প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ১৬টি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দিয়েছে রূপালী ব্যাংক। এতে টাকার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৩৩২ কোটি। এক্ষেত্রে ১০টি প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া হয়েছে নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট। বাকি ৬টি প্রতিষ্ঠানকে ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত বিপুল পরিমাণের এসব ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। রূপালী ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, রূপালী ব্যাংকের আগের এমডি খেয়ালখুশিমতো ঋণ দিয়ে গেছেন। সেসব ঋণ আর আদায় হচ্ছে না। বর্তমান এমডির উচিত হবে আগের দেয়া ঋণগুলোর অসঙ্গতি শনাক্ত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া। তার মতে, ব্যাংকিং খাতে যে প্রক্রিয়ায় ঋণ পুনর্গঠন করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। এতে বিপদ আরও বাড়ছে। মূলত এখানে গোড়ায় গলদ। ঋণ বিতরণ সঠিকভাবে হচ্ছে না। তাই ঋণ পুনর্গঠন করে এ ধরনের সমস্যার সমাধান করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, ঋণ পুনর্গঠন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এ প্রক্রিয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসায় কোনো অসুবিধা হলে ঋণ পরিশোধে সময় চাওয়া হয়। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু বাংলাদেশে ঋণ পুনর্গঠন প্রক্রিয়াটি সঠিক নয়।
প্রসঙ্গত, রূপালী ব্যাংকের সাবেক এমডি এম ফরিদ উদ্দিন। তিনি এই পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়ে ব্যাংকটিতে ব্যাপক অনিয়ম হয়। গত ৯ বছরে রূপালী ব্যাংকে যত গুরুতর অনিয়ম হয়েছে, সবই তার আমলে। বহু অভিযোগ থাকলেও রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি বিদায় নিয়েছেন। এদিকে এ বিষয়ে এম ফরিদ উদ্দিনের বক্তব্য নিতে তার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, একই অপরাধে অন্য একটি ব্যাংকের এমডির চাকরি গেল। আর তিনি নীরবে বেরিয়ে গেলেন। এটা ঠিক নয়। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সব অপরাধীর শাস্তি হওয়া উচিত। তা না হলে কোনো ভালো লোক ব্যাংকে আসতে চাইবেন না। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) এ বিষয়ে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে নিয়মের ব্যত্যয়, অন্যদিকে পুনর্গঠন করা বিপুল অংকের ঋণ। বাস্তবিক অর্থে সবই এখন ঝুঁকির মধ্যে, যা আবারও খেলাপি হতে পারে। যদিও ব্যাংক কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব ঋণ এখনও ভালো মানে আছে। খেলাপি হয়নি।
জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান যুগান্তরকে বলেন, নিয়ম মেনে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয়েছে, যা এখন কিস্তিতে শোধ দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে কেউ আবার খেলাপি হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না এখন পর্যন্ত কেউ খেলাপি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী ঋণ পুনর্গঠন করতে হলে সংশ্লিষ্ট ঋণের সর্বনিন্ম ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ডাউন পেমেন্ট হিসেবে জমা রাখতে হয়। এক্ষেত্রে প্রথমবার ৫ শতাংশ, দ্বিতীয়বার ১০ শতাংশ ও তৃতীয়বার ১৫ শতাংশ। ধাপে ধাপে এটি কার্যকর হয়। শুধু সর্বনিন্ম ৫ শতাংশ হিসেবে রূপালী ব্যাংক ডাউন পেমেন্ট রাখার কথা ছিল সাড়ে ৬৬ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনর্গঠনের বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট রেখেছে মাত্র ২১ কোটি টাকা।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নিয়ম ভেঙে ঋণ পুনর্গঠন করে ১৬টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে ১৩শ’ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রূপালী ব্যাংকের ঢাকায় ১০টি, চট্টগ্রামে ১টি, বরিশালে ১টি, খুলনায় ১টি ও রংপুরের ৩টি। এর মধ্যে ৬টি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ডাউন পেমেন্ট নেয়নি। এগুলো হল- রূপালী ব্যাংক ঢাকার স্থানীয় কার্যালয়ের গ্রাহক মাদার টেক্সটাইলের ৬৩৪ কোটি টাকা, বায়োনিক সি ফুড এক্সপোর্টের ২৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা, মেসার্স বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজের ১১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, মেসার্স বদর স্পিনিং মিলসের ১৯৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, মেসার্স বাইপেড সুয়েটার্সের ১৬ কোটি ২ লাখ টাকা এবং মেসার্স বিউটিফুল জ্যাকেটস’র ১১ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
অপরদিকে শুধু নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনর্গঠন করা হয় বাকি ১১টি প্রতিষ্ঠানের। এগুলো হল- রূপালী ব্যাংকের ঢাকাস্থ স্থানীয় কার্যালয়ের মেসার্স ভার্গো মিডিয়ার ১৪৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ঋণ পুনর্গঠনের বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট ৮ কোটি টাকা, একই শাখার ইব্রাহিম কনসর্টিয়াম ৩৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকার বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট মাত্র ৫০ লাখ, গুলশান কর্পোরেট শাখার মেসার্স প্যানবো বাংলা মাশরুম ৮৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকার বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট ২ কোটি এবং রমনা কর্পোরেট শাখার ডিএসএল সোয়েটার লিমিটেড ১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকার বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট হিসেবে জমা দিয়েছে মাত্র ৪৩ লাখ টাকা।
এছাড়া নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে রংপুরের ৩টি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পুনর্গঠন করার সুযোগ দিয়েছে রূপালী ব্যাংক। এগুলো হল- রংপুর জিএল রায় রোড কর্পোরেট শাখার সেকান্দার বীজ হিমাগার ১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ঋণ পুনর্গঠনের বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট দিয়েছে ৯৭ লাখ টাকা, একই শাখার ময়নাকুটি এগ্রো ১৭ কোটি ৫১ লাখ টাকার বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট দেয় মাত্র ৭৮ লাখ এবং রংপুর আর কে রোড শাখার অংকুর স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজকে ১৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকার বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট হিসেবে মাত্র ৪০ লাখ টাকা জমা দেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়।
এর বাইরে বরিশালের সদর রোড কর্পোরেট শাখার সোনারগাঁও টেক্সটাইল ১১ কোটি ৪ লাখ টাকা ঋণ পুনর্গঠনের বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট দিয়েছে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, চট্টগ্রামের রূপালী সদন কর্পোরেট শাখার চেমন ইস্পাত ৬৩ কোটি ৬১ লাখ টাকার বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট দেয় ৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা এবং খুলনা শামস ভবন কর্পোরেট শাখার মেসার্স মহসীন জুট মিলসকে ১৫ কোটি ২২ লাখ টাকার বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট হিসেবে মাত্র ৪৬ লাখ টাকা জমা দেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়।