২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ১:২৬

দেখা অদেখা

উৎসবের ভোটে নানা বাধা

সালাহউদ্দিন বাবর

নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতায় এবং সংবাদপত্রের পাতায় ও অন্যান্য গণমাধ্যমে যেন নির্বাচনমুখী রাজনীতির বাদ্য বেজে উঠেছে। দেশে ভোটের রাজনীতিতে তিনটি পক্ষ। নির্বাচন কমিশন, সরকার ও বিরোধী দলÑ এ তিন পক্ষের সংযোগেই ভোট বা নির্বাচন হয়ে থাকে। নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হলেই ইসি সে মোতাবেক পদক্ষেপ নেয়। এই সিদ্ধান্ত হয় সরকারের পক্ষ থেকে। আর ভোট অর্থপূর্ণ হয় বিরোধী দলের অংশগ্রহণে। তবে নির্বাচন নিয়ে এখনই ইসির কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। এ দিকে সরকারি দল ও বিরোধী দলের নির্বাচনমুখী তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তারা এখন নির্বাচনী লড়াইয়ে নামার জন্য যেন সাজঘরে তৈরি হচ্ছে। তারই আবহ এখন সর্বত্র। আগামীতে যে সংসদ নির্বাচন হবে, তা নানা দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি এখন দেশে এবং দেশের বাইরে সবারই। দেশে গণতন্ত্রের নতুন অভিযাত্রার সূচনা হতে পারে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে।

প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোট আগামী নির্বাচনের প্রচারণার কর্মকৌশল এবং ইশতেহার তৈরির ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে। সব দলের ‘থিংকট্যাংক’-এর সদস্যরা এসব বিষয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।

রাজনীতির সব খেলোয়াড়ই এখন প্রতিপক্ষের আক্রমণ মোকাবেলা এবং প্রতি আক্রমণের দিকগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। রাজনীতি এখন বস্তুত দুই ধারায় বিভক্ত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। আওয়ামী লীগ এর আগের নির্বাচনেও জোটবদ্ধ হয়ে এবং জাতীয় পার্টির সাথে সমঝোতা করে নির্বাচন করে ক্ষমতায় গিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির অভিজ্ঞতা কম। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে, সে নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল। তার ২০ দলের শরিকেরাও সে নির্বাচনে যায়নি। এবার নির্বাচনে ২০ দল একসাথে থাকবে বলেই মনে হয়। অপর দিকে, জাতীয় পার্টি পৃথক একটি জোট করে নির্বাচনে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা অবশ্য বলছেন, তাদের পৃথকভাবে নির্বাচন করার জন্য নড়েচড়ে ওঠার পেছনে আওয়ামী লীগের ইশারা থাকতে পারে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগ-বিরোধী ভোটগুলো বিভক্ত করা। অথবা বিএনপি যে বলছে, তারা এই নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না এবং নির্বাচনের সময় সহায়ক সরকার দরকারÑ এসব শর্ত নিয়ে বিএনপি যদি নির্বাচনে হাজির না থাকে, তবে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন জোটকে সংসদে ‘বিরোধী’ দলের ভূমিকায় নিয়ে যাওয়া হবে। এর বাইরে আরো একটি জোটের সম্ভাবনা রয়েছে। বিকল্প ধারা, গণফোরাম, জেএসডি (রব), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগÑ এ দলগুলো একত্র হতে পারে। আগামী নির্বাচনে ইসলামি দলগুলো কী করবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তা ছাড়া সিপিবি, বাসদÑ এই বাম দলগুলোর পরিকল্পনা প্রকাশ পায়নি।

ভোটের রাজনীতি জমে উঠলেও ভোট কবে হবে? এ প্রশ্নের জবাব কারো কাছে নেই। যদি এই বিতর্কিত সংসদ পুরো মেয়াদ শেষ করে, সে ক্ষেত্রে নির্বাচন হবে ২০১৯ সালের প্রারম্ভে অথবা ২০১৮ সালের শেষে। কেউ কেউ মনে করেন ২০১৮ সালের মধ্যভাগে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনাও প্রচুর। সরকারের মেগা প্রজেক্ট পদ্মা সেতু ২০১৮ সালের মধ্যভাগে একটা পর্যায়ে পৌঁছবে; সেই সাথে আরো কিছু বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প আগামী বছরের মাঝামাঝি চালু হতে পারে। এসব প্রকল্প নির্বাচনী প্রচারে কাজে লাগানো হবে। আগামী নির্বাচনে সরকারের প্রচারণার প্রধান বিষয় হবে উন্নয়ন। জোর দিয়ে বলা হবে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে দরকার পুনরায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাসীন করা। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নির্বাচনের জন্য কাজ শুরু করেছে।

বিএনপিও নির্বাচন নিয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে। দলের অনেক সমস্যা রয়েছে। নেতাকর্মীদের অনেকেই জেলে, অনেকে মামলায় জর্জরিত। সংগঠনের কাজকর্ম করতে নানা বাধাবিপত্তি। দল অগোছাল। এসব সত্ত্বেও বিএনপির জনসমর্থন ব্যাপক। বিএনপি কর্মীনির্ভর নয়, সমর্থকনির্ভর দল। এ দিকে সম্প্রতি বিএনপি তার মূল দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর পুনর্গঠনে কাজ করছে।

দেশে নির্বাচন তথা ভোটের রাজনীতি নিয়ে জনগণ ব্যাপকভাবে উৎসাহিত। তারা ভোটাভুটিকে আনন্দ উৎসব হিসেবেই গ্রহণ করে থাকে।

নির্বাচনী প্রচারের সভা-সমাবেশ ও মিছিলে বিপুলসংখ্যক মানুষ বিপুল উৎসাহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেয়। এমন কর্মসূচি দিনে হোক আর রাতেই হোক, অগণিত মানুষ তাতে অংশ নেয়। নির্বাচনে বর্ণাঢ্য পোস্টার ফেস্টুন তোরণে গোটা দেশ ছেয়ে যায়। ভোটের গান ও হরেক রকমের স্লোগানে শহর, নগর, গ্রামগঞ্জ মুখরিত হয়ে ওঠে। মানুষ মেতে ওঠে অপার আনন্দে। এটা এ দেশে ভোটের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই আনন্দ বেশি সময় স্থায়ী হয় না। ভোটের আগেই ক্ষুদ্র উৎসাহ আনন্দ। ভোটের দিনে প্রবল উত্তেজনা ও নানা হাঙ্গামায় জনমনে সৃষ্টি হয় ভয়ভীতি ও শঙ্কা। ভোটের পর চরম হতাশায় মানুষ বিমর্ষ হয়ে পড়ে। অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ভোট দিতে গিয়ে হাঙ্গামার ভয়ে ভোট দেয়া হয় না। অথবা ভোট দিতে গিয়ে দেখে, অন্য কেউ তার ভোট দিয়ে গেছে। ভোটের আগে দেখা যায়, সব চেনাজানা মানুষ বন্ধু-সুহৃদ। কিন্তু ভোটের দিন দেখা যায়, ভিন্ন অচেনা মানুষ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছে। এত দিন যারা ভোটের গান গেয়েছে, সে মানুষগুলোকে আর দেখা যায় না। দেখা যায় অচেনা মাস্তানদের দৌরাত্ম্য। ভোটের শক্তি হেরে যায়, পেশিশক্তি বিজয়ী হয়। এই অভিজ্ঞতা অনেক দিনের। ভোটের আগে এর বিরুদ্ধে যাদের সোচ্চার হয়ে কথা বলতে দেখা গেছে, ভোটের দিনে তারাই ভিন্ন চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়ে থাকে। ক্ষমতাধরেরাই এই অপশক্তির পৃষ্ঠপোষক, সহায় ও সহযোগী। কখনো কখনো দেখা যায়, ভোটার ছাড়াই ‘নির্বাচন’ হয়ে যায়। এমন ভোটে ‘নির্বাচিত’রাই ক্ষমতায় যান, রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেন; দেশ পরিচালনা করেন। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।

নির্বাচনে এসব অনিয়মের সাথে আরো কিছু অনিয়মের ঘটনা ঘটে থাকে। এর মধ্যে অর্থের ছড়াছড়ি একটি বড় উদ্বেগের ব্যাপার। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক দৈন্য শুধু সামাজিক সমস্যাই সৃষ্টি করে না, এর বহু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। এটা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে গোটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় অর্থের ছড়াছড়ি জনমতকে ভণ্ডুল করে ফেলে। দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে তাদের ভোট কিনে নেয়া হয়। ফলে অর্থের দৌরাত্ম্য নির্বাচনে ফলাফল ভিন্ন দিকে নিয়ে যায়। ফলে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে না। এভাবে যারা নির্বাচনে অর্থ লগ্নি করে, নির্বাচনের পর ক্ষমতায় গিয়ে এসব অর্থ লগ্নিকারী ‘সুদে আসলে’ তাদের ‘বিনিয়োগ’ তুলে নেয়। জাতীয় কল্যাণে রাষ্ট্র যে অর্থ বরাদ্দ করে, সেখান থেকে অর্থ সরিয়ে নেয়া হয় এ জন্য। এটা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। নির্বাচনে অনিয়ম, অভিযোগ এবং অর্থের অপব্যবহার পর্যবেক্ষণে যারা নিয়োজিত থাকেন, তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এই পর্যবেক্ষকদের সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যে কর্তৃপক্ষের ওপর, তারা সেই সমস্যা সমাধানে সহায়তা করেন কদাচিৎ।

নির্বাচনের আরেক সমস্যা হলো, স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা। লক্ষ করা যায়, ক্ষমতাসীনদের এবং প্রভাবশালীদের অনুকূলে তারা প্রভাব বিস্তার করে নির্বাচনের বিশুদ্ধতা বিনষ্ট করে। বহু ক্ষেত্রে নির্বাচনের ফলাফলকে তারা প্রভাবান্বিত করে থাকে। নির্বাচনে যেসব সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তাদেরও চাপের মধ্যে রাখা হয়। এ চাপটি আসে ক্ষমতাসীন মহল থেকে। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করার দাবি সবার। সেজন্য এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বাধীনভাবে ন্যায়নীতিবোধ দ্বারা দায়িত্ব পালন করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় সমস্যা সৃষ্টি করে, তার মধ্যে নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন এবং এর প্রতিবিধান না হওয়া একটি বড় সমস্যা। যারা মাঠে-ময়দানে আইন লঙ্ঘন করে তাদের বিরুদ্ধে ইসিতে অভিযোগ জানানোর পরও এর কোনো প্রতিবিধান হয় না। ফলে আইন অমান্য করা সংক্রামক ব্যাধির মতো পল্লবিত হয়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এখন নির্বাচনের পাত্রমিত্র অনেক পাল্টেছে। আগে যারা নির্বাচনে মূল ভূমিকা রাখবেন, এখন আর তারা নেই। এ দেশের রাজনীতিতে এবং ভোটে যারা মুখ্য ভূমিকা রাখতেন আগে, সেই ব্যক্তিরা এখন আর হালে পানি পান না। দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী তথা আইনজীবী, কলেজশিক্ষক, হেডমাস্টার, মাঝারি কৃষিজীবীÑ এরাই রাজনীতিতে পদচারণা করতেন। আগের রাজনীতিতে যারা মহীরুহ ছিলেন, তারা সবাই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। এখন তাদের জায়গা দখল করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা রাজনীতিতে এসেছেন ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। রাজনীতিতে অর্থ লগ্নি করছেন, তার ফায়দাও তুলে নিচ্ছেন। ভোটের রাজনীতিতে এখন যে টাকার ছড়াছড়ি এর কারণ এটাই। জনসেবা, জনকল্যাণÑ এসব লক্ষ্য তাদের নেই। এটা দেশের সামগ্রিক সমস্যা।

কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় যারা অন্যায় করে তারা দ্বিগুণ উৎসাহে অন্যায় করতে থাকে এবং এ সংক্রান্ত বিধিবিধানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে। সহিষ্ণু সরকারি দল, ধৈর্যশীল বিরোধী দলের ভূমিকা ভোটের তথা নির্বাচনী রাজনীতির বড় একটি ফ্যাক্টর। ক্ষমতাসীন আর বিরোধী দল গণতন্ত্রে প্রধান পাত্র-মিত্র। দুই দল সীমার মধ্যে থেকে রাজনীতি চর্চা করলে রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয় ইতিবাচক পরিবেশ। এই পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব দশআনা আর বিরোধী দলের দায়িত্ব ছয়আনা। সরকারি দলের দায়িত্ব বেশি হওয়ার কারণ, রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের হাতেই। নির্বাচনের যে বিপুল আয়োজন তা ফলপ্রসূ করতে সরকার সীমার মধ্যে থেকে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সর্বতোভাবে সহায়তা দেয়া সরকারের দায়িত্ব। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত করতে ইসি যে সহায়তা ক্ষমতাসীনদের কাছে চাইবে, তা তাদের দিতে হবে। সরকারের এই ভূমিকা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য অপরিহার্য। একই সাথে নির্বাচনের বিধিবিধান সরকার মেনে চলে পরিবেশ অনুকূল রাখতে হবে। বিশেষ করে তাদের সহিষ্ণু হতে হবে। তাদের সবার চেয়ে বেশি সংযমী হতে হবে। নির্বাচনী প্রচারে তাদের নিন্দা-সমালোচনা হবে চতুর্মুখী। প্রতিপক্ষদের এসব নিন্দা-সমালোচনার শক্ত জবাব দেবে সরকারি দল এ কথা ঠিক এবং তা করবে জোরালোভাবে। তবে এর মাত্রাও সীমার মধ্যে রাখতে হবে। গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে ক্ষমতাসীনদের। সহিংসতায় যাওয়া যাবে না কিছুতেই।

গণতন্ত্রের দুই বাহুÑ সরকারি ও বিরোধী দল। উভয়ের সম্মিলিত প্রয়াসই গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করে। রাজনীতির লক্ষ্য হলো ক্ষমতায় গিয়ে নিজস্ব পরিকল্পনা অনুসারে জনসেবা এবং দেশের সংহতি ও অগ্রগতির জন্য নিরন্তর কাজ করা। এ পথে ধৈর্যের সাথে অগ্রসর হতে হবে। অতীতে আমরা দেখেছি, বিরোধী দলের ভূমিকা নেতিবাচক। এ পথে যেমন গণতন্ত্রের অগ্রগতি সম্ভব নয়, তেমনি তা আর্থসামাজিক পরিবেশের ক্ষতি করে। বিরোধী দল ক্ষমতার বাইরে থেকেও দেশের কল্যাণে কাজ করতে পারে। বিশেষ করে সরকারের ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিয়ে তাদের সঠিক পথে রাখতে পারে। এর একটি ফোরাম হচ্ছে জাতীয় সংসদ। কিন্তু তা এখন আর কার্যকর নয়। ফলে সরকারকে যথাযথ পথে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে সংসদ কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এটা গণতন্ত্রের অনুকূল নয়। গণতন্ত্রের স্বার্থে এর প্রতিবিধান জরুরি।

ভোটের রাজনীতিতে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নির্বাচনে অনিয়ম, বিধি ভঙ্গ, কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতি এসব ক্ষেত্রে দেশের সংবাদপত্র সব সময়ই বড় ভূমিকা রাখে। শুধু নির্বাচনের দিনেই নয়, নির্বাচনের প্রচারকাজে সংবাদপত্রের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। গোটা নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে প্রাণবন্ত করে রাখে পত্রপত্রিকা। এটা সংবাদপত্রের ইতিবাচক দিক। কখনো কখনো নির্বাচনে সাংবাদিকদের নেতিবাচক ভূমিকাও দেখা যায়। কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাতে গিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে অসত্য ও কুৎসা রটনা করা হয়। আবার পক্ষপাতিত্ব করে পছন্দের প্রার্থীদের দোষত্রুটি লুকিয়ে রাখে। এটা ভোটযুদ্ধের জন্য ক্ষতিকর।

ভোটের ক্ষেত্রে একটি অপশক্তি হচ্ছে পেশিশক্তি। নির্বাচনে এই শক্তির দৌরাত্ম্য মারাত্মক। এদের নেই কোনো দল, নেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ব্যাপারে শ্রদ্ধা। অর্থ যেখান থেকে আসুক যেভাবে আসুক তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ন্যায়-অন্যায়ের তোয়াক্কা না করে এরা যার কাছ থেকে অর্থকড়ি পায়, তাদের জন্য সব ধরনের অনিয়ম এরা করে দেয়। এমনকি সময়ে এরা মানুষকে হত্যা করে থাকে। এটা হালচিত্র। ভোটযুদ্ধে অর্থের প্রচলন হওয়ার পর থেকেই এই উপসর্গ দেখা দিয়েছে। এসব রোধে ইসির ভূমিকা নেই বললেই চলে। অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, তা স্থানীয় নির্বাচনে হোক বা জাতীয় নির্বাচনেই হোকÑ নির্বাচনে নানা দাঙ্গা-হাঙ্গামায় বহু লোকের প্রাণহানি ঘটেছে।
এবার অকারণ একটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে বিতর্কিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বক্তৃতাকালে আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত প্রকাশের পর এ নিয়ে তুমুল আলোচনার ঝড় ওঠে। ইতোমধ্যে ইভিএম প্রসঙ্গ অবতারণার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক দল এ ব্যাপারে এই বিতর্কে যোগ দিয়েছে। এ নিয়ে টিভিসহ সামাজিক মাধ্যমেও বিতর্ক হচ্ছে। প্রায় সব দেশেই সাধারণভাবে ভোট নেয়া হয়। কোনো কোনো উন্নত দেশে দু-একবার এই ইভিএম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়ার পর সে পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও ইসি পরীক্ষামূলকভাবে দু-একবার এই জটিল পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণের পদক্ষেপ নিয়ে সফল হয়নি। বাংলাদেশের কোটি কোটি ভোটার এই প্রযুক্তি সম্পর্কে কিছুই জানেন না, তারা জটিল প্রক্রিয়ায় কিভাবে ভোট দেবেন? তা ছাড়া হাজার হাজার কেন্দ্রে এই যন্ত্র বসানোর প্রয়োজন হবে। সেখানে প্রযুক্তিগত জটিলতা দেখা দিলে কিভাবে এবং কারা তা সারাবে? এতে করে গোটা নির্বাচন ব্যবস্থা ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া এই পদ্ধতিতে ভোটে এমন সূক্ষ্ম কারসাজি হতে পারে, যা কেউ ধরতে পারবে না। অথচ মানুষের ভোট ছিনতাই হয়ে যাবে। এটা দেশের নির্বাচন তথা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই এ বিষয় নিয়ে বিতর্ক আর এগিয়ে নেয়া ঠিক হবে না। তাতে ভোট নিয়ে মানুষের শঙ্কা বাড়বে। অবশ্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এ সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে যে, ইসি এই ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়ার পথ অনুসরণ করবে না।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/199129