১ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১১:০০

কাদের খান কেন এ পথে গেলেন?

আবদুল কাদের খান একজন চিকিৎসক, সাবেক সেনাকর্মকর্তা ও সাবেক সংসদ সদস্য। ক্ষমতাসীন মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টির নেতা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন গাইবান্ধা-১ আসন থেকে। একই আসনে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যার পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও অর্থ জোগানদাতা হিসেবে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, সাবেক এই সংসদ সদস্য হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। পুলিশের দাবি, এই আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য তিনি হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। পুলিশের ভাষ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে এটা স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণে এমপি হওয়ার জন্য কাদের খানের সামনে বর্তমান এমপিকে হত্যা করা ছাড়া আর কোনো পথ ছিল বলে তার কাছে মনে হয়নি। ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছিলেন না তিনি। ফলে প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দেয়ার জন্য খুনের পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু একজন সাবেক সংসদ সদস্য, যিনি আবার সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য মরিয়া; তিনি কেন আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন না? হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে উপনির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরিকল্পনা কেন করলেন? এসব প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির বাস্তবতার দিক।

বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতি ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বদলে গেছে। জনসমর্থনের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার দিন শেষ। এখন সংসদ সদস্য বা স্থানীয় সরকারে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দল বা মহাজোটের শরিকদের মনোনয়ন পেলেই চলে, ভোট পাওয়া না পাওয়া যেন মোটেই বিবেচ্য নয়। কারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন, তা নির্বাচনের আগেই নিশ্চিত হয়ে যায়। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে যে খুনোখুনি হচ্ছে তা ক্ষমতাসীন দল ও জোটের মধ্যেই হচ্ছে।

অব: কর্নেল আবদুল কাদের খান ২০০৮ সালের নির্বাচনে কিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন তা তিনি ভালোভাবেই জানেন। এলাকায় জাতীয় পার্টির নেতা হিসেবে তার কোনো পরিচিতি ছিল না। হঠাৎ করে নির্বাচনের আগে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তাকে জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্যপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন। এলাকায় অপরিচিত ব্যক্তি আবদুল কাদের খান লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে ভোট পেয়েছিলেন এক লাখ ছয় হাজার। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর মাওলানা আব্দুল আজিজ। সুন্দরগঞ্জ-১ আসনে ১৯৭৯ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাই বিজয়ী হয়ে আসছেন। এই আসনে আওয়ামী লীগের কোনো সময়েই শক্ত রাজনৈতিক অবস্থান ছিল না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সারা দেশের মতো গাইবান্ধা-১ আসনে মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন বিনা ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে আবদুল কাদের খানও অংশ নিয়েছিলেন। কাদের খানের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো রেকর্ড ছিল না। বগুড়ায় বসবাস করা একজন চিকিৎসক হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। অপর দিকে মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের বিরুদ্ধে আগে থেকেই সন্ত্রাস ও অসামাজিক কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হঠাৎ করে তার উত্থান ঘটে। সংসদ সদস্য হওয়ার পরও অপরাধমূলক কার্যক্রম কমেনি। এর মধ্যে মাতাল অবস্থায় এক শিশুকে গুলি করার ঘটনা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কার্যত তার ক্যাডার বাহিনীর হাতে শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী নয়, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তার দলের পৌরসভা চেয়ারম্যান তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।

লিটন হত্যার সাথে আবদুল কাদের খানের সম্পৃক্ততা উঠে আসে একটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ব্যবহৃত পিস্তলের ম্যাগাজিন উদ্ধারের সূত্র ধরে। অথচ গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর লিটন হত্যার পরপরই সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই ঘটনায় জামায়াতে ইসলামীর হাত আবিষ্কার করেছিলেন। গাইবান্ধা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া লিটনের নামাজে জানাজা শেষে বলেন, ‘অপরিণত বয়সে লিটনের মৃত্যু হয়েছে। এটি জামায়াত-শিবিরের চক্রান্ত। লিটন ছিলেন স্পষ্টভাষী। এ কারণে গাইবান্ধায় লিটন ছিলেন জামায়াত-শিবিরের আতঙ্ক। একসময় তারা চেষ্টা করেছিল তাদের নেতা গোলাম আযমকে সুন্দরগঞ্জে এনে জনসভা করার। কিন্তু এমপি লিটন সুন্দরগঞ্জের মাটিতে গোলাম আযমকে পা রাখতে দেননি। এটিই ছিল তার দোষ। আর অতীতের এই আক্রোশের কারণেই জামায়াত-শিবির লিটনকে হত্যা করেছে।’ (সমকাল ২ জানুয়ারি ২০১৭)। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, ফজলে রাব্বি মিয়াও একসময় জাতীয় পার্টির রাজনীতি করতেন। জামায়াত-শিবির নয়, বরং তার সাবেক দলের সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে বর্তমান দলের সংসদ সদস্যকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে।

লিটন হত্যার পর সুন্দরগঞ্জ ও আশপাশের এলাকা থেকে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির ১৫৫ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে স্কুলপড়–য়া ছাত্র থেকে ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ ব্যক্তিও রয়েছেন। যেহেতু এই এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর শক্ত অবস্থান আছে, সে কারণে কোনো প্রকার অনুসন্ধান ও তদন্ত ছাড়াই ক্ষমতাসীন দল ও গণমাধ্যম জামায়াতের সম্পৃক্ততার প্রচার চালাতে থাকে। মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের হত্যাকাণ্ডের সাথে প্রাথমিক পর্যায়ে তার স্ত্রী এবং স্ত্রীর ভাইয়ের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। তার বোনেরা বিভিন্ন সময় ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। এই ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন নেতাকেও আটক করা হয়। তার পরও বাংলাদেশের একচোখা গণমাধ্যমের দৃষ্টি ছিল, কিভাবে এ ঘটনার দায় জামায়াতের ওপর চাপানো যায়। শাসক শ্রেণী ও গণমাধ্যমের এই জামায়াত-শিবির ফোবিয়া রাজনীতি সংশ্লিষ্ট অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের পথ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।

জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্যকে গ্রেফতারের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা মিষ্টি বিতরণ করেছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। কাদের খান এখন ভয়ঙ্কর এক ভিলেনে পরিণত হয়েছেন। এমনকি তিনি জেএমবির সাথে জড়িত বলে খবর এসেছে। অথচ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের সংসদ সদস্য হিসেবে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন। আরো আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এই ঘটনার পর বহুরূপী রাজনীতিক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব রহুল আমিন হাওলাদার জানিয়েছেন, কাদের খানের সাথে এই দলের কোনো সম্পর্ক নেই। এরশাদ যেন কাদের খানকে চিনতেই পারছেন না। অথচ তিনিই তাকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন। সুন্দরগঞ্জে জাতীয় পার্টির অনেক পুরনো নেতা আছেন। তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তি আছেন যিনি আগে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের বাদ দিয়ে কেন ২০০৮ সালে বগুড়ায় বসবাসকারী ও রাজনীতির বাইরে থাকা ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়েছিল জাতীয় পার্টি? আজ যদি সত্যিই সংসদ সদস্য হওয়ার অভিলাষ থেকে কাদের খান এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকেন, তার দায় জাতীয় পার্টিকেও নিতে হবে। কারণ এই অভিলাষের বীজ বপন করেছিলেন স্বয়ং জাপাপ্রধান এরশাদ। তিনি তাকে হাত ধরে রাজনীতিতে এনেছেন। মনোনয়ন দিয়ে সংসদ সদস্য বানিয়েছেন।

প্রকৃতপক্ষে নষ্ট রাজনীতি কাদের খানকে এ পথে টেনে এনেছে। একজন সাবেক সেনাকর্মকর্তা ও চিকিৎসক রাজনীতিতে আসতেই পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভোটের রাজনীতির পথ ধ্বংস করা হয়েছে। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী আর বিশ্বাস রাখতে পারছেন না যে, আগামী নির্বাচনে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবে। কাদের খান হয়তো ভেবেছিলেন, লিটনকে আর কখনো সংসদ সদস্যের পদ থেকে সরানো যাবে না। কেন তিনি তা ভাবলেন? লিটন মোটেই এলাকায় খুব জনপ্রিয় ছিলেন না। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে বরং জাতীয় পার্টির প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ অপর শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতকে কোণঠাসা করা হয়েছে। দলটির নেতাকর্মীর বিরাট অংশ কারারুদ্ধ। অথচ জাতীয় পার্টির মনোনয়নের চেষ্টা না করে তিনি হত্যার ছক কষলেন।

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ যদি থাকত, তাহলে হয়তো এমন অপরাধের সাথে কাদের খান নিজেকে না-ও জড়াতেন, বরং তিনি জনসমর্থনের জন্য কাজ করতেন। রাজনীতিতে আরো বেশি সম্পৃক্ত হতেন। এতে রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভিত্তিও হয়তো শক্তিশালী হতো। ভোটের রাজনীতির বিলোপ আর মনোনয়ন কেনাবেচার খেলার কারণে প্রতিপক্ষকে যেকোনো উপায়ে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছেন হাইব্রিড রাজনীতিকেরা। এ ধরনের নেতা শুধু জাতীয় পার্টি তৈরি করছে না, আওয়ামী লীগেও এমন নেতার সংখ্যা কম নয়। গাইবান্ধা-১ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবার প্রার্থী দিয়েছে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে। তিনি ৩০ বছর ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, ত্যাগ কিংবা জনসমর্থন আওয়ামী লীগের এই নেতার চেয়ে নিশ্চয়ই বেশি নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ৩০ বছর উপজেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর একটি হত্যাকাণ্ডের কারণেই তিনি এবার নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেলেন। গাইবান্ধার আওয়ামী লীগে এমন লোক আরো আছেন, কিন্তু লিটনের মতো ব্যক্তিরাই এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। কাদের খান কিংবা লিটনের মতো নেতারা যদি ভোট ছাড়া সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ পান, তাহলে খুনোখুনির এমন ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া কমবে না। এমন পরিস্থিতি থেকে রাজনীতির উত্তরণ ঘটাতে হলে আগে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে পারবে, এমন আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। জনসমর্থন ছাড়া মনোনয়ন-বাণিজ্যের মাধ্যমে হাইব্রিড নেতা তৈরির কারখানা বন্ধ করতে হবে।