১ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১১:০১

গ্যাসের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি ঘটাবে

সব শ্রেণীর গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ২৩ ফেব্রুয়ারি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে বিইআরসি। এতে দেখা যায়, গড়ে ২২ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেড়েছে গ্যাসের দাম। দুই ধাপে বর্ধিত এ মূল্যহার কার্যকর হবে। প্রথম ধাপে বাড়ানো হয়েছে গড়ে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা আজ অর্থাৎ ১ মার্চ থেকে কার্যকর হবে। প্রথম ধাপের বর্ধিত মূল্যের ওপর আরও ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ বাড়বে দ্বিতীয় ধাপে এবং তা কার্যকর হবে আগামী ১ জুন থেকে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল। ওই সময় গ্রাহক পর্যায়ে সব ধরনের গ্যাসের দাম গড়ে ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়েছিল। এর দেড় বছরের মাথায় আবারও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা এলো। নতুন করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি অন্য সব খাতকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এ নিবন্ধে তা আলোচনা করব।

নতুন মূল্যহার অনুযায়ী, গৃহস্থালিতে প্রথম দফায় ১ মার্চ থেকে এক চুলার জন্য মাসিক বিল বর্তমান ৬০০ টাকার পরিবর্তে ৭৫০ টাকা এবং দুই চুলার বিল বিদ্যমান ৬৫০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা হবে। দ্বিতীয় ধাপে আগামী ১ জুন থেকে এক চুলার ক্ষেত্রে মাসিক বিল ৯০০ টাকায় ও দুই চুলার ক্ষেত্রে ৯৫০ টাকায় পরিশোধ করতে হবে। এ হিসাবে এক চুলার ক্ষেত্রে জুন থেকে বিদ্যমান মূল্যের চেয়ে ৫০ শতাংশ এবং দুই চুলার ক্ষেত্রে ৪৬ দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি বিল পরিশোধ করতে হবে। তবে গৃহস্থালিতে মিটারভিত্তিক গ্যাসের দাম বাড়বে ৬০ শতাংশ। ক্যাপটিভ পাওয়ারে প্রথম দফায় প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৮ দশমিক ৩৬ টাকা থেকে ৮ দশমিক ৯৮ টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় ৯ টাকা ৬২ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। শিল্পে বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ৬ দশমিক ৭৪ টাকা হলেও মার্চ থেকে ৭ টাকা ২৪ পয়সা এবং জুন থেকে ৭ টাকা ৭৬ পয়সা পরিশোধ করতে হবে। চা বাগানে গ্যাসের দাম ৬ দশমিক ৪৫ টাকা থেকে দুই দফায় বেড়ে ক্রমে ৬ টাকা ৯৩ পয়সা ও ৭ টাকা ৪২ পয়সা হবে। বাণিজ্যিক খাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১১ দশমিক ৩৬ টাকা থেকে বেড়ে প্রথম দফায় ১৪ টাকা ২০ পয়সা ও ১৭ টাকা ৪ পয়সা হয়েছে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে গ্যাসের মূল্যহার পুনর্নির্ধারণে সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতের গ্যাসের দাম বাড়ানো না হলেও এবার এ দুই শ্রেণীতেও দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎখাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ২ টাকা ৮২ পয়সা থেকে প্রথম দফায় ২ টাকা ৯৯ পয়সা এবং দ্বিতীয় দফায় ৩ টাকা ১৬ পয়সা করা হয়েছে। সার কারখানাগুলোর জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের বিদ্যমান দাম ২ টাকা ৫৮ পয়সা থেকে মার্চে এ মূল্য ২ টাকা ৬৪ পয়সা এবং জুনে ২ টাকা ৭১ পয়সা হবে। বাণিজ্যিক খাতে প্রথম দফায় প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে ১৪ টাকা ২০ পয়সা এবং দ্বিতীয় দফায় ১৭ টাকা ০৪ পয়সা করা হয়েছে। সিএনজির দাম প্রথম দফায় প্রতি ঘনমিটারে ৩৫ টাকা থেকে ৩৮ টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় ৪০ টাকা করা হয়েছে।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা তুলে ধরে বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেছেন, গ্রাহকদের সামর্থ্য ও বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অযৌক্তিক মূল্য চাপিয়ে দেয়া হয়নি। জ্বালানি খাতে ভবিষ্যতে বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। সেই প্রয়োজন মেটাতে বর্ধিত মূল্যহার ভূমিকা রাখবে।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ভোক্তা অধিকার আন্দোলন, শিল্প ও বাণিজ্যিক সংগঠন, রফতানিকারক সমিতি, বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ অনেকে।

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এ দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, অগণতান্ত্রিক ও অন্যায়। তিনি অবিলম্বে বর্ধিত মূল্যহার প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। এদিকে দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে তার দল কর্মসূচি দেবে। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ গণবিরোধী ও অযৌক্তিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এবং গাড়ি ভাড়া, বাড়ি ভাড়া আকাশছোঁয়া। এর ওপর আবার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে ফেলে দেবে। গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষ থেকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সমালোচনা করে বলা হয়েছে, এই সিদ্ধান্ত দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি করবে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকায় আধাবেলা হরতাল ডাকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। এ হরতালে সমর্থন দেয় বিএনপি।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি বলেছেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকারের উচিত রফতানি খাতে প্রণোদনা দেয়া। তা না হলে রফতানি প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে পড়বে। এদিকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) উল্লেখ করেছে, গৃহস্থালি ও শিল্প খাতে দুই ধাপে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে ব্যবসায়ের ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সংগঠনটি মনে করে, বর্তমানে গৃহস্থালি ও শিল্প খাতে চাহিদামাফিক গ্যাস সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না। এর ওপর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পণ্য উৎপাদন, রফতানি এবং পণ্য পরিবহনসহ ব্যবসায়িক সব কর্মকাণ্ডের ব্যয় বৃদ্ধি করবে। ফলে খুচরা বাজারে পণ্যের মূল্য তথা মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হবে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেছেন, গণশুনানিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা প্রমাণ হয়নি। কোম্পানিগুলোর ব্যয় বাড়বে বলে যে যুক্তি দেয়া হয়েছিল তাও কোম্পানিগুলোর বর্তমান লাভ থেকে জোগান দেয়া সম্ভব। আর ভবিষ্যতে জ্বালানির দাম বাড়বে বলে যে যুক্তি দেখানো হচ্ছে তাও যৌক্তিক নয়। এদিকে ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে ভোক্তা অধিকার ক্ষুণœ হয়েছে এবং তিনি এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার কথা বলেছেন (ইত্তেফাক, ২৫ ফেব্রুয়ারি)। বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে বিস্ময় ও হতাশা প্রকাশ করেছে এবং বলেছে, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো উল্লেখযোগ্য হারে মুনাফাসহ ব্যবসা করছে। সিএনজির মূল্য বৃদ্ধির ফলে গণপরিবহনের ভাড়া ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। এটি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করবে।

বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম বাড়ার অজুহাতে ইতিমধ্যেই বিদ্যুতের দাম বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে অন্যান্য খাতের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষি খাত। মূলত সেচনির্ভর শুষ্ক মৌসুমের বোরো আবাদ সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বোরো আবাদে খরচ বৃদ্ধি পেলেও ধানের আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় ইতিমধ্যে বোরো চাষে কৃষকদের আগ্রহের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে বোরো আবাদে কমে যাচ্ছে জমির পরিমাণ। সরকারি তথ্য মোতাবেক, বোরো আবাদে জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ১ কোটি ৯১ লাখ ৯২ হাজার টন বোরোর উৎপাদন গত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) ১ কোটি ৮৯ লাখ ৩৭ হাজার টনে নেমে এসেছে। অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে বোরোর উৎপাদন কমেছে ২ লাখ ৫৫ হাজার টন। বিদ্যুৎ ও সারের দাম আরও বৃদ্ধি পেলে অনেক বোরো চাষী বোরো চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। এতে বর্তমানে চাল উৎপাদনে শীর্ষস্থানে থাকা বোরোর উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাবে, যা দেশে মোট চাল উৎপাদনের ওপর বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ যে চাল উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে তার পেছনে বোরোর অবদান সবচেয়ে বেশি। বোরোর উৎপাদন কমে গেলে বাংলাদেশ আবার চাল আমদানিকারক দেশে পরিণত হবে।

বিইআরসি’র চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘জ্বালানি খাতে ভবিষ্যতে বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। সেই প্রয়োজন মেটাতে গ্যাসের বর্ধিত মূল্যহার ভূমিকা রাখবে।’ কিন্তু জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস থেকে সরকারের অতিরিক্ত আয় জ্বালানি খাতের উন্নয়নে অবদান রাখবে না। তারা বলছেন, অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, গ্যাসের দাম বাড়ালে অর্থের অপচয় বাড়ে, কিন্তু গ্যাস খাতের দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন হয়নি। তাছাড়া গ্যাস উন্নয়ন খাতে প্রচুর টাকা অলস পড়ে রয়েছে। গ্যাস উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোও লাভজনক অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ সেখান থেকেই জোগান দেয়া যেত। জনগণের ওপর ব্যয়ের বাড়তি বোঝা চাপানোর দরকার হতো না।

যেহেতু গ্যাসের দাম বৃদ্ধি অর্থনীতির অন্যসব খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, সেহেতু বিইআরসি গ্যাসের দাম বৃদ্ধি সংক্রান্ত তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পারে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি শেষ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি আকারে জনগণের ঘাড়ে চাপবে। তাই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল করা হলে তা জনগণকে আরও দুর্ভোগের হাত থেকে রেহাই দেবে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক