২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১২:৩৮

গণপরিবহনে নৈরাজ্য বাড়ার আশঙ্কা

সিএনজির দাম বেড়েছে ১৬ বছরে ৫৩৭ ভাগ

সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকেরা এমনিতেই মিটারে নির্ধারিত ভাড়ায় গন্তব্যে যেতে চান না। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি নেয়ার অভিযোগ রয়েছে সিএনজিচালিত বাস মালিকদের বিরুদ্ধে। এমন একটি পরিস্থিতিতে গৃহস্থালি ও শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের পাশাপাশি গাড়িতে ব্যবহার্য রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তে গণপরিবহনে নৈরাজ্য আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। গত বৃহস্পতিবার প্রতি ঘনমিটার সিএনজির দাম বর্তমান ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ মার্চ থেকে ৩৮ এবং ১ জুন থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ১৬ বছরে সিএনজির দাম বেড়েছে ৫৩৭ শতাংশ।

পরিবেশ দূষণ থেকে নগরীকে রক্ষার জন্য ২০০০ সালে সরকারি উৎসাহে পরিবহন খাতে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) ব্যবহার শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বাড়তে থাকে সিএনজি স্টেশন, কনভার্সন সেন্টার এবং তেল থেকে গ্যাসে রূপান্তরিত পরিবহন সংখ্যা। বর্তমানে সারা দেশে ৫৯০টি সিএনজি স্টেশন রয়েছে। আর সিএনজিতে রূপান্তরিত গাড়ির সংখ্যা তিন লাখেরও বেশি। শুরুর দিকে প্রতি ঘনমিটার সিএনজির দাম ছিল ৭ টাকা ৪৫ পয়সা, বাড়তে বাড়তে দাঁড়িয়েছে ৩৫ টাকায়। এ দাম বাড়িয়ে ১ মার্চ থেকে ৩৮ এবং ১ জুন থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। নতুন করে সিএনজির দাম বৃদ্ধির ঘোষণায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে জনমনে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ঢাকা শহরে বর্তমানে ৮৭ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক মিটারে নির্ধারিত ভাড়ায় কোনো গন্তব্যে যেতে রাজি হন না। চালকদের ৬৫ শতাংশই যাত্রীর পছন্দের জায়গায় যেতে অস্বীকার করে। বাধ্য হয়ে যাত্রীদের চালকের দাবি করা ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মিটারের চেয়ে ২০ থেকে ৫০ টাকা বেশি ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। এ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষই কার্যকর উদ্যোগ নেয় না। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, নতুন করে সিএনজির দাম বৃদ্ধির অজুহাতে এ অরাজকতা আরো বাড়তে থাকবে।

বিশ্লেষকদের মতে, অতীতে যখনই জ্বালানি তেল ও সিএনজির মূল্য বেড়েছে, তখন যানবাহনের ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সরকার যে পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি করে, সেই হারে পরিবহনের ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এমতাবস্থায় নতুন করে মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণায় সর্বস্তরের মানুষ উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। কারণ ভাড়া বৃদ্ধি পেলে আবারো পরিবহন ও নিত্যপণ্যের বাজারে নৈরাজ্য দেখা দেবে। তারা বলেন, সরকারের উচিত জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া। কোনো বিশেষ কোম্পানির স্বার্থকে নয়। কোম্পানির স্বার্থকে গুরুত্ব দিলে জনগণ ক্ষতির মুখে পড়বে।

তাদের মতে, বর্তমানে সবগুলো গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান লাভজনক অবস্থায় রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের অবস্থায় আনার সুযোগ করতে এ উদ্যোগ নিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তারা। তাদের মতে দেশে গ্যাস নেই কিংবা মজুদ করা গ্যাস ফুরিয়ে আসছে বলে সরকার গ্যাসের ব্যবহার কমাতে দাম বাড়ানোর যে অজুহাত দেখাচ্ছে, তা ভিত্তিহীন। মূল সমস্যা গ্যাসের অনুসন্ধান না হওয়া। ২০১২ সালে সমুদ্র সীমানা নিষ্পত্তির পর মিয়ানমার অসংখ্য অনুসন্ধান চালিয়ে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সরকার কোনো অনুসন্ধানই চালাতে পারেনি।

সিএনজি স্টেশন মালিকদের সংগঠন সিএনজি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর বলেন, মাত্র ১৫ মাস আগে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন সিএনজির যে দাম রয়েছে, তা এ খাতের জন্য সর্বোচ্চ। তাই দাম বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন বা যৌক্তিকতা ছিল না। তার পরও দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়বে। ফলে প্রকৃতপক্ষে সাধারণ জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি অভিযোগ করেন, সরকার দাম বাড়িয়ে পরোক্ষভাবে সিএনজি ব্যবহার বন্ধ করার চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, সিএনজি খাতে দেশের মাত্র ৫ শতাংশের কম গ্যাস ব্যবহার করে সরকারকে ২২ শতাংশের বেশি রাজস্ব দিচ্ছে স্টেশনগুলো। দফায় দফায় সিএনজি মূল্যবৃদ্ধির ফলে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গণপরিবহন আবার তরল জ্বালানিতে ফেরত যাচ্ছে। বায়ু দূষণ রোধের যে লক্ষ্য নিয়ে সিএনজির প্রচলন করা হয়েছিল তা আজ ব্যর্থ হতে চলেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, মূল্যবৃদ্ধি পেলে এর ব্যবহার কমে যাবে এবং তরল জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে বায়ুদূষণের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছবে। তিনি আশা করেন দেশ জনগণ ও পরিবেশের স্বার্থে বিইআরসি সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে গণমুখী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।

অভিযোগ উঠেছে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বছরে অন্তত চার হাজার ১৮৫ কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় হবে। এই রাজস্বের ৮১ শতাংশই সরকারি কোষাগারে জমা হবে। বাকি ১৯ শতাংশ যাবে বিতরণ কোম্পানি পেট্রোবাংলা এবং উৎপাদনকারীদের পকেটে। এর আগে কমিশন দাম বৃদ্ধির সময় বিদ্যুৎ খাতকে বাইরে রেখেছিল। এবার বিদ্যুৎ খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিশন মনে করছে এখন অন্তত ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বিরাট এই অংশ দাম বৃদ্ধির বাইরে থেকে গেলে সার্বিকভাবে রাজস্ব আদায় কমে যাবে। যদিও এই দাম বৃদ্ধি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের ওপর প্রভাব ফেলবে। এতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরের দিনই বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী দেশবাসীকে জানিয়েছেন, বিদ্যুতের দামও শিগগিরই বাড়ছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/198917