২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, ১:১০

বেসামাল প্রশাসনে এক পদে ১৩ জনও

সচিবকে সহায়তা করার জন্য বড় অঙ্কের বাজেট বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়ে একটি করে অতিরিক্ত সচিবের পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু সেই পদ আর একটিতে সীমাবদ্ধ নেই; প্রায় সব মন্ত্রণালয়েই একাধিক অতিরিক্ত সচিব কাজ করছেন। কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ে এই সংখ্যা এক ডজন পার হয়েছে। শুধু অতিরিক্ত সচিবই নন, কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ে একাধিক সচিবও নিয়োগ পাচ্ছেন। সাংগঠনিক কাঠামোর চেয়ে বেশি যুগ্ম সচিব ও উপসচিব কাজ করছেন অনেক আগে থেকেই। পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি দিয়ে প্রশাসনের বেসামাল অবস্থা ফুটে ওঠে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বর্তমানে ১৩ জন অতিরিক্ত সচিব কাজ করছেন। সরদার আবুল কালাম আজাদ সবচেয়ে সিনিয়র অতিরিক্ত সচিব। তাঁর পরই আছেন রোকসানা কাদের। তিনি জনস্বাস্থ্য ও বিশ্ব স্বাস্থ্য অনুবিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন। অডিট ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা দেখছেন মো. নজরুল ইসলাম। হারুন উর রশিদ খান দেখেন উন্নয়নসংক্রান্ত সেল। মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন দেখেন ফয়েজ আহমদ। হাসপাতালের বিষয়গুলো দেখভাল করেন হাবিবুর রহমান খান। শৃঙ্খলা ও নার্সিং অনুবিভাগ দেখছেন সুভাষ চন্দ্র সরকার। পরিবারকল্যাণ দেখেন কাজী এ কে এম মহিউল ইসলাম। বদরুন নেসা দেখছেন চিকিৎসা-শিক্ষা। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট দেখছেন মো. আসাদুল ইসলাম। এর বাইরেও তিনজন অতিরিক্ত সচিব রয়েছেন মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দপ্তরে। তাঁরা হলেন রওনক জাহান, শেখ মো. শামীম ইকবাল ও শহীদুল হক।

স্থানীয় সরকার বিভাগে কাজ করছেন আটজন অতিরিক্ত সচিব। তাঁদের মধ্যে ইকরামুল হক সার্বিক বিষয় দেখেন। এ এস এম মাহবুবুল আলম দেখেন পরিবীক্ষণ, পরিদর্শন ও মূল্যায়ন ইউনিটের কাজ। সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী দেখেন প্রশাসন অনুবিভাগ। পানি সরবরাহ অনুবিভাগ দেখেন নাসরিন আখতার। উন্নয়ন অনুবিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন মো. রইছ উদ্দিন। নগর উন্নয়ন অনুবিভাগের দায়িত্ব পালন করেন মো. মাহবুব হোসেন। এ বি এম আরশাদ হোসেন পরিচালক-২-এর দায়িত্বে রয়েছেন। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগে যোগ দিয়েছেন আখতারুজ্জামান খান কবীর। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, কম বাজেট বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়গুলোর অন্যতম হচ্ছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। কয়েক বছর আগেও এই মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিবের কোনো পদই ছিল না। সচিব কোনো কারণে দেশের বাইরে থাকলে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ

বৈঠকগুলোতে যোগ দিতেন যুগ্ম সচিব। সেই মন্ত্রণালয়ে আজ চারজন অতিরিক্ত সচিব দায়িত্ব পালন করেন। আবুল হাসনাত মো. জিয়াউল হক বিমান ও সিভিল এভিয়েশন সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখেন। প্রশাসন ও পর্যটনের দায়িত্বে রয়েছেন মো. ইমরান। হোটেল-রেস্তোরাঁ সেলের দায়িত্ব পালন করছেন মো. শাহাদৎ হোসেন। আর জ্যোতির্ময় বর্মণের দায়িত্বে রয়েছে প্রশাসন।

জনপ্রশাসনসচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, কয়েকটি বড় ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিজীবনের শেষ পর্যায়ে রয়েছেন। এসব ব্যাচের কর্মকর্তারা অবসরে গেলে প্রশাসন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

একজন সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রশাসন যে কতটা বেসামাল, তা বোঝা যায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ১৩ জন অতিরিক্ত সচিবকে দেখে। অথচ অতিরিক্ত সচিবের পদ সৃষ্টি হয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো বড় বাজেট বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়গুলোতে সচিবকে সহায়তা করার জন্য। সচিবের নেতৃত্বে যুগ্ম সচিবরাই মূলত মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেন। অতিরিক্ত সচিবের কাজ ছিল সচিবকে বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা করা। এখন পরিস্থিতি উল্টে গেছে। পদের চেয়ে বেশি পদোন্নতি দিতে গিয়ে প্রশাসনে বেসামাল অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের সময় এ ঘটনার সূত্রপাত হয়নি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন একসঙ্গে ২৪ জনকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। অথচ তখন পদ খালি ছিল মাত্র আটটি। অন্যদের কেন পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে প্রশাসন বেশ উত্তপ্ত ছিল। পরে এক সভায় তিনি বলেছিলেন, চাপের কারণে একসঙ্গে পদোন্নতি দিতে হয়েছিল। ওই সাবেক সচিব আরো বলেন, তখনো যদি চাপ থাকে, এখন সেই চাপ অনেক বেশি। এ কারণেই মন্ত্রণালয়গুলোতেও ভিন্ন ভিন্ন নামে একাধিক সচিবকে দেখা যাচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদসচিব থাকার পরও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ‘সচিব, সমন্বয় ও সংস্কার’ নামে সচিবের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও একাধিক সচিব কাজ করছেন। অনেকে আবার সচিব পদমর্যাদা ভোগ করছেন।

বর্তমান মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সচিব সমন্বয় ও সংস্কার পদে রয়েছেন এন এম জিয়াউল আলম। পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক ছাড়াও দুজন সচিব রয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তাঁরা হচ্ছেন মো. খোরশেদ আলম ও মো. কামরুল আহসান।

সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের একজন সাবেক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সেক্রেটারিয়েট ক্যাডার অ্যাডমিন ক্যাডারের (প্রশাসন ক্যাডার) সঙ্গে মিলে যাওয়ার পর প্রশাসনের ব্যালান্স নষ্ট হয়ে গেছে। আগে অ্যাডমিন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিয়ম ভেঙে একটা কিছু করতে গেলে সেক্রেটারিয়েট ক্যাডারের কর্মকর্তারা বাধা দিতেন। এতে প্রশাসন নিজস্ব পদ্ধতিতেই চলত। সরকার পদ না থাকার পরও অ্যাডমিন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিচ্ছে। কিন্তু আরো যে ২৬টি ক্যাডার রয়েছে, সেখানে দিচ্ছে না। নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতিও আটকে যায় পদ না থাকার কারণে। এই কর্মকর্তাদের পদোন্নতি আটকে দেওয়ার পর তাঁরা যে প্রতিক্রিয়া দেখান, সেটা উল্লেখ করার মতো। তাঁরা প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অ্যাডমিন ক্যাডারের বেলায় পদোন্নতি দিতে পদ লাগে না, কিন্তু নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে শূন্য পদ ছাড়া হয় না! আসলে এক জায়গায় অনিয়ম করতে গেলে তার প্রভাব নানা জায়গায় পড়ে।

এমন অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন, যাঁরা উপসচিব হিসেবে যে রুমে বসে যে দায়িত্ব পালন করেছেন, পদোন্নতির পর যুগ্ম সচিব হয়েও একই রুমে বসে একই দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পরের দফায় পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিবও হয়েছেন; কিন্তু রুম বদল হয় না, কাজও একই থাকে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যে রুমে বসে অতিরিক্ত সচিবরা দায়িত্ব পালন করছেন, একসময় সেসব রুমে বসেছেন সিনিয়র সহকারী সচিবরা।

প্রশাসনের চার স্তরে মঞ্জুরীকৃত এক হাজার ৬১৬ পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন প্রায় দ্বিগুণ কর্মকর্তা। অন্যদিকে সিনিয়র সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব স্তরে এক হাজারের বেশি পদ খালি রয়েছে। এতে ভেঙে পড়েছে প্রশাসনের পিরামিড কাঠামো। মঞ্জুরীকৃত পদ না থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন সিনিয়রদের ডিঙিয়ে জুনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। পদোন্নতিপ্রাপ্তদের আগের পদেই পদায়ন অথবা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তি এবং অন্যত্র প্রেষণ অথবা ওএসডি করে রাখা হচ্ছে। কারণ তাঁদের পদায়ন করার জন্য নির্ধারিত পদ নেই। এই মুহূর্তে এ রকম কর্মকর্তা আছেন এক হাজার ২৫০ জনের বেশি। প্রেষণ ও চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ায় বিভিন্ন দপ্তর ও অধিদপ্তরে যাঁরা নিজস্ব কর্মকর্তা, তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

আবার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রায় সব মন্ত্রণালয়েই সিনিয়র কর্মকর্তা জুনিয়রদের অধীনে কাজ করছেন। এ ক্ষেত্রে প্রায় সময়ই তাঁদের বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সচিবালয়ে কর্মরত একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, “আমি যুগ্ম সচিব। আমার মন্ত্রণালয়ের যিনি সচিব, তিনি আমার জুনিয়র। এমনকি যিনি অতিরিক্ত সচিব, তিনিও আমার জুনিয়র। অন্য অতিরিক্ত সচিব আমার ব্যাচের হলেও মেধাতালিকায় তিনি আমার অনেক পেছনে। অর্থাৎ সচিব বা অতিরিক্ত সচিব সবাই আমার জুনিয়র। চাকরিজীবনের পুরো সময়টাতেই তাঁকে আমি ‘তুমি’ করেই সম্বোধন করেছি। আর স্বাভাবিক কারণেই সিনিয়র হওয়ায় তাঁরা আমাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করেছেন। কিন্তু এখন আমাকে ‘স্যার’ বলতে হয়। এতে আমরা দুজনই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে আছি। কেউ কাউকে ‘স্যার’ বলি না। এমনকি ওই সচিবের সঙ্গে বৈঠক থাকলে আমি কৌশলে অনুপস্থিত থাকি। সেখানে আমার প্রতিনিধি হিসেবে অন্য কোনো কর্মকর্তাকে পাঠাই। আমি ইচ্ছা করলেই অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হতে পারি; কিন্তু সেখানেও ঝামেলা আছে। অন্য একটা মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে সেখানে কাজ শুরু করতে হলে ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের কৃপা লাগবে। অনেক কর্মকর্তা বদলি হন ঠিকই, কিন্তু মন্ত্রী বা সচিবের কৃপা না থাকায় কোনো ডেস্ক বা দায়িত্ব পান না। এ কারণে বদলি হতে চাই না এই ভেবে যে অন্তত বসার একটা জায়গা তো আছে। ”

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/02/28/468767