেন। আল্লাহর প্রিয় বান্দা, মর্দে মুজাহিদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করার প্রেরণায় কতটা ব্যাকুল ছিলেন, তা এখান থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায়। পরিবারের সদস্যদের বিদায় দিয়ে মহান রবের পানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন মাওলানা নিজামী। জল্লাদরা যখন তার কক্ষের সামনে যায়, তিনি বললেন, ‘আমি প্রস্তুত’।

অশ্রুসিক্ত ভালোবাসায় প্রিয় নেতার বিদায় : রায় কার্যকরের নির্বাহী আদেশ ১০ মে ২০১৬ সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারাগারে পাঠানো হয়। ১১ মে ২০১৬ রাত ১২টা ১০ মিনিটে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে তিনি মহান রবের পানে চলে যান। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।