২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ৪:১৯

সড়ক দুর্ঘটনা

পরিবহন ধর্মঘটে পিষ্ট সড়ক নিরাপত্তা

জনস্বার্থে কিংবা সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন আটকে গেছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর কারণে। গত আট মাসে সারা দেশে অন্তত ২০ বার ধর্মঘট ডেকেছে এসব সংগঠন। তাদের মূল দাবি হচ্ছে, চালকের সাজা মওকুফ, আইন অমান্য করে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেওয়া, রাস্তায় পুলিশের তৎপরতা কমানো ইত্যাদি।

তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের প্রাণহানির ঘটনায় ঘাতক বাসের চালক জামির হোসেনের বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জ আদালতের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে গতকাল রোববার থেকে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ধর্মঘট শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের খুলনা বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটি এ ধর্মঘট ডেকেছে। এর আগে রায়ের পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি চুয়াডাঙ্গায় ধর্মঘট পালন করা হয়।

এই সংগঠনটি গত বছরের ১৫ মে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের পরিবারের পক্ষ থেকে করা ক্ষতিপূরণ মামলার বিরুদ্ধেও ধর্মঘট পালন করে। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত জামির হোসেনকে ২০১১ সালে গ্রেপ্তার করার পর তাঁর মুক্তির দাবিতে মালিক-শ্রমিকেরা যৌথভাবে সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘট পালন করেন। শহীদ মিনারে শ্রমিক সমাবেশ করা হয়।

জানতে চাইলে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ও নিরাপদ সড়ক চাই-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, শক্তি প্রদর্শনের লক্ষ্যেই এই ধর্মঘট। ১৯৮৩ সালেও তারা শক্তি প্রদর্শন করে সড়ক দুর্ঘটনার মামলার সাজা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়। অতীতে গাড়িতে মাদকদ্রব্য রাখার দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া চালককে ছাড়াতেও তারা ধর্মঘট করেছে। মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো সব সময় আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে চায়। তিনি বলেন, ‘আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ডাকা ধর্মঘটের বিষয়ে আদালত ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা করছি। জনগণকে বলব, আপনারা মাথা নোয়াবেন না। দেখি তারা কত দিন ধর্মঘট করতে পারে।’

১২ ফেব্রুয়ারি ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ফরিদপুর, নরসিংদী ও গাজীপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯ জন প্রাণ হারান। এই ঘটনার পর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সংশ্লিষ্ট পরিবহন মালিকদের কাছে গত বৃহস্পতিবারের মধ্যে ব্যাখ্যা চায়। কিন্তু গতকালও ব্যাখ্যা জমা হয়নি বিআরটিএতে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, ধর্মঘটের কারণে এই ব্যাখ্যা দেওয়ার বিষয়টি চাপা পড়ে গেছে।

সারা দেশের পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলোর শীর্ষ ফোরাম হচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। এর কার্যকরী সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। আর মালিকদের শীর্ষ সংগঠন হচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি। এর সভাপতি সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে যত পরিবহন ধর্মঘট হচ্ছে, এর প্রায় সব কটির পেছনেই এই দুটি সংগঠন কিংবা তাদের স্থানীয় অঙ্গপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ধর্মঘট ডাকার পর সরকারের সঙ্গে সালিস-মীমাংসার বৈঠকেও এই সংগঠনের নেতারা নেতৃত্ব দেন।

জানতে চাইলে মসিউর রহমান রাঙ্গা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো সারা দেশে বিস্তৃত। নানা ধরনের মানুষ এর মধ্যে আছে। দাবি আদায়ের পন্থা হিসেবে ধর্মঘট অনেক পুরোনো। জনস্বার্থে ও সড়ক নিরাপত্তার জন্য নেওয়া সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে শাজাহান খান ও আমি মিলে চেষ্টা করছি।’

যানবাহন-সংক্রান্ত বিধিবিধান ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল কর্তৃপক্ষ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এই বিভাগের অধীন বিআরটিএ হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পরিবহন-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে স্বরাষ্ট্র ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের।

এই তিন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ সূত্র জানায়, সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত মালিক-শ্রমিকদের মনঃপূত না হলেই তারা ধর্মঘট করে। কিছু ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার মীমাংসা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আঞ্চলিক বা জাতীয় পর্যায়ে ধর্মঘট হলে সড়ক পরিবহন কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করা হয়।

কেন্দ্রীয় বৈঠকের নিয়মিত মুখ হচ্ছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান।

পরিবহন মালিক-শ্রমিক সূত্রগুলো বলছে, ধর্মঘট ডাকার ক্ষেত্রে খুলনাভিত্তিক দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, চট্টগ্রাম অঞ্চল ও রাজশাহীভিত্তিক উত্তরবঙ্গের শ্রমিক-মালিক সংগঠনগুলোই বেশি তৎপর। এই সংগঠনগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা শাজাহান খান ও মসিউর রহমানের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় কমিটিরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন।

গতকাল জাতীয় ঈদগাহ গেটের সামনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিদর্শনকালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, মামলার রায়ের পর পরিবহন শ্রমিকেরা তাঁর কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন। তিনি তাঁদের বলেছিলেন, আদালতের রায় অমান্য করা যাবে না। রায়ে সন্তুষ্ট না হলে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারেন। কিন্তু এরপরও অযৌক্তিক ধর্মঘট ডেকে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলা হয়েছে। এতে তাঁদের কোনো লাভ হবে না।

ধর্মঘটে আটকে যাচ্ছে সিদ্ধান্ত
খুলনাভিত্তিক শ্রমিক সংগঠনটির নেতাদের নেতৃত্বে পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে গত ২৩ জানুয়ারি থেকে দুই দিন ধর্মঘট পালন করা হয়। খুলনা ও বরিশাল বিভাগ ও বৃহত্তর ফরিদপুরের ২১টি জেলায় পণ্য পরিবহন বন্ধ ছিল।

এই ধর্মঘটের ফলে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও বাস মূল কাঠামোয় ফিরিয়ে আনার সরকারি সিদ্ধান্ত আটকে আছে। সারা দেশে প্রায় পৌনে দুই লাখ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের আকৃতি পরিবর্তন করে লম্বায় সাত ফুট ও চওড়ায় দুই ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। বডিতে লাগানো হয়েছে তিনকোনা আকৃতির লোহার পাতের অ্যাঙ্গেল। সামনে-পেছনে আছে বাম্পার।

অনেক বাস-মিনিবাসেরও আকৃতি পরিবর্তন করা হয়েছে। অতিরিক্ত পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্যই এভাবে আকৃতি পরিবর্তন করা হয়েছে, যা মোটরযান আইনের পরিপন্থী এবং এটি সড়ক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা দিয়েছে সরকার।

গতকাল এ বিষয়ে বিআরটিএ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠক মালিক-শ্রমিকদের বাধার মুখে সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। আগামী শনিবার পুনরায় বৈঠক ডাকা হয়েছে বলে বৈঠক সূত্র জানায়। এর আগে ২৩ জানুয়ারি ২১ জেলায় ধর্মঘট ডাকার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মালিক-শ্রমিক নেতাদের নিয়ে বৈঠক হয়। এতে নৌমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী উপস্থিত থেকেও বিষয়টি সুরাহা করতে পারেননি।

দেশের সড়ক ও সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে—এই বিবেচনায় নির্ধারিত ওজন সীমার অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহনের বিরুদ্ধে গত বছর জরিমানা আরোপ করে সরকার। এর প্রতিবাদে গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১০০ ঘণ্টা ধর্মঘট পালন করে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো।

পরে ৫ অক্টোবর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, নৌমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ছয়জন মন্ত্রী ও একজন মেয়র এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বৈঠক করে মালিক-শ্রমিকদের চাপের মুখে বাড়তি জরিমানা প্রত্যাহার করা হয়। এখন ট্রাক ও লরিতে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন চলছে।

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধর্মঘট তাদের ব্যাপার। তবে সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আমরা কঠোর হব। ২৮ ফেব্রুয়ারির পর ছাড় দেওয়া হবে না।’

মূল দাবির আড়ালে অন্য দাবি
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত বছরের মে থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ২০ বার পরিবহন ধর্মঘট হয়েছে। এর মধ্যে সাতবার আহ্বান করা হয়েছে অঞ্চলভিত্তিক। বাকিগুলো জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এসব ধর্মঘটে প্রকাশ্যে দাবির মধ্যে জনপ্রিয় দাবিগুলো হচ্ছে পুলিশের হয়রানি বন্ধ, লাইসেন্স প্রাপ্তি সহজ করা, শ্রমিক নির্যাতন বন্ধ, টার্মিনাল স্থাপন ও চাঁদা বন্ধ করা।

তবে একজন শ্রমিকনেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত মনঃপূত না হলে তাঁরা অন্য দাবির আড়ালে ধর্মঘটের ডাক দেন। সরকার বৈঠক ডাকলে তাঁরা তাঁদের মূল দাবিতে অটল থাকেন।

জানতে চাইলে সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে সোচ্চার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথম আলোকে বলেন, গণপরিবহন ব্যবহার করে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ। কিন্তু মালিক-শ্রমিকদের কাছে এই মানুষের কিছুমাত্র মূল্য নেই। মালিক ও শ্রমিকনেতারা সরকারি লোক। ফলে সরকার তাদের স্বার্থই দেখে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1091395