২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, ১২:৪০

এমপি লিটন হত্যা

জামায়াতের ২১ ও আ’লীগের ২ জনের ব্যাপারে তদন্ত শেষে সিদ্ধান্ত

এ পর্যন্ত ১৫৮ জন গ্রেফতার

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ আসনের এমপি আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে পরিকল্পনা করে এবং অর্থ দিয়ে খুন করিয়েছেন একই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডা: কাদের খান। আদালতে তার স্বীকারোক্তি এবং এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে খুনে সরাসরি জড়িত চারজন গ্রেফতার হওয়ার পর ওই মামলায় ইতঃপূর্বে গ্রেফতার দেখানো ২১ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী ও দুই আওয়ামী লীগ নেতার ব্যাপারে তদন্ত শেষে আইনি প্রক্রিয়াতেই সিদ্ধান্ত হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ দিকে কাদের খানের স্বীকারোক্তির পর গ্রেফতার জামায়াত নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের দিন সংঘটিত সহিংসতার বিষয়ে পুনঃ এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে জামায়াত।

সুন্দরগঞ্জ থানা সূত্র জানায়, গত বছর ৩১ ডিসেম্বর লিটন হত্যার পর পাঁচটি মামলা হয়। এর মধ্যে লিটনের ছোট বোন কাকলী বাদি হয়ে লিটন হত্যা মামলা এবং পুলিশ ৪, ৬, ৮ ও ১৬ জানুয়ারি চারটি মামলা করে। এর মধ্যে তিনটি বিস্ফোরক আইনে এবং একটি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে।

সূত্র জানায়, লিটন হত্যার পর থেকে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত রানা গ্রেফতার হওয়া পর্যন্ত ১৫৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এতে জামায়াতের ১২৩ জন, জাতীয় পার্টির পাঁচজন, আওয়ামী লীগের দু’জন ও বিএনপির ৩০ জন। ২৮ জনকে এতে লিটন হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়, যার পাঁচজন জাতীয় পার্টি, দু’জন আওয়ামী লীগ এবং ২১ জন জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মী। জাতীয় পার্টির পাঁচজন হলেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়া জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডা: আবদুল কাদের খান, তার গাড়িচালক আবদুল হান্নান, দুই তত্ত্বাবধায়ক শাহিন মিয়া ও মেহেদী হাসান এবং তাদের সহযোগী আনোয়ারুল ইসলাম রানা। এর আগে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আহসান হাবিব মাসুদ এবং লিটন ও তার স্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন আওয়ামী লীগ নেতা ইমামগঞ্জ ফাজিল মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাসুদুর রহমান মুকুল।

অন্য দিকে লিটন হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো ২১ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী হলেনÑ গাইবান্ধা জেলা জামায়াতের সাবেক রাজনৈতিক সেক্রেটারি সদর উপজেলার মধ্যপাড়ার আমিনুল হক, সুন্দরগঞ্জ পূর্ব থানা আমির সুন্দরগঞ্জের উত্তর শ্রীপুর এলাকার সাইফুল ইসলাম মণ্ডল, গাইবান্ধা শহর জামায়াতের ৫ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি কলেজপাড়া এলাকার শাহীন মাহমুদ, সুন্দরগঞ্জ থানা আমির হাজী ইউনুস আলীর ছেলে রামভদ্র কদমতলার শিবিরকর্মী সাইফুল ইসলাম ও আশরাফুল ইসলাম, ব্যবসায়ী ও জামায়াত সমর্থক হাজী ফরিদ উদ্দিন, জামায়াত সমর্থক সাবেক ইউপি সদস্য জহুরুল ইসলাম, জামায়াতকর্মী রামভদ্র এলাকার রেজাউল ইসলাম লিটন, রামভদ্র খানাবাড়ির হযরত আলী, দক্ষিণ শিবরামের নবীনুর ইসলাম, উত্তর হাতিবান্ধার জিয়াউর রহমান, খামার পাঁচগাছির হাদিসুর রহমান হাদিসুর, ছামিউল ইসলাম, বাছহাটি এলাকার মোজাম্মেল হক, বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মনমথ এলাকার লাল মিয়া, মনমথ বন্দরের রাতুল মিয়া ও সিরাজুল ইসলাম, দর্জিপাড়ার মাহাতাব উদ্দিন, রাম ডাকুরিয়ার গোলাম মোস্তফা এবং শিবিরকর্মী গাইবান্ধা সদরের সাহাপাড়া ইউনিয়নের সাদেকপুরের মামুনুর রশিদ ও জামায়াতকর্মী শফিকুল ইসলাম দলু।

গাইবান্ধা জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল করিম জানান, এমপি লিটন হত্যা মামলার পর থেকেই আমরা বিচার বিভাগীয় তদন্তসহ প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত ও গ্রেফতার করে তাদের বিচারের দাবি জানিয়ে আসছি, কিন্তু সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওই ঘটনার পর থেকে হয়রানির উদ্দেশ্যে অন্যায়ভাবে আমাদের দলের নেতাসহ কর্মী-সমর্থকদের গ্রেফতার করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ২৩ জনকে লিটন হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়েছে। বাকি ১০২ জনকে পুলিশের দায়ের করা তিনটি বিস্ফোরক ও একটি সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। এ ঘটনায় মূল আসামি কাদের খান আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। খুনিদেরও পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে নিরপরাধ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের ওই মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে মুক্তি দেয়া। তা করা হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে এগোবে দেশ। সুন্দরগঞ্জের মানুষের মধ্যে সৃষ্ট আতঙ্ক দূর হবে।

জামায়াতের এই নেতা বলেন, পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছে কাদের খান মন্দির ভাঙাসহ বিভিন্নভাবে সুন্দরগঞ্জের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে লিটনকে হত্যা করে আগামীতে এমপি হওয়ার পথ সুগম করতে চেয়েছিলেন। এটি জানার পর সুন্দরগঞ্জের মানুষের এখন আরেকটি দাবি, পুলিশের কাছে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের দিন সুন্দরগঞ্জে সহিংসতার পেছনে আসলে কার হাত ছিল, সেটি খতিয়ে দেখা হোক। এই জামায়াত নেতার দাবি, ওইদিন সুন্দরগঞ্জের সাধারণ মানুষকে যেভাবে উসকে দেয়া হয়েছিল, তাতে সংঘর্ষে চার পুলিশ ও তিনজন জামায়াত-শিবির নেতা মারা যান। ওই উসকানির পেছনে পরিকল্পনাকারী ও অর্থায়নকারী হিসেবে কাদের খানের সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখা হোক। এর ফলে প্রকৃত সত্য জনগণের কাছে পরিষ্কার হবে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুর্নাম থেকে রক্ষা পাবে।

সুন্দরগঞ্জ পৌর জামায়াতের আমির একরামুল হক জানান, মাওলানা সাঈদীর মামলার রায়ের দিন বেলা ১১টার মধ্যেই উপজেলার সব এলাকায় জামায়াত মিছিল-মিটিং শেষ করে। ১২টার মধ্যে জামায়াতের সব নেতাকর্মী বাড়ি চলে যান। কিন্তু ওই দিন বেলা আড়াইটার পর থেকে সুন্দরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা শুরু হয়। ওই ঘটনার পর থেকেই আমরা বারবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ মিডিয়াকে এ কথাটি বলে আসছিলাম এবং দাবি করছিলাম, এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার, কিন্তু সেটা করা হয়নি। ওই ঘটনার পর থেকে ১০৬টি মামলা দেয়া হয়েছে, যার এজাহারনামীয় মানুষের সংখ্যা ৫৩ হাজার এবং অজ্ঞাতনামা ছিল ৫০ হাজার। তার মধ্যে ১০০টি মামলায় সাড়ে ছয় হাজার নেতাকর্মীর নামে পুলিশ মিথ্যা চার্জশিট দিয়েছে। এখন এমপি লিটন হত্যার মামলায় কাদের খান গ্রেফতার হয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার পর প্রমাণিত হয়েছে মন্দির ভাঙা, এমপি হত্যাসহ বিভিন্ন নাশকতার পরিকল্পনাকারী ও অর্থায়নকারী কর্নেল কাদের খান ও তার সমর্থকেরা। তিনি বলেন, আমরা মনে করি ২৮ ফেব্রুয়ারিসহ যেসব সহিংস ঘটনা সুন্দরগঞ্জে হয়েছে, তার সাথে জামায়াত-শিবিরের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কর্নেল কাদের খান এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ২৮ ফেব্রুয়ারির সহিংসতা হয়েছে। ওই ঘটনা পুনরায় তদন্ত করা হোক এবং মিথ্যা মামলা ও চার্জশিট থেকে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের অব্যাহতি দেয়া হোক।

গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান জানান, লিটন হত্যার পর পুলিশ সুন্দরগঞ্জ থানা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সানোয়ার হোসেনসহ ৩০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। যদিও লিটন হত্যা মামলায় তাদের নাম দেয়া হয়নি, কিন্তু বিস্ফোরক মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। কাদের খানের স্বীকারোক্তির পর এটা প্রমাণিত হয়েছে, এ ঘটনার সাথে বিএনপির কেউ জড়িত নয়। বিএনপি নেতাকর্মীসহ নিরপরাধ যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি এবং মুক্তি নিশ্চিত করা এখন পুলিশের কর্তব্য।

আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ শামস-উল-আলম মনে করেন, যেহেতু মামলা তদন্তাধীন; তাই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দু’জন কারাগারে থাকাই ভালো।

এ দিকে সুন্দরগঞ্জের সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, লিটন হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। এর পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতা কাদের খান। খুনে সরাসরি অংশ নেয়া তার ঘনিষ্ঠ চারজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কিন্তু এর আগে যে ২৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, এখন তাদের কী হবে। তারা কি মুক্তি পাচ্ছেন, নাকি তারাও কারাগারে থাকবেনÑ এমন প্রশ্ন সাধারণ মানুষের। এ ব্যাপারে পুলিশ ও আইনজীবীরা বলেছেন, তদন্ত শেষ হওয়ার পর আইনি প্রক্রিয়াতেই তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।

সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার ইনজার্জ আতিয়ার রহমান জানান, ১১০ জনকে বিভিন্ন নাশকতা ও বিস্ফোরক মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। আর এমপি লিটন হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয় ২৮ জনকে। এর মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়া সাবেক এমপি অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল কাদের খান, তার চার সহযোগী, দু’জন আওয়ামী লীগ ও ২১ জন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী।

গাইবান্ধা পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল্লাহ আল ফারুক জানান, এমপি লিটন হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন।

রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুখ বিপিএম, পিপিএম সাংবাদিকদের বলেন, সাবেক এমপি কাদের খান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। এর মাধ্যমে মামলাটির মোটিভ উন্মোচিত হয়েছে। কিন্তু যেহেতু মামলাটি এখনো তদন্তাধীন। সেহেতু তদন্ত আগে শেষ হোক। এরপর যাদেরকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গাইবান্ধা জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) শফিকুর রহমান জানান, হত্যাকাণ্ড কারা ঘটিয়েছে তা চিহ্নিত হয়েছে ঠিক আছে, কিন্তু যেহেতু এখনো তদন্ত চলছে এবং অভিযোগপত্র দেয়া হয়নি, তাই এ ঘটনায় গ্রেফতার অন্যরাও কারাগারেই থাকবেন। অভিযোগপত্র দেয়ার পর আদালত কার বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেন, সেটা তখন বোঝা যাবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/199542