২৫ জুন ২০২৪, মঙ্গলবার, ১২:৪৬

‘পালানোর পর’ মতিউরের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা

রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান, তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ এবং ছেলে আহমদ তৌফিকুর রহমানের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। গতকাল সোমবার ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এই আদেশ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম কালের কণ্ঠকে এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। যদিও গত রবিবার বিকেলে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ছদ্মবেশে মাথার চুল কেটে ন্যাড়া হয়ে মতিউর দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে দেশ ছেড়ে গেলেও মতিউর নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে অন্যের মাধ্যমে যোগ দিয়েছেন। তিনি সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ হারানোর পর অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আবু ইউসুফকে তিন বছরের জন্য ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

দুদক আইনজীবী মীর আহমেদ আলী বলেন, মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ দুদক অনুসন্ধান করছে।

মতিউর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এ জন্য তাঁদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করে দুদক। শুনানি শেষে আদালত দুদকের আবেদন মঞ্জুর করেছেন।

এবার পবিত্র ঈদুল আজহার সময় মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে মুশফিকুর রহমান ১৫ লাখ টাকার একটি ছাগল কিনতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনায় আসেন।

ছেলের বিলাসী জীবনযাপনের সূত্র ধরেই মতিউরের সম্পদের বিষয়টি আলোচনায় আসে।
তবে ছাগলকাণ্ডের আগে গত ৪ জুন কমিশনের নিয়মিত বৈঠকে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সংস্থাটির উপপরিচালক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিমও গঠন করা হয়েছে।

এ ছাড়া গত দুই যুগে চারবার মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ পৃথকভাবে অনুসন্ধান করেছে দুদক।

প্রতিবারই তিনি দুদক থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে করা অভিযোগের কোনো তথ্য-প্রমাণ পায়নি দুদক। এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব জানিয়েছেন, চারটি পুরনো অভিযোগে অনুসন্ধান হয়েছিল। তবে এখন নতুন করে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা পুরনো কী কী অভিযোগে তিনি রেহাই পেয়েছিলেন, সেসব বিষয়ও খতিয়ে দেখবেন।

দুদক সূত্র জানায়, মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, জমি, ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা, ব্যাংকে নগদ অর্থ, মেয়াদি আমানতসহ সব কিছুই আছে তাঁর নামে। ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, বরিশালসহ বিভিন্ন জায়গায় মতিউরের নামে বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদ রয়েছে। তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকি বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান। এই দম্পতির মেয়ে ফারজানা রহমান ইস্পিতা এবং ছেলে তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা জমা রয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, মতিউর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে, মন্ত্রণালয়ের সচিব ও রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে অবাধে দুর্নীতি করেছেন। সব মিলিয়ে তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাঁর নামে-বেনামে ঢাকায় বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ৪০ কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। দুর্নীতিসংক্রান্ত ঝামেলা এড়ানোর জন্য স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনের নামে সম্পদ রেখেছেন তিনি। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকের ১ নম্বর রোডে পাঁচ কাঠা জমির ওপর সাততলা বাড়ি রয়েছে। এর মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা। বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় তিনি থাকেন। বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়া। ময়মনসিংহের ভালুকায় প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ওপর তাঁর রপ্তানিমুখী জুতার কারখানা রয়েছে। এর নাম গ্লোবাল শুজ। রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় মতিউরের রয়েছে বিপুল সম্পদ, প্লট ও বাগানবাড়ি। জেসিএক্স নামের একটি যৌথ ডেভেলপার কম্পানিতে তাঁর মালিকানা রয়েছে। গাজীপুর সদরের খিলগাঁও মৌজায় বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে তাঁর। রাজধানীর অদূরে সাভার থানার বিরুলিয়া মৌজায় আটটি খতিয়ানে ৬০ শতাংশ এবং একই মৌজায় স্ত্রীর নামে ১৪.০৩ শতাংশ জমি রয়েছে। গ্লোবাল শুজ কম্পানির নামে সাতটি খতিয়ানে ৬০ শতাংশ জমি রয়েছে। এর মূল্য প্রায় ৯০ কোটি টাকা। এ ছাড়া তাঁদের নামে বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে।

অন্যের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে যোগদান
এনবিআর সদস্য মতিউর রহমান একের পর এক পদ হারিয়ে টিকে আছেন শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে। এনবিআরের সদস্য পদ থেকে ওএসডি হওয়ার পর নির্দেশনা অনুযায়ী সেখানে যোগদানের কথা ছিল তাঁর। কিন্তু তিনি দেশ ছেড়ে গেছেন। এর পরও ওই বিভাগে মতিউর অন্যভাবে যোগদান করেছেন।

অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্তির পর মতিউর অন্য লোকের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছেন। এই বিভাগে মতিউরের জন্য আলাদা কোনো কক্ষ নেই। এমনকি তাঁর বসার জন্য কোনো চেয়ার-টেবিলও নেই। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করার পর তিনি মন্ত্রণালয়েও আসেননি। অন্য ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি যোগদানপত্র পাঠিয়ে যোগ দিয়েছেন।
সংস্থাপন বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জন্য ওএসডি করার বিধান আছে। এর বাইরে অন্য বিভাগ, সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের জন্য ওএসডির বদলে সংযুক্ত করার পদ্ধতি চালু আছে। মতিউর রহমানের ক্ষেত্রে সেটিই করা হয়েছে।

এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, মতিউর রহমান পদোন্নতি পেয়ে এনবিআরের সদস্য (কাস্টমস ও ভ্যাট) হয়েছেন। তিনি এখনো ওই পদেই আছেন। তবে তাঁকে যেহেতু অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে, সুতরাং তিনি এনবিআরের কোনো কাজ করতে পারবেন না। তাঁর কর্মক্ষেত্র হবে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা শুনেছি, মতিউর রহমান দেশের বাইরে চলে গেছেন। এ কারণেই হয়তো তিনি অন্যের মাধ্যমে যোগদানপত্র পাঠিয়ে যোগদান করেছেন।’

সোনালী ব্যাংকের নতুন পরিচালক আবু ইউসুফ
আলোচিত সরকারি কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর পরপরই নতুন পরিচালক হিসেবে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আবু ইউসুফকে তিন বছরের জন্য ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এক চিঠিতে নতুন পরিচালক নিয়োগের এই আদেশ দিয়েছে।
মতিউর রহমান সোনালী ব্যাংকের একজন পরিচালক ছিলেন। গত রবিবার অনুষ্ঠিত সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন না।

সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী পর্ষদসভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো পরিচালক নিয়োগ, স্থগিত বা বাতিল করার এখতিয়ার সরকারের। সরকারের কাছ থেকে নির্দেশনা এসেছে, উনি (মতিউর রহমান) আর আমাদের বোর্ডে উপস্থিত হবেন না, সভায় আসবেন না।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/06/25/1400199