২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, ১২:৪৯

বিদেশী পাইলট নিয়োগে তোড়জোড় বিমানে

নেপথ্যে বড় অংকের কমিশন বাণিজ্য * কৃত্রিম সংকট তৈরি ও দেশী পাইলটদের নানাভাবে হয়রানি * অবৈধভাবে বিদেশী নিয়োগ দেয়ায় ২১ কোটি টাকার অডিট আপত্তি * বিদেশী পাইলটপ্রতি ৪০ লাখ টাকা সিন্ডিকেটের পকেটে

কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বিদেশী পাইলট নিয়োগে তোড়জোড় চলছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে। নেপথ্যে কাজ করছে বড় অংকের কমিশন বাণিজ্য। এর আগেও একাধিকবার বিদেশী পাইলট নিয়োগ নিয়ে এ ধরনের কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ আছে, দেশী পাইলটদের ট্রেনিং না করিয়ে, পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাসময়ে পাইলট নিয়োগ না দিয়ে একের পর এক বিদেশী পাইলট নিয়োগ দিয়েছে বিমানের একটি সিন্ডিকেট। ২০১১ সাল থেকে এভাবে চলে আসছে বিদেশী পাইলট নিয়োগের কারসাজি। ওই বছর প্রথম দফায় ৫০ লাখ টাকা বেতনের ১৬ জন বিদেশী পাইলট নিয়োগ দেয়া হয়। ৬ মাসের জন্য নিয়োগের কথা বলে তাদের রাখা হয়েছিল ৩ বছরের বেশি সময়। এ কারণে বিমানকে বড় অংকের টাকা মাশুল গুনতে হয়েছে। এ পর্যন্ত বিমানে ৩৬ জনের বেশি বিদেশী পাইলট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে যেখানে বিমানের একজন সিনিয়র পাইলট প্রতি মাসে ৭-৮ লাখ টাকা বেতন পাচ্ছেন সেখানে আরও নিন্মমানের বিদেশী পাইলট নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৪০-৫০ লাখ টাকা বেতনে।

জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য এজেন্সি আছে, যারা বিভিন্ন এয়ারলাইন্সকে পাইলট ভাড়া দেয়। বিমানের সিন্ডিকেট ওইসব এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব বিদেশী পাইলট নিচ্ছে। এজেন্সিগুলোকে আন্ডারহ্যান্ড ডিলিংয়ের মাধ্যমে বিমানের সিন্ডিকেট পাইলটপ্রতি ৫০ লাখ টাকা বেতন দিলেও বাস্তবে ওই পাইলট পাচ্ছেন গড়ে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। বাকি ৪০-৪২ লাখ টাকা ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট এজেন্সি আর বিমানের অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেটের মধ্যে। ২০১৪ সালেও ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া ৩ বিদেশী পাইলট নিয়োগ দিয়েও বড় ধরনের কমিশন বাণিজ্য করেছিল এ সিন্ডিকেট। এ ঘটনায় ১১ কোটি টাকার অডিট আপত্তি ঝুলছে বিমানের ঘাড়ে। নানা চেষ্টা-তদবির করেও বিমান ম্যানেজমেন্ট এ অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি করতে পারছে না। এছাড়া আরও ২০ জনের বেশি বিদেশী পাইলট নিয়োগ নিয়েও ১০ কোটি টাকার বেশি অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না দীর্ঘদিন ধরে। সম্প্রতি আবারও বিদেশী পাইলট নিয়োগ দেয়া নিয়ে চলছে তোড়জোড়। শুধু তাই নয়, দেশী পাইলটদের বেতন না বাড়িয়ে উল্টো তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। পাইলটরা যাতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিমান ছেড়ে অন্য এয়ারলাইন্সে চলে যান, সেজন্য সিন্ডিকেট বিমানের সব শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ালেও পাইলটদের ক্ষেত্রে গড়িমসি করছে। সম্প্রতি বিমানের ক্যাডেট পাইলট নিয়োগ পরীক্ষার যাচাই-বাছাই পর্যায়েও নানা অনিয়ম করেছে সিন্ডিকেট। নিয়োগ পরীক্ষা যাতে ঝুলে যায়, সেজন্য জিইডিধারী (জেনারেল এডুকেশন অব ডিপ্লোমা) আবেদনকারীদের বাছাই পর্যায়ে বাদ দেয়া হয়েছে। তারা এখন মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিমান যদি শিগগির পাইলটদের বেতন না বাড়ায় তাহলে ২-৩ মাসের মধ্যে বিমানের ২০ থেকে ২৫ জনের বেশি পাইলট চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবেন। এতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ভয়াবহ পাইলট সংকটে পড়বে। আর এ সুযোগে সিন্ডিকেট বিদেশী পাইলট নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারবে।

বিমানের ওই সিন্ডিকেট সম্প্রতি একজন সিনিয়র পাইলটকে বিমান থেকে তাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ১৯ হাজার ঘণ্টা নিরাপদে বিমান চালানোর পর এখন সিন্ডিকেটের রোষানলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে পথে পথে ঘুরছেন বিমানের এ সিনিয়র পাইলট। তার নাম ক্যাপ্টেন আলী আশরাফ খান। বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি তিনি। অভিযোগ আছে, বিমানের একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট এ পাইলটকে চাকরিচ্যুত করার জন্য মিথ্যা মামলা সাজিয়েছে। তাকে গ্রেফতারের জন্য ওয়ারেন্ট ইস্যু করিয়েছে। ৬ মাস ধরে তাকে কোনো ধরনের ফ্লাইট দিচ্ছে না। দিচ্ছে না কোনো বেতন-ভাতা ও অ্যালাউন্স। শুধু আশরাফ খানই নন, বিমানের অসাধু এ সিন্ডিকেট আরও ৬-৭ জন সিনিয়র পাইলটকে চাকরিচ্যুত করতে একই ধরনের মিথ্যা ছক তৈরি করেছে। ৩ জন চুক্তিভিত্তিক পাইলটের মেয়াদ না বাড়ানোরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদেরও নানাভাবে হয়রানি শুরু করেছে। এ অবস্থায় আতংকিত হয়ে পড়েছেন বিমানের অধিকাংশ পাইলট।

জানা গেছে, কর্মজীবনে ভালো রেকর্ড থাকায় ৫৭ বছর চাকরি শেষে ক্যাপ্টেন আলী আশরাফকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় বিমান। এরই মধ্যে তিনি চুক্তিভিত্তিক ২৭০ ঘণ্টা উড্ডয়নও করেছেন। চুক্তি অনুযায়ী, আলী আশরাফ খানকে নিজের টাকায় সিঙ্গাপুরে গিয়ে সিমুলেটর (বোয়িং ৭৭৭ চালানোর জন্য বাধ্যতামূলক ট্রেনিং) পাস করে আসতে হবে। পরবর্তী সময়ে বিমান তার বেতন-ভাতা থেকে কিস্তিতে এ টাকা পরিশোধ করবে। এজন্য বিমান তার কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকার একটি ব্ল্যাংক চেক লিখিয়ে নেয়। দুটি শর্তে বিমানকে এ চেক দেন তিনি। প্রথমত, যদি ইনিশিয়াল সিমুলেটরে ফেল করেন। দ্বিতীয়ত, যদি চাকরিতে যোগ দেয়ার পর এক বছরের আগেই তা ছেড়ে দেন, তাহলেই শুধু বিমান তার দেয়া চেক ব্যাংকে জমা দিয়ে ২৫ লাখ টাকা তুলে নিতে পারবে। গত বছর জুনে তিনি সিঙ্গাপুরে রিকারেন্ট সিমুলেটর ট্রেনিং করতে যান। প্রথম ট্রেনিংয়ে পাস করে তিনি ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ৬ মাস পর প্রত্যেক পাইলটকে সিমুলেটর ট্রেনিং পরীক্ষা দিতে হয়। বিমানের বেশিরভাগ পাইলট এ পরীক্ষায় একাধিক সেশন নিয়ে পাস করার রেকর্ড আছে। কিন্তু অভিযোগ আছে, দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় প্রথম সেশনে খারাপ করার পর বিমানের ওই সিন্ডিকেট তাকে দ্বিতীয় দফায় ট্রেনিং করানোর কোনো সুযোগ দেয়নি। বিমানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, যদি দ্বিতীয় দফায় ট্রেনিং করতে হয় তাহলে নিজের টাকায় করতে হবে। আলী আশরাফ খান তাতেও রাজি হন। কিন্তু অভিযোগ, ম্যানেজমেন্ট থেকে এ বিষয়ে কোনো চিঠি না দেয়ায় সিঙ্গাপুরের ট্রেনিং সংস্থা আলী আশরাফ খানকে দ্বিতীয় দফায় ট্রেনিং না করিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেন। তারপর থেকে একের পর এক হয়রানি শুরু হয় আলী আশরাফ খানের ওপর।

বিষয়টি জানিয়ে এবং ট্রিনিংয়ের জন্য চিঠি ইস্যু করার জন্য আলী আশরাফ খান একে একে ১৫ দফা চিঠি দেন বিমানের পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন ক্যাপ্টেন জামিল আহমেদ, পরিচালক প্রশাসন বেলায়েত হোসেন, বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দিক আহমদের কাছে। কিন্তু কেউই এসব চিঠির কোনো উত্তর দেননি।

বিমানের পর্ষদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল ইনামুল বারী যুগান্তরকে বলেন, বিমান এখন থেকে কোনো চুক্তিভিত্তিক পাইলটের ট্রেনিংয়ের খরচ দেবে না। যেহেতু পাইলট সংকট আছে, তাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ক্যপ্টেন আলী আশরাফ খানের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি আমার নলেজে নেই। অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখবেন বলেও জানান।

শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আলী আশরাফ খান তার ওপর এই বিমাতাসুলভ আচরণের কারণ জানতে বিমানের পরিচালক ফ্লাইট অপারেটর ক্যাপ্টেন জামিলের কাছে ধরনা দেন। তিনিও তার কোনো সদুত্তর না দিয়ে ওপরমহলে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। এমডির কাছ থেকে কোনো ধরনের সহায়তা না পেয়ে ছুটেন বিমানের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল ইনামুল বারীর কাছে। এখানেও মেলেনি কোনো জবাব। একপর্যায়ে তিনি তার ওপর চলা পুরো কাহিনী লিখে প্রতিকার চান বিমানের সব বোর্ড মেম্বারের কাছে। কিন্তু সেখানেও তিনি কোনো প্রতিকার পাননি।

এ প্রসঙ্গে বিমানের প্রশাসন শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ক্যাপ্টেন আলী আশরাফ খানের সঙ্গে যে ধরনের অন্যায় ও অমানবিক আচরণ করা হয়েছে, তা নজিরবিহীন। সিঙ্গাপুরে রিকারেন্ট সিমুলেটর করার সময় তাকে নগদ টাকায় বিল পরিশোধ করার জন্য যেভাবে চাপ দেয়া হয়েছিল বিমানের অন্য কারোর ক্ষেত্রে এমন নজির অতীতে নেই। উল্টো আলী আশরাফের ফ্লাইং, বেতন ও অন্যান্য সব ভাতাদি বন্ধ করে দেয় বিমান, যা চুক্তির বরখেলাপ।

এ সম্পর্কে আলী আশরাফ খান বলেন, আমার কাছ থেকে যে শর্তে এ ২৫ লাখ টাকার চেক জমা রেখেছে, সেটা ভঙ্গ করেই বিমান তা ক্যাশ করার জন্য আমাকে না জানিয়ে ব্যাংকে জমা দিয়েছে। সেটা বাউন্স হয়েছে। এ সুযোগ নিয়ে বিমান আমার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেছে। অথচ বিমান তা পারে না। কেননা চুক্তি মতে, ইনিশিয়াল সিমুলেটরে ফেলও করিনি। আর এক বছরের আগে চাকরিও ছাড়িনি। কাজেই এ চেক ব্যাংকে জমা দিয়ে বড় ধরনের অন্যায় করেছে বিমান। আবার তারাই গোপনে আমার বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলা করেছে। সে মামলায় আমার বিরুদ্ধে প্রতারণা, শর্ত ভঙ্গকারী, লোভী ও অর্থ আত্মসাৎকারী অভিযোগ এনে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। বিমানের পক্ষে মামলা করেন সহকারী ব্যবস্থাপক মোস্তফা মিয়ানদাদ মেহেদী। মামলার আর্জিতে অভিযোগ করা হয়, অভিযুক্ত আলী আশরাফ খানের কাছে বিমানের পাওনা ২৫ লাখ টাকা আদায় করার জন্যই এ আবেদন। এ সম্পর্কে বিমানের অর্থ বিভাগ থেকে নিশ্চিত করা হয়, এরই মধ্যে তার বেতন থেকে বিমান ১৬ লাখ টাকা কেটে নিয়েছে। অন্যদিকে এ সময়ে আলী আশরাফ খান ৬ মাস চুক্তিভিত্তিক চাকরি করার সময় বিমানের কাছে তার পাওনা রয়েছে ১৬ লাখেরও বেশি।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/02/28/104785