১ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১০:৫০

গণতন্ত্রে কেন স্বৈরতন্ত্রের আওয়াজ

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : এই মুহূর্তে দুনিয়ায় তিন প্রধান পরীক্ষিত গণতন্ত্রের দেশ যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ভারত। কিন্তু লক্ষণীয় যে, এই তিন দেশেই বলতে গেলে স্বৈরতন্ত্রের তীব্র আওয়াজ উঠেছে। গত জানুয়ারিতে জার্মানির একটি সাংবিধানিক আদালত নয়া-নাৎসীদের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে একটি চরম দক্ষিণপন্থী দলকে নিষিদ্ধ করার আবেদন বাতিল করে দিয়েছেন।

আদালত বলেছেন, এই দল দেশের গণতন্ত্রের জন্য কার্যকর কোনো হুমকি নয়। জার্মানির ১৬টি রাজ্যে এই চরম দক্ষিণপন্থী দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির অস্তিত্ব রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র বলেছে, এরা চরম বর্ণবাদী ও ইহুদীবিরোধী। কিন্তু জার্মানিতে এদের শক্তি ক্রমেই বাড়ছে। জার্মানির আদালতের এই রায়ের পরদিন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক রিপোর্টেও এ সম্পর্কে উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। তাতেও বলা হয়েছে, এই দল নিজেদের জার্মানির জন্য বিকল্প শক্তি (এএফডি) মনে করে। তারা বর্ণবাদী এবং চরম উদ্বাস্তু ও অভিবাসীবিরোধী।

জার্মানির চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলেরও এরা ঘোর বিরোধী। মার্কেলের উদ্বাস্তু নীতির বিরুদ্ধে গত দুই বছর ধরে এরা চরম বিষোদগার করে যাচ্ছেন। আরও উদ্বেগজনক হলো, সেখানকার জাতীয় নির্বাচন আর কয়েক মাস পরেই অনুষ্ঠিত হবে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, সে নির্বাচনে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি তথা এএফডি’র জনপ্রিয়তা রয়েছে মোটামুটি ১৫ শতাংশ। মার্কেলের ব্যক্তিগত আকর্ষণ, চিন্তাশীলতা ও দক্ষ রাজনীতির কারণে সেখানে সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্র ভালোভাবেই বহাল রয়েছে।

কিন্তু যদি চরমপন্থী ঐ দল জাতীয় সংসদের ১৫ শতাংশ আসন পায় তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে বাধ্য। ১৯৯৭ সালে বিখ্যাত কলামিস্ট ফরিদ জাকারিয়া ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ পত্রিকায় লিখেছিলেন যে, পেরু থেকে প্যালেস্টাইন, সিয়েরা লিওন থেকে স্লোভাকিয়া, পাকিস্তান থেকে ফিলিপিনস্ সর্বত্রই রাজনীতিতে একটি অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে। এসব জায়গায় গণতন্ত্র অসহিষ্ণু। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, এ অসহিষ্ণু অবস্থা থেকে চরম বর্ণবাদী ও ফ্যাসিবাদীরা এক সময় নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেন। সে আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, তা এখন প্রমাণিত হচ্ছে। গত এক বছরে দেখা যাচ্ছে ভারত, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র এই তিন স্থিতিশীল গণতন্ত্রে অনুদারতা ক্রমেই স্থান লাভ করে নিচ্ছে।

২০১৪ সালে ভারতের চটকদার নেতা নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এই দল ভারতে চরম হিন্দু জাতীয়তাবাদকে তাদের নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। ফলে তারা গরুর গোস্ত খাওয়া প্রায় নিষিদ্ধ করে ফেলেছে। এই অভিযোগ তুলে তারা ইতিমধ্যে অনেককে হত্যাও করেছে। হিন্দি ভাষার প্রাধান্য বিস্তার করেছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করেছে এবং তাদের এসব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য অভদ্র ভাষা ব্যবহার করছে এবং এমন কথা বলছে- যারা এসব মানতে পারবে না ‘তারা পাকিস্তান চলে যাও’। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর এমন কথা খুব একটা শোনা যায়নি। এর মাধ্যমে ভারতের সংবিধান রচয়িতাদের মূল আদর্শ থেকে মোদী অনেক দূরে সরে গিয়েছেন। মোদী সরকার ভারতের নিজস্ব শক্তির বদলে বিদেশের বড় ব্যবসায়ী শক্তিকে অধিকতর আপন করে নিয়েছে।

গত নভেম্বরে জনগণের ভোটে পিছিয়ে থাকলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প ইলেক্টরাল কলেজ ভোটে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলেন- তখন খানিকটা বিস্ময়ের সৃষ্টি হচ্ছিল। এর ভেতর দিয়ে যেন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শনের একটা মহড়া হয়ে গেল। মার্কিন নাগরিকরা তাদের পৌরুষ দেখাতে চাইল। অভিবাসী ও সংখ্যালঘুদের উপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল। যৌনতা যেন অনেকখানি স্থান দখল করে ফেলল। সফল ব্যবসায়ী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদনশীল কাজে শুধুমাত্র মূল মার্কিনিরাই টিকে থাকবে। অভিবাসীরা বিদায় নাও। তারা বাইরের পণ্যের উপরও আর নির্ভর করবে না। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং ভারতে সাংবিধানিক গণতন্ত্র রয়েছে। এ দেশসমূহের আদালতগুলো যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করেন এবং জনগণও আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। জার্মানি তার মৌলিক আইনগুলো গ্রহণ করে ১৯৪৯ সালে, ভারতে সেগুলো গৃহীত হয় ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে। জার্মানির সাংবিধানিক মূল্যবোধে রয়েছে সাম্য, জীবন ও মর্যাদার নিরাপত্তা। কিন্তু সম্প্রতি নানা কারণে বড় বড় নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। ভারতের সংবিধানে সংবিধান প্রণেতারা দেশ বিভাগকালের স্মৃতিকে মনে না রেখে সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকে সেটি প্রণয়ন করেছিলেন। সেখানে তারা সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার একটা ব্যবস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসে সে স্থিতিশীলতা ইতিমধ্যেই অনেকখানি নষ্ট করে ফেলেছেন।

আমেরিকার সংবিধান সেদিক থেকে কিছুটা রক্ষণশীল ছিল। প্রাথমিকভাবে সংবিধান প্রণেতারা তুলনামূলকভাবে কম উদার ছিলেন। ১৭৮৯ সালে সেখানে সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। সেটি প্রথমে তৈরি করা হয়েছিল সাদা মানুষদের কল্যাণের কথা চিন্তা করে। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে একদিন তাতে সংশোধন আনতে হয় এবং সেখানে নারী, আমেরিকান-আফ্রিকানসহ সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়। এখন দেখা যাচ্ছে এই তিন দেশই তাদের মূল লক্ষ্য অর্জনে নানাভাবে ব্যর্থ হয়ে চলেছে। সেখানে সমান সম্মান, সহনশীলতা ও মর্যাদা সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। যদিও আদালত সে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এর আংশিক কারণ হলো এই যে, রাজনীতিতে আইনজীবী-রাজনীতিকের অভাব ঘটেছে। জওয়াহেরলাল নেহরু কিংবা সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল- এরা খ্যাতিমান আইনজীবী ছিলেন। তারা সংবিধানের আইনগত দিক এবং এর পরিণতিতে ভবিষ্যতে কী দাঁড়াতে পারে সে বিষয়ে সম্যক অবহিত ছিলেন। ফলে নেহ্রুর আমলে যে সহনশীলতার নীতি চর্চার চেষ্টা হয়েছে, এখন তা ক্ষয়িষ্ণু।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মেয়াদের শেষ দিকে সেখানেও ক্ষয় ঘটতে শুরু করে। বারাক ওবামাও পেশায় একজন আইনজীবী ছিলেন। ফলে তিনি দৃঢ়ভাবে উদার নীতিকে আঁকড়ে ছিলেন। কিন্তু সংবিধানবিদ রাজনীতিকের অভাবে এখন দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত অধঃপতন ঘটতে শুরু করেছে। জাতীয় রাজনীতি থেকে উদার নৈতিকতার আদর্শ বিলুপ্তির পথে। তবে এর কিছু দায় দেশের আইনজীবী এবং আইনের শিক্ষাবিদদের উপর বর্তায়। তারা ধারাবাহিকভাবে জনগণকে উদারনৈতিকতার মনোভাবে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পারেননি। ফলে নীতি-নৈতিকতা থেকে সমাজ ধীরে ধীরে সরে গেছে। আমরা এমন সব ফোরামে এমন সব কাজ করি, যাতে জনগণের আশা- আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে না। ফলে স্বাভাবিক উদার পন্থার প্রতি অধিকাংশ মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে।

আদালতের ভেতরে কী হচ্ছে না হচ্ছে, কিংবা উচ্চ মার্গের আইন সাময়িকীতে কী জ্ঞানগর্ভ রচনা প্রকাশিত হচ্ছে জনগণ তার কোনো খবর রাখে না। কিন্তু আদালতের সিদ্ধান্ত যখন তাদের কাঁধের ওপর গিয়ে পড়ে, তখন তা মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে তাদের মনে প্রতিবাদের ঢেউ খেলে যায়। যার পরিণতিতে আমরা না চাইলেও সমাজের মননে ভিন্ন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অনেক সময় অপরিণামদর্শী রাজনীতিকদের চটকদারিত্বের কারণে তা চরম পন্থায় রূপ নেয়। এর সবকিছু সব সময় প্রচলিত সরল রেখায় প্রবাহিত নাও হতে পারে। এদিকে আবার যারা এ সব বিষয়ে আইনি চিন্তা করেন, তারা সাধারণত জনপ্রিয় যেসব পত্রিকা, সেগুলোতে সে ভাষায় লেখেন না। ভারতে যারা আইন নিয়ে চিন্তা করেন, তারা সাধারণত

ইংরেজিতে উচ্চ মার্গের পত্রিকাগুলোতে লেখেন। হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলেগু, মারাঠী এ সব ভাষায় লেখেন না। ফলে খুব গুরুত্বপূর্ণ জনসম্পৃক্ত বিষয়ে তাদের লেখাগুলো সাধারণ মানুষ পড়ার সুযোগ পায় না। সুযোগ পায় না চিন্তা করারও। এর ফলে জনসাধারণ নরেন্দ্র মোদীর মতো রাজনীতিকদের চটকদার কথা বা ট্রাম্পের মতো জুয়াড়িদের স্বৈরতান্ত্রিকতার দিকে বেশি আকৃষ্ট হন। আর সে কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন ভ্রষ্ট লোক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পেরেছেন। নরেন্দ্র মোদী সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছেন। আর ট্রাম্প ছড়াচ্ছেন বর্ণবাদের বিষ। জার্মানিতে এএফডি ১৫ শতাংশ জনসমর্থন অর্জন করে ফেলেছে।

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ভাষা ইংরেজি। তারা স্বাধীন এবং অনেক জনসম্পৃক্ত বিষয়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়ে থাকেন। এগুলোর কখনও অনুবাদ হয় না। পত্রিকাগুলো শুধু সংবাদ প্রকাশের জন্য যেটুকু দরকার, সেটুকুই অনুবাদ করে ছেপে দেয়। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণ অন্ধকারেই থেকে যায়। তারা জানতে পারেন না, ভারতের প্রতিষ্ঠাতারা সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে কী কী ভেবেছিলেন। ফলে জনগণ চটকদার জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের খপ্পরে পড়ে। এসব রাজনীতিকের সাংবিধানিক মূল্যবোধ সম্পর্কে কোনো ধারণা বা আগ্রহই নেই। এ বিষয়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানেকা গুরুস্বামী লিখেছেন, ভারতকে সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে চিন্তা ও তা সংবিধানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে গিয়েছিলেন অন্যান্যের মধ্যে আইনজ্ঞ জওয়াহেরলাল নেহ্রু, বল্লভ ভাই প্যাটেল, বিআর আম্বেদকার, সি রাজা গোপালচারিয়া, রাজেন্দ্র প্রসাদ ও বিএন রাও। কিন্তু সেই সাংবিধানিক ধারা নরেন্দ্র মোদী অর্থহীন করে তুলেছেন। জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সময়ই বলবে, চটকদার অসাংবিধানিক দানবীয় রাজনীতির চ্যালেঞ্জ কীভাবে তাদের উদারনৈতিক সংবিধান-বিশেষজ্ঞরা মোকাবিলা করেবেন।