২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১২:৩১

মহাজোট সরকারের আমলেই চুলা প্রতি বিল বেড়েছে ৫০০ টাকা

২০১৭ সালে দু’দফা বৃদ্ধির প্রস্তাবে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৯৫০ টাকায়। আড়াই দশকে আবাসিক গ্যাসের দাম বেড়েছে ১২৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি চুলার বেড়েছে ৮৮০ টাকা। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় দ্বিমুখো চুলার বিল ছিল ৪৫০ টাকা। তাদের শাসন আমলেই বেড়েছে ৫০০ টাকা। যদিও মোট সরবরাহকৃত গ্যাসের মাত্র ১৩ শতাংশ যাচ্ছে আবাসিক খাতে। অন্যদিকে গ্যাসের চুলা না জ্বালিয়েও বিল দিতে হচ্ছে কয়েক লাখ গ্রাহককে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জনগণকে এলপি গ্যাসের দিকে ঠেলে দিতেই বিনা কারণে আবাসিক গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সরকার গ্যাস এবং বিদ্যুৎ খাতে বিদ্যুৎ ও এলপি বণিকদের স্বার্থে মানুষকে দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকারের এ মনোভাব পরিবর্তন না হলে অবস্থা এমন হবে সাধারণ গ্রাহকরা আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে এলপি গ্যাস ব্যবহারে বাধ্য হবে।

জানা গেছে, গত দুই দশকে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আবাসিক গ্যাসের দাম। অথচ আবাসিক খাতে গ্যাসের ব্যবহার মাত্র ১৩ শতাংশ। আর এই ১৩ শতাংশ নিয়েই যেন সরকারের মাথা ব্যাথা। এই গ্যাস বন্ধ করতে সরকার নানা কৌশল অবলম্বন করছে। বাকি ৮৭ শতাংশ গ্যাস নিয়ে সরকারের তেমন মাথা ব্যথা নেই।

গত কয়েক বছরে এ বৃদ্ধির হার ছিল অনেক বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ানো হয়েছে আবাসিকে। এতে সাধারণ গ্রাহকদের ওপর চেপেছে দাম বৃদ্ধির বোঝা। এমনকি মার্চ ও জুনে দুই দফা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণাতেও আবাসিকে সর্বোচ্চ হারে বাড়ানো হচ্ছে।

গত সাড়ে তিন বছরে বিভিন্ন খাতের মধ্যে আবাসিকে গ্যাসের মূল্য বেড়েছে সবচেয়ে বেশি হারে। খাতটিতে এ সময়ে গ্যাসের মূল্য বেড়ে হয়েছে শতভাগের বেশি। শিল্প, ক্যাপটিভ, সিএনজিসহ অন্যান্য খাতেও গ্যাসের মূল্য বেড়েছে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি।

আড়াই দশকের হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৯০ সালে দ্বিমুখো চুলার বিল ছিল ৭০ টাকা। ১৯৯১ সালে একমুখো চুলার মাসিক বিল ছিল ১১৫ টাকা। দুই দফা বৃদ্ধির পর ১৯৯৪ সালে এ হার দাঁড়ায় ১৬০ টাকা। অর্থাৎ বিএনপির শাসনামলের পাঁচ বছরে একমুখো চুলায় গ্যাসের দাম বেড়েছে ৪৫ টাকা। আর ওই সময়ে দ্বিমুখো চুলার বিল বাড়ে ৫৫ টাকা। ১৯৯১ সালে এই শ্রেণির গ্রাহকদের গ্যাসের দাম ছিল ১৯৫ টাকা। ১৯৯৪ সালে তা দাঁড়ায় ২৫০ টাকা।

ওই সময় মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ২৬ পয়সা। এতে ঘনমিটারপ্রতি গ্যাসের দাম দাঁড়ায় ২ টাকা ৯০ পয়সা।

এরপর আওয়ামী লীগের শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) একমুখো চুলার ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ৫০ টাকা ও দ্বিমুখো চুলার ক্ষেত্রে ১২০ টাকা। এর মধ্যে ১৯৯৮ ও ২০০০ সালে দুই দফা বাড়ে গ্যাসের দাম। এতে একমুখো চুলার ক্ষেত্রে বিল বেড়ে দাঁড়ায় ২১০ টাকা ও দ্বিমুখো চুলার ক্ষেত্রে ৩৩০ টাকা। আর মিটার গ্রাহকদের ক্ষেত্রে দাম বাড়ানো হয় ঘনমিটারে ৯৫ পয়সা। এতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়ে ৩ টাকা ৮৫ পয়সা।

২০০১-০৬ চারদলীয় জোট সরকারের আমলে একমুখো চুলায় গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫০ টাকা ও দ্বিমুখো চুলায় ৪০০ টাকা। অর্থাৎ আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়ে যথাক্রমে ১৪০ ও ৭০ টাকা। ২০০৫ সালে আবাসিকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪ টাকা ৬০ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটারে ৭৫ পয়সা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর মেয়াদের মধ্যে ২০০৮ সালে সিএনজি গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। সে সময় এটি বাড়িয়ে চারগুণ করা হলেও আবাসিকসহ অন্যান্য খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি।

মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালে সব ধরনের গ্যাসের দাম পুনরায় বাড়ানো হয়। তবে পুরো মেয়াদে শুধু একবারই বাড়ে আবাসিকে গ্যাসের দাম। যদিও যানবাহনে ব্যবহƒত সিএনজির দাম দুই বার বাড়ানো হয়েছিল। সে সময় আবাসিকে এক ও দ্বিমুখী চুলায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ৫০ টাকা হারে। আর মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের বিল বাড়ানো হয় ঘনমিটারে ৫৬ পয়সা। এতে আবাসিকে গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়ায় একমুখো চুলায় ৪০০ ও দ্বিমুখী চুলায় ৪৫০ টাকা। মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৫ টাকা ১৬ পয়সা।

আবাসিকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পুরোনো সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে সরকারের চলতি মেয়াদে। এ সময় মাত্র সাড়ে তিন বছরে আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়ছে চুলাপ্রতি ৫০০ টাকা বা শতভাগের বেশি। এর মধ্যে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ২০০ টাকা বাড়ানো হয়। সে সময় একমুখো চুলার বিল দাঁড়ায় ৬০০ ও দ্বিমুখী চুলায় ৬৫০ টাকা। আগামী মার্চ ও জুনে দুই দফায় আরও ৩০০ টাকা বাড়বে চুলার বিল। এতে জুনে একমুখো চুলার বিল বেড়ে দাঁড়াবে ৯০০ ও দ্বিমুখী চুলায় ৯৫০ টাকা। সে সময় মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের বিল বেড়ে দাঁড়াবে ঘনমিটারে ১১ টাকা ২০ পয়সা। অর্থাৎ সাড়ে তিন বছরে মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের গ্যাসের বিল বাড়ছে ঘনমিটারে ৬ টাকা চার পয়সা।

জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন, সরকার এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা করেছে। এতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়বে বর্তমান মূল্যের প্রায় পাঁচগুণ। ওই কথা মাথায় রেখে এখন থেকেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। অথচ দাম বৃদ্ধির পুরো প্রক্রিয়াটিই অবৈধ। কারণ গত আগস্টে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রতিটি কোম্পানির প্রস্তাবনা বিইআরসির কারিগরি কমিটি নাকচ করে দেয়। এরপরও দাম বাড়ানোও ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

দুই ধাপে দাম বৃদ্ধিকে বিইআরসির আইনের লঙ্ঘন বলে দাবি করে তিনি বলেন, বছরে একবার গ্যাসের দাম বাড়ানো যায়। তবে শর্ত থাকে সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো থেকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা আসতে হবে। অথচ একবারের প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাই করে তিন মাসের ব্যবধানে দুই দফা গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা সম্পূর্ণ বেআইনি। এটি বাতিলে বিইআরসিতে দ্রত আপিল করা হবে।

দাম বৃদ্ধি হলেও গ্যাস পাচ্ছে না রাজধানীর অনেক এলাকা গ্রাহকরা। চুলা না জ্বললেও বিল দিতে হচ্ছে প্রতি মাসে। এতে করে সিলিন্ডার গ্যাসে রান্না করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে ভোগান্তি চরমে উঠেছে।

রাজধানীর মিরপুর-১, মিরপুর ২, ১০ নম্বরসহ কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর ১৪ নম্বরের বিআরপি কলোনি এবং আগারগাঁও তালতলায় তীব্র গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার অনেক স্থানে সকালেই গ্যাস উধাও, রাতে এলেও থাকে অল্প সময়। একই অবস্থা দেখা গেছে দনিয়া, রায়েরবাগ, মোহাম্মদবাগ, ধোলাইপাড়, জিয়ানগর মাতুয়াইলসহ নারায়ণগঞ্জের অনেক এলাকা। অন্যদিকে উত্তরার ৮, ৯, ১০ সেক্টরে, উত্তরখান, দক্ষিণখান, আশকোনা এলাকায় লাইন থাকলেও কোন চুলা জ্বলে না। বাধ্য হয়ে তারা বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করছে। ভবিষ্যতের আশা তারা গ্যাসের চুলার বিল দিয়ে যাচ্ছে তিতাসকে।

জানতে চাইলে আশকোনার বাসিন্দা জহুর আহমেদ খান দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, এলপি গ্যাস আর বিদ্যুৎ ব্যবহার করেই রান্না করতে হচ্ছে। গত এক বছর ধরে কোন গ্যাস পাচ্ছি না। তার পরেও বিল পরিশোধ করছি ভবিষতের আশায়। কারন নতুন করে কোন গ্যাস সংযোগ নেই। এ কারণেই লাইন বিচ্ছিন্ন করছিনা। এ অবস্থা আর কত দিন চলবে জানিনা।

অন্যদিকে গত ছয় মাসের গ্যাসের চুলায় আগুন জ্বলছেনা বছিলা, মোহাম্মদপুর বেড়িবাধ, লালবাগের একাংশে। পুরান ঢাকা কিছু এলাকায়ও রয়েছে গ্যাসের তীব্র সংকট।

মিরপুর ১৪ বিআরপি ৩ নম্বর কলোনির বাসিন্দা নাছরিন আক্তার বলেন, তিন মাস ধরে গ্যাসের সংকটে আছি। সকাল ৭ টার পর চুলা জ্বলে না। দুপুরের রান্না করতে হয় ভোর থেকে। সারাদিন গ্যাস থাকে না। রাত ১০টার পর গ্যাসের চাপ বাড়লেও রাতেই চলে যায়। তবে কয়েকদিন ধরে এমন সমস্যা হচ্ছে, ভোর বা রাতে রান্না করা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে কেরোসিনের চুলা কিনে এনেছি।

এসব এলাকায় রয়েছে তিতাসের কয়েক লাখ গ্রাহক। এসব গ্রাহকরা গ্যাস না জ্বালিয়েও প্রতি মাসে বিল পরিশোধ করছে। আর বিল দিতে বিলম্ব হলে জরিমানাও দিতে হচ্ছে। সেবা না নিয়েও বিল পরিশোধ করে হতবাক গ্রাহকরা। তার উপরে আবার নতুন করে দ’দফায় দাম বৃদ্ধি যেন মরার উপর খারার ঘা।

http://www.dailysangram.com/post/273375