২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১২:১৫

গুমের ঘটনায় অসহায় মানুষ

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

গুম এখন এক বিরাট সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কারণ একবার কেউ গুম হলে তাকে আর ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে। এ পর্যন্ত গুম হওয়া কাউকে পুলিশ উদ্ধার করতে পেরেছেÑ তেমন ঘটনা বিরল। আবার পরিবারের পক্ষ থেকে বেশির ভাগ সময়ই দিন তারিখ উল্লেখ করে বলা হয়, ওই সময় তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন তুলে নিয়ে গেছে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অস্বীকার করে, তারা অমন কাউকে আটক করেনি বা তুলে নিয়ে যায়নি। তার পরের কাহিনী প্রায় একই রকম। হয়তো বছরের পর বছর তাদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না, নয়তো বা কারও মিলছে লাশ, কেউ যাচ্ছে ক্রসফায়ারে। ক্রসফায়ারে যখন কাউকে খুন করা হয়, তখন তার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি লাগে না। সে কাহিনীর পেছনের প্রশ্নগুলোর কোনো জবাব পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে সরকার জবাবদিহিতা চাওয়ার বদলে পুলিশের সুরে সুর মিলিয়ে সাফাই গায়। অসহায় মানুষ আরো অসহায় হয়ে পড়ে।

তথাকথিত জঙ্গিবাদ নির্মূলের নামে এ পর্যন্ত যাদের বিনাবিচারে হত্যা করা হয়েছে, তাদের পরিবারের চোখের পানিই শেষ সম্বল হয়েছে। পুলিশ তাদের সাফল্য দেখাতে এই একটা কাজই দক্ষতার সাথে করতে পেরেছে। তা হলো ক্রসফায়ার। তারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে, এমন দাবি বোধকরি করা যায় না। এই যেমন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর চলে গেছে। এর চার্জ জমা দেয়ার জন্য পুলিশ ৪৬ বার সময় নিয়েছে, কিন্তু তার কোনো কিনারা করতে পারেনি। কিনারা করতে পারেনি নারায়ণগঞ্জের স্কুলছাত্র ত্বকী হত্যার। এখনো কোনো কিনারা করতে পারেনি কুমিল্লা সেনানিবাসে খুন হওয়া কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের। কিনারা হয়নি এসপি বাবুলের স্ত্রী মিতুর হত্যাকাণ্ডেরও। খুঁজলে পাওয়া যাবে এমনি আরো হাজারো ঘটনা। আর এর সব ক্ষেত্রেই পুলিশের কাজের ইতিহাস ব্যর্থতার ইতিহাস।

তবে সম্প্রতি পুলিশ তাদের কাজে বিরাট এক সাফল্য অর্জন করেছে। আর সে সাফল্য হলো, দুষ্কৃতকারীরা একজন আওয়ামীপন্থী লোককে তার প্রাডো জিপসহ গুম করে ফেলেছিল। অপরাধীরা ওই গাড়ির নম্বর প্লেট বদলে নদীতে ফেলে দেয়। পুলিশ গাড়ির ইঞ্জিন নম্বর ও চ্যাসিস নম্বর দেখে গাড়িটি কার ছিল বিআরটিএতে অনুসন্ধান করে তা বের করে ফেলেছে। এই খবর পড়ে যারা ইতোমধ্যে পুলিশের সাফল্য নিয়ে উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন, তাদের জ্ঞাতার্থে বলা যায়, ওই গাড়ির মালিকের কোনো সন্ধান পুলিশ করতে পারেনি। তেমনি খুঁজে বের করতে পারেনি, কারা ওই গাড়ির মালিককে গুম করেছে।

ওই গাড়ির মালিক খন্দকার হেফজুর রহমান আওয়ামী লীগের লোক হলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির কলঙ্কিত নির্বাচনে জাতীয় পার্টির টিকিটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। রিটার্নিং অফিসার তার আবেদনপত্র বাতিল করে দিলে হেফজুর এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ওই আসনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। গত মাসে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় শীতলক্ষ্যা নদীর একটি মাছের ঘের থেকে তার প্রাডো জিপ গাড়িটি উদ্ধার করা হয়। জেলেদের জালে গাড়িটি আটকা পড়েছিল। গাড়িটি উদ্ধার ও শনাক্ত করার পর নিখোঁজ হেফজুর রহমানের স্ত্রী সালেহা বেগমের মনে তার স্বামীকে ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছে। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি কিছু সশস্ত্র লোক তার স্বামীকে অপহরণ করে। সালেহা বেগম তার স্বামীর গাড়িটির সব কাগজপত্র কাপাসিয়া থানা ও সিআইডিকে হস্তান্তর করেছেন। তিনি বলেন, ওই গাড়ির প্রকৃত নাম্বার ‘ঢাকা মেট্রো-ঘ ৫৭৫৬’। কিন্তু গাড়িটি যখন উদ্ধার করা হয় তখন তাতে যে নাম্বার প্লেটটি লাগানো ছিল, তা হলো ‘ঢাকা মেট্রো-ঘ-২০২৯’।

হেফজুরের এক প্রতিবেশীর উদ্ধৃতি দিয়ে সালেহা জানান, ২০১৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর শর্টগানধারী সাত-আটজন লোক তার স্বামী, স্বামীর দুই দেহরক্ষী ও ড্রাইভারকে অপহরণ করে। এ সময় (সন্ধ্যা ৭টা) তিনি তেজগাঁও লিংক রোড দিয়ে গুলশানের দিকে যাচ্ছিলেন। তারা হেফজুরকে জোর করে তার গাড়ি থেকে নামিয়ে আরেকটি গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়। ড্রাইভার মো: শাহ আলম ও দেহরক্ষী ক্যাপটেন (অব.) শওকত ও আবদুল আউয়ালকে হেফজুরের গাড়ির ভেতর রেখে চোখ বেঁধে ফেলে। চালক শাহ আলম সালেহাকে জানান, এরপর আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা গাড়িটি চালিয়ে তাদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি ভবনের দোতলায় নিয়ে হেফজুর রহমানকে একটি কক্ষে এবং অন্য তিনজনকে অপর একটি কক্ষে আটকে রাখে। সেখানে তারা টানা ১৭ দিন বন্দী অবস্থায় ছিলেন। পরে ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ৯টায় অপহরণকারীরা তাদের জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় রেখে যায়।

সালেহা বেগম সাংবাদিকদের জানান, চালক শাহ আলম তাকে ফোন করে ওইসব ঘটনার বর্ণনা দেন। শাহ আলম আরো বলেন, সালেহা প্রয়োজনে যেন তাকে মেরে ফেলেন। কিন্তু এর বেশি যেন আর কিছু তার কাছ থেকে জানতে না চান। তাহলে সেই লোকেরা শাহ আলমের পরিবারকে খুন করে ফেলার হুমকিও দিয়েছে। খন্দকার হেফজুর রহমানের দেহরক্ষীদের ফোন বন্ধ রয়েছে। আর চালকও ওই একবার ফোন করে তার নম্বর বন্ধ করে রেখেছে। সালেহা নিজ উদ্যোগেই চালক শাহ আলমের খোঁজ করেন এবং ২০১৬ সালের ৯ জুন কৌশলে তাকে গুলশান থানায় নিয়ে যান। থানা পুলিশ শাহ আলমের জবানবন্দী ও মুচলেকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। কেন ছেড়ে দিলো। জবানবন্দীতে কী বলেছিলেন শাহ আলম, তা কেন প্রকাশ করা হলো না? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব কারো কাছে নেই।

এ দিকে স্বামীর অপহরণের খবর পেয়ে প্রথমে সালেহা মামলা দায়ের করতে বাড্ডা থানায় যান। সেখানে ব্যর্থ হয়ে তিনি যান গুলশান থানায়। কিন্তু গুলশান থানা মামলা নিতে অজ্ঞাত কারণে অস্বীকার করে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সালেহা সাংবাদিকদের জানান, ‘মামলা নেয়ার বদলে গুলশান থানার ওসি তাকে বরং প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে তার সাহায্য চাইতে পরামর্শ দেন।’ আজব কাণ্ডই বটে! দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু পুলিশ তাকে যেতে বলল প্রধানমন্ত্রীর কাছে! এরপর সালেহা যান চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত গুলশান থানা তার মামলা গ্রহণ করে। পরে সালেহা হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন করেন। হাইকোর্টের প্রশ্নের জবাবে র্যাব প্রধান, পুলিশ প্রধান ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রধান জানান যে, তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছেন। সালেহা ৬৪ জেলার পুলিশ প্রধানকেই তার স্বামীর খবর জানতে চিঠি লেখেন। জবাবে তারা জানিয়েছেন, তার স্বামী হেফজুর রহমান তাদের হেফাজতে নেই। তিনি বলেন, ‘আমি বেশ কয়েকবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও র্যাব প্রধানের সাথে দেখা করে আমার স্বামীর হদিস জানতে চেয়েছি। কিন্তু তারা আমাকে কিছুই জানাতে পারননি। মামলা দায়েরের পর পুলিশ আমাকে সব সময় জানিয়ে আসছে যে, তারা তদন্ত করছেন। তবে আমি কোনো তথ্যই পাইনি।’

১৯৭২-৭৫ সালে ঢাকার আতঙ্ক ছিল সাদা জিপ। এই সাদা জিপে করে যখন যাকে খুশি তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। তারপর পাওয়া যেত লাশ। লাশ গুমের এত কায়দা কানুন বোধকরি তখন ছিল না। তাই লাশ পাওয়া যেত। এখন গুমের অত্যাধুনিক কায়দা বের হয়েছে। ফলে লাশ গুম অনেক সহজ হয়েছে। তার প্রমাণ পাওয়া গেল নারায়ণগঞ্জে র্যাবের লোকদের সাত খুনে। এই যে গুম হয়ে গেছেন চৌধুরী আলম, গুম হয়ে গেছেন ইলিয়াস আলীসহ হাজার হাজার লোক। সন্ধান মিলছে না। লাশও পাওয়া যাচ্ছে না। ১৯৭২-৭৫-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। প্রতিদিন ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে শামসুন্নাহার হল আর জগন্নাথ হলের মাঝখানের জঙ্গলে আমরা লাশ খুঁজতাম। প্রায়ই দেখা যেত গুলিবিদ্ধ কারও লাশ পড়ে আছে। সাদা জিপের লাশ। তার পেছনে একটা নাম বহুল উচ্চারিত ছিলÑ এসপি মাহবুব। এখন নামের সংখ্যা বেড়েছে। সেই দু-একটি সাদা জিপ এখন শত শত সাদা জিপে পরিণত হয়েছে। এসব আপদ শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। যারা মানুষ তুলে নিয়ে যায়, তাদের গাড়িতে র্যাব, ডিবি, পুলিশ লেখা থাকে। তাদের গায়ের জ্যাকেটেও থাকে এসব পরিচয়। তবু এরা অস্বীকার করে, তারা কাউকে ধরেনি। নিখোঁজ মানুষের সন্ধান আর পাওয়া যায় না। জানি না কোনো দিন আর ফেরত পাওয়া যাবে কি না চৌধুরী আলম-ইলিয়াস আলীদের। জানি না আর কোনো দিন ফিরে আসবেন কি না দুই সন্তানের জনক হেফজুর রহমান। তবে এখানেও রহস্য থেকেই গেল। ড্রাইভার শাহ আলমকে পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশ তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যও প্রকাশ করল না। কেন..
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/198838