১ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১০:৫৮

ই-ভোটিং : নতুন করে পুরনো বিতর্ক

একটার পর একটা অহেতুক নয়া বিতর্ক জাতির সামনে হাজির করতে বর্তমান সরকার যেন অন্যরকম মজা পায়। এসব বিতর্ক সৃষ্টি করে জাতিকে ঠেলে দেয়া হয় বিভক্তি ও বিভাজনের মাঝে। আর এর ফলে জাতীয়ভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাধান ঐকমত্যের ভিত্তিতে করতে পারি না। এতে আমরা অপরিমেয় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ি। ইতঃপূর্বে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সূচিত নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা একতরফাভাবে বাতিল করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। এর পর জাতীয় ঐকমত্যভিত্তিক নতুন কোনো ব্যবস্থা না করে দলীয় সরকারের অধীনে প্রায় ভোটারবিহীন নির্বাচন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে ভঙ্গুরতা সৃষ্টি করা হয়েছে, গণতন্ত্রকে এর কোন তলানিতে নিয়ে নামানো হয়েছেÑ এর শেষ কোথায় তা আমরা এখনো জানি না। এ দিকে প্রায় সব মহলই মনে করে, সাংবিধানিক তাগিদ হচ্ছে একটি আইন প্রণয়ন করে নতুন নির্বাচন কমিশন করা। সেখানে তেমন কোনো আইন না করে এরই মধ্যে নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা হয়েছে। সরকারবিরোধীদের অভিযোগÑ সরকার যেমন চেয়েছে তেমনভাবেই নতুন নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিয়েছে। এর মাধ্যমে আগের মতোই সরকার আরেকটি বশংবদ নির্বাচন কমিশন গঠন করল।

এ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেন : ‘আমরা চাই পরবর্তীতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের লক্ষ্যে একটি উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা হোক। সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে এখন থেকেই সে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।’ প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আগে সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে সেই আইন প্রণয়নে বাধা ছিল কোথায়? আসলে সেই আইন প্রণয়ন না করে সরকার এর মাধ্যমে বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ বিতর্কিত করার পথটিই খোলা রাখল।

এ দিকে একই দিনে সংসদে দেয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচন প্রশ্নে যেন দেশে আরেকটি নতুন বিতর্কের সূচনা করলেন। প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন : ‘সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বর্তমানে বিরাজমান সব বিধিবিধানের সাথে সঙ্গতি রেখে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ই-ভোটিং চালু করার পরিকল্পনা বিবেচনা করা যেতে পারে।’

এই সময়টায় দেশের কোনো মহল, আগামী নির্বাচনে ই-ভোটিং চালুর আহ্বান কিংবা দাবি জানিয়েছে, তেমনটি আমাদের জানা নেই। ইতঃপূর্বে আমাদের দেশের জাতীয় নির্বাচনে ই-ভোটিং চালু করা না করা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, চলেছে নানা বিতর্ক। যার ফলে নির্বাচন কমিশনের ই-ভোটিং চালুর উদ্যোগ বাতিল করতে হয়। তবে সদ্যবিদায়ী রকীব কমিশন তার আমলে কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহার করে। ২০১৩ সালের ১৫ জুন রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় সেখানকার টিচার্স ট্রেনিং সেন্টারে ইভিএমে ভোট নেয়া হয়। কিন্তু সেখানে কিছু অভিযোগ উঠলেও ভোট পুনরায় গণনা করে দেখার সুযোগ ছিল না। এর পর থেকে কমিশন ইভিএম ব্যবহারে পিছু হঠে। ওই সময় নির্বাচন কমিশন ও বুয়েটের মধ্যে এই মেশিন ব্যবহার নিয়ে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। এ কারণেও ইভিএম ব্যবহার করার কাজ স্থগিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় গত বছরের জুলাইয়ে ইসি নিজেদের আইসিটি শাখার লোকবল দিয়ে ইভিএমের নতুন নমুনা ডিভিএম (ডিজিটাল ভোটিং মেশিন) নিয়ে আসে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসি এই ডিভিএম ব্যবহার করতে চায়। এ লক্ষ্যে ২০১৬ সালের অক্টোবরে সদ্যবিদায়ী কমিশন ১৯ জন প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে। ডিভিএম কেমন হবে, আগের ইভিএমের তুলনায় ডিভিএমে কতটা বেশি সুবিধা থাকবে, ভোটগ্রহণ প্রশ্নহীন হবে কি নাÑ সেসব ব্যাপারে মতামত দেবে এ কমিটি। এ কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি বলেছেন, বিভিন্ন দেশে যন্ত্রে ভোট নেয়া হচ্ছে। তবে, এ নিয়ে অভিযোগ আছে। চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও যন্ত্রে ভোট নেয়া এখনো সম্পূর্ণ নিরাপদ করা যায়নি। এখানে শুধু যন্ত্রের ব্যবহার হলে চলবে না, কাগজের ব্যবহারও রাখতে হবে।

জামিলুর রেজা চৌধুরীর বক্তব্যের মূল কথা হচ্ছে, আমাদের দেশসহ বিশ্বের কোথাও ই-ভোটিং ব্যবস্থা নিরাপদ করে তোলা যায়নি। ফলে কোনো দেশেই ই-ভোটিং নিশ্চিত নিরাপত্তা ও জনগণের আস্থা নিয়ে প্রতিষ্ঠা পেতে পারেনি। অনেক ই-ভোটিং ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ভোটিং যন্ত্র হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে, মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে এবং এ ব্যবস্থা বাতিলের ঘটনা ঘটেছে।

২০০০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্লোরিডায় পুনরায় ভোট গণনার বিতর্ক একটি বহুল আলোচিত ঘটনা। পাঞ্চকার্ড ব্যালট নিয়ে চলে এ বিতর্ক। বিশেষ করে তখন বিতর্ক চলে অসম্পূর্ণভাবে পাঞ্চ করা কার্ড নিয়ে। এর পরও ২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কিছু অঙ্গরাজ্যে ব্যাপকভাবে পাঞ্চকার্ডের ব্যবহার চলে। ওহাইওর বেশির ভাগ ভোটার ব্যবহার করেন পাঞ্চকার্ড ব্যালট। তখন ফ্লোরিডার নির্বাচনে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ব্যালটের হার ছিল : পাঞ্চকার্ড ২২.৩ শতাংশ, লিভার মেশিন ১৪.৭, কাগজের ব্যালট ১.৭ শতাংশ, অপটিক্যাল স্ক্যান ২৯.৬ শতাংশ, ইলেকট্রনিক ভোটিং ২২.১ শতাংশ এবং মিশ্র প্রকৃতির ব্যালট ৯.৬ শতাংশ।

২০০৪ সালের আগেই ই-ভোটিং মেশিনের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার নিয়ে সেখানে নানা সমস্যা দেখা দেয়। প্রথম সমালোচনা আসে ই-ভোটিং মেশিনের নিরাপত্তা নিয়ে। বলা হয়, নিরাপত্তার বিষয়টি যথাযথ পরীক্ষা ছাড়াই ই-ভোটিং মেশিন ব্যবহারের ফলে ভোটের সঠিক গণনা বিঘিœত হতে পারে। ভোটিং মেশিন মাঝপথে খারাপ হলে পুরো নির্বাচনই অচল হয়ে যেতে পারে কিংবা বিলম্বিত হতে পারে। ইচ্ছাকৃতভাবে ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটতে পারে। এর পরে আসে রিকাউন্টের বিষয়টি। বলা হয়, ভোটিং মেশিন রিকাউন্টে থাকা উচিত হার্ডওয়্যার ও সফটওয়ার অডিটিং এবং মাল্টিপল ভোটার রেকর্ড তুলনার ব্যবস্থা। তখন ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট প্রশাসন আদেশ জারি করে বলে এর ১৫ হাজার ডাইবোল্ড ভোটিং মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। কারণ, এগুলোতে এমন কিছু ত্রুটি ছিল, যা সরবরাহকারী কোম্পানি প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ‘গভর্নমেন্ট অ্যাকাউন্টেবিলিটি অফিস’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে উল্লেখ করেÑ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন নির্বাচনী প্রক্রিয়া উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিশীল, তবে এখনো এর নিরাপত্তা ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে আছে সংশয়। এই প্রতিবেদনে ইলেকট্রনিক ভোটিংসংশ্লিষ্ট ঘটে যাওয়া নানা সমস্যার বিস্তারিত বিবরণও তুলে ধরা হয়।

ওহাইওর হার্ভে ওয়াসারম্যান বরাবর ছিলেন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের প্রবল সমালোচক। তিনি ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড ইন ওহাইও : অ্যা ডকুমেন্টারি রেকর্ড অব থেফট অ্যান্ড ফ্রড ইন দ্য ২০০৪ ইলেকশন’ বইয়ের একজন সহ-লেখক। তার ‘দ্য স্ট্রিপ অ্যান্ড ফ্লিপ সিলেকশন অব ২০১৬ ইলেকশন : ফাইভ জিম ক্রোজ অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইলেকশন থেফট’ বইটি এখন প্রকাশের অপেক্ষায়। তার সুস্পষ্ট বক্তব্য : ‘২০০৪ সালের নির্বাচনে ই-ভোটিং মেশিন ব্যবহারের মাধমে ওহাইওতে ভোট চুরি করে জর্জ বুশ যথার্থ বিজয়ী জন কেরিকে পরাজিত করেন। তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট জে. কেনেথ ব্ল্যাকওয়েল এবং গভর্নর রবার্ট টাফট তাদের অপব্যবহার করেন ইলেকট্রনিক ভোট কাউন্ট জর্জ বুশের পক্ষে নেয়ার জন্য।’ কী করে তিনি যা জানলেন, তার বর্ণনা তিনি গণমাধ্যমে দিয়েছেন এবং তা তার বইয়েও আছে। আর ২০১৬ সালের নির্বাচনে ই-ভোটিং সম্পর্কিত জালজালিয়াতির খবর নিশ্চয় পাওয়া যাবে তার উল্লিখিত প্রকাশিতব্য বইটিতে। তবে তিনি এ নির্বাচনের আগেই গণমাধ্যমে বলেছেনÑ ২০১৬ সালের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ৮০ শতাংশ ভোটার ই-ভোটিং মেশিন ব্যবহার করবে। আর ছয়টি মুখ্য রাজ্যেÑ ফ্লোরিডা, নর্থ ক্যারোলিনা, ওহাইও, মিশিগান, আইওয়া ও অ্যারিজোনায়Ñ কোনো ভেরিফাইয়েবিলিটি নেই। সেখানে ভোট কাউন্টিং ভেরিফাই করার সুযোগ ছিল না। তখন তিনি বলেছিলেন মাত্র ৬০ সেকেন্ডে ভোট কাউন্টিং পাল্টে যেতে পারে। আর এখন আমরা শুনছি ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-সম্পর্কিত ই-ভোট জালিয়াতির নানা কথা। শুনছি সে জালিয়াতিতে রাশিয়ার পুতিনের সম্পৃক্তার অভিযোগও।

পাশের দেশ ভারতে দেশব্যাপী নির্বাচনের জন্য কাগজবিহীন সরাসরি রেকর্ড করার ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থা চালু করে। এর আগে কিছু ভারতীয় কম্পিউটার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেন, এই ভোটিং মেশিনের তথা ইলেকট্রনিক ভোট প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত কিছু দুর্বলতার কথা এবং এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন বেশ ক’জন সাংবাদিক ও প্রার্থী। তারা বলেন, ভারতে সূচিত এই ভোটিং ব্যবস্থা ভঙ্গুরতার ঊর্ধ্বে নয় এবং সহজেই তা মেশিন-বাই-মেশিনের আক্রমণের শিকার হতে পারে। ২০১০ সালের নির্বাচনে ব্যবহারের কিছু ভোটযন্ত্র নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের কাছে দেয়া হয়। এর পর বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই ইলেকট্রনিক ভোটযন্ত্র ‘ভালনারেবল টু আনডিটেকটেবল মেনিপুলেশন’। সোজা কথা, এই ভোটযন্ত্র দিয়ে ভোট জালিয়াতি সহজেই চলতে পারে। ২০১০ সালের ১২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু আন্তর্জাতিক প্রযুক্তিবিদ ভারতের ‘ভোটিং টেকনোলজি ওয়ার্কশপ’-এর ভোটিং মেশিন প্যানেলে যোগ দেন। এরা এদের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেন ‘ইলেকটোরাল কমিশন অব ইন্ডিয়া’র কাছে। এ চিঠিতে এরা উপসংহার টানেন এভাবে : India’s voting machines do not provide “security, verifiability and transparency adequate for confidence in election results.”

এভাবে অন্য আরো অনেক দেশেই রয়েছ ই-ভোটিং নিয়ে এ ধরনের বিতর্ক। আমাদের দেশেও এ নিয়ে আছে প্রবল বিতর্ক। এর মাঝেও কেন পুরনো এ বিতর্ক প্রধানমন্ত্রী নতুন করে করতে গেলেন, তা অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়, তবে নানা সংশয়ের কারণ। সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচন প্রশ্নে আমরা নতুন যাই করি, যে ব্যবস্থাই চালু করি তা যেন জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়Ñ সেটাই সবার কামনা। নইলে জাতীয়পর্যায়ে বিভাজন আরো সম্প্রসারিত হবে, অহেতুক ঝামেলা বাড়বে। আর এই মতানৈক্য কখনো কখনো জাতীয় সঙ্কটের জন্ম দেয়। যার পরিণাম শুধু ক্ষতি আর ক্ষতি, লাভের খাতা শূন্য। যেখানে আমরা এখন পর্যন্ত একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন সৃষ্টি করতে পারিনি, যেখানে পারস্পরিক আস্থার অভাব পাহাড়সম, সেখানে ই-ভোটিংয়ের বিরোধিতাই স্বাভাবিক। কারণ ই-ভোটিং আজ পর্যন্ত বিশ্বের কোথাও আস্থার কোনো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেনি। কার্যত আমাদের দেশে ই-ভোটিংয়ের বিরোধিতা প্রবল। ক্ষমতাসীনদের বাইরের সবার মতামত কার্যত ই-ভোটিংয়ের বিরুদ্ধেই।

প্রধানমন্ত্রী চান, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ই-ভোটিং চালু হোকÑ তার সাম্প্রতিক এমন বক্তব্যের পর এরই মধ্যে আমরা দেখতে পেয়েছি, সরকারের বাইরে দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি ই-ভোটিং চালুর বিরুদ্ধে দলটির সুস্পষ্ট অবস্থান ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক বক্তব্য-উত্তর সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচনে ই-ভোটিং চালু করার চিন্তা বা পরিকল্পনার বিরোধিতা করছে। দলটি বলছে, এতে সরকার পক্ষের দুরভিসন্ধি আছে। এই পদ্ধতি চালু হলে সরকারের পক্ষে ভোট কারসাজি করা সহজ হবে। সংবাদ সম্মেলনে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ই-ভোটিং করার যে কথা বলেছেন, এটি সরকারের ভোটারবিহীন নির্বাচন করার আরেকটি ডিজিটাল প্রতারণা কি না, তা নিয়ে জনমনে ব্যাপক সংশয় দেখা দিয়েছে। আমরা মনি করি, তার ঘোষণা জনগণকে আরেকটি তামাশার বায়োস্কোপ দেখানো ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এটি জনগণের ভোটকে নিজের উদ্দেশ্য সাধনে জালিয়াতি করার প্রচেষ্টামাত্র। রিজভী বলেন, ‘ভারত জার্মানি, সুইজারল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে ই-ভোটিং চালু করলেও এর বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং তা বন্ধ করে দেয়া হয়। এই পদ্ধতিতে দূর থেকেই হ্যাক সরা সম্ভব বলে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তা বাতিল করা হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনো অনেক মানুষ নিরক্ষর। এত টেকনিক্যাল বিষয় বোঝা তাদের জন্য দুঃসাধ্য। এই পদ্ধতিতে ই-ভোটিংয়ের সার্ভার সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সুতরাং সরকারের জন্য ভোট কারসাজি করা খুবই সহজ হবে।’ বিএনপি’র এই অবস্থান নিশ্চিতভাবে ই-ভোটিং চালু প্রশ্নে জাতীয় বিভাজনেরই ইঙ্গিতবহ। আগামী নির্বাচনে ই-ভোটিং চালু হলে তাই রাজনৈতিক সমস্যা আরো বাড়বে বলেই মনে হয়। অতএব সরকারের উচিত হবে সে পথে না হাঁটা। এর পরও সরকার যদি জোরজবরদস্তি করে একতরফাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের মতো ই-ভোটিং একতরফাভাবে চালু করে, তবে সামনে জাতির জন্য অপেক্ষা করছে আরো দুর্ভোগ। নির্বাচন সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা একতরফাভাবে বাতিল করে যে দুর্ভোগের সৃষ্টি করা হয়েছিল, তার ক্ষতই এখনো শুকায়নি। অতএব সাধু সাবধান!

এক সময় মানুষ গাছে দাগ কেটে ভোট দিয়েছে। এর পর কার্ডবাক্সে ফেলে ভোট দিয়েছে। এর পর এসেছে কাগজের ব্যালট। প্রযুক্তি প্রসারের হাত ধরে সবশেষে এসেছে আজকের দিনের ই-ভোটিং ব্যবস্থা। তবে সুষ্ঠু ভোটের মৌলনীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি : প্রতি ভোটারের জন্য একটি ভোট নিশ্চিত করা, কোন ভোটার কাকে ভোট দিলেন তা গোপন রাখা, ভোটের যথার্থতা রক্ষা করা, ভোটব্যবস্থা নিরাপদ করা এবং সর্বোপরি ভোট জালিয়াতি বন্ধ করা। আর সমস্যাটা নিহিত এখানেই। যারা ই-ভোটিংয়ের বিরোধিতা করেন, তাদের যুক্তি হচ্ছেÑ ভোটের এসব মৌলনীতি ই-ভোটিং ব্যবস্থায় রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাদের যুক্তিতে আছে ই-ভোটিংয়ের বিরুদ্ধে তিন ধরনের অভিযোগ : ই-ভোটিং টেকনোলজি নির্ভরশীল নয়, এ ভোটব্যবস্থায় ব্যাপক ভোট জালিয়াতির সম্ভাবনা আছে, ভোটার ও ভোটের নিরাপত্তা নিয়ে আছে সংশয়। কারণ, যন্ত্র মানুষের দাস। ই-ভোটিং যন্ত্র যেভাবে মানুষ চালাবে, সেভাবেই চলবে। যুক্তিগুলো যে ফেল না নয়, তা আমরা বিভিন্ন দেশে ই-ভোটিংয়ের অভিজ্ঞতা থেকে এরই মধ্যে জেনেছি। এর পরও কেউ কেউ, বিশেষত ক্ষমতাসীন দল ই-ভোটিং চালুর পক্ষে থাকে। তাদের যুক্তি একটাইÑ স্বল্প সময়ে ভোট সম্পন্ন করা যায়। আর কাগজের ব্যালট ও ব্যালটবাক্স না থাকায় এগুলো ছিনতাই হওয়ার ভয় থাকবে না। বাস্তবে এগুলো খোঁড়া যুক্তি। কারণ, ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স ছিনতাই করতে যারা জানে, তারা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনও ছিনতাই করতে পারবে।