২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১২:১১

উপমহাদেশে ভাষা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত

এবনে গোলাম সামাদ

(গতকালের পরের অংশ)
এবারের ২১ ফেব্র“য়ারিতে অনেক কথিত প্রগতিশীল বামচিন্তককে বলতে শুনলাম, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষাকে রক্ষা করতে হবে।’ কিন্তু এতে আমাদের কী স্বার্থ? ভারতে বিহার প্রদেশ ভেঙে গঠিত হয়েছে ঝাড়খণ্ড প্রদেশ। ঝাড়খণ্ড প্রদেশে বহু সাঁওতালের বাস। কিন্তু এই প্রদেশের সরকারি ভাষা করা হয়েছে হিন্দি। সেখানে তারা হিন্দিকে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক দাফতরিক ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। ভারতে সাঁওতালরা হিন্দি শিখতে আপত্তি করছে না। সাঁওতালি ভাষা এখন ভারতে আর রোমান বর্ণমালায় লেখা হচ্ছে না। লেখা হচ্ছে হিন্দির মতোই দেবনাগরী অক্ষরে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে সাঁওতালদের সংখ্যা বহুগুণে বেশি। কিন্তু এখানে বলা হচ্ছে সাঁওতালি ভাষাকে সরকারিভাবে রক্ষা করার কথা।

সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভাষার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দেশেই বৃহত্তর ভাষাভাষী মানবসমষ্টির মধ্যে বসবাসকারী ক্ষুদ্র উপজাতি জনসমষ্টিকে শিখতে হয় বৃহত্তর জনসমষ্টির ভাষা। আর ভাষার মাধ্যমে পড়তে থাকে উপজাতি জনসমষ্টির ওপর বৃহত্তর জনসমষ্টির সংস্কৃতির প্রভাব। যেটাকে তারা অস্বীকার করতে পারে না। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে আমরা দেখি, সে দেশে একসময় বাস করত কর্নিশ (Cornish) নামের একটি উপজাতি। তারা কথা বলত কর্নিশ ভাষায়। কিন্তু এখন বিলাতে কর্নিশ উপজাতি আর নেই। তারা ইংরেজি ভাষা শিখে ধীরে ধীরে মিশে গিয়েছে ইংরেজি ভাষাভাষী বৃহত্তর জনসমাজেরই মধ্যে। আমাদের দেশের উপজাতির ক্ষেত্রে এরকম কিছু ঘটা মোটেও অসম্ভব নয়। আসলে উপজাতিরা এখন শিখছে বাংলাভাষা। বাংলা ভাষার মাধ্যমে পাচ্ছে উচ্চশিক্ষা। তাদের পৃথক সংস্কৃতি বজায় রাখা তাই সহজ হচ্ছে না। বাংলাদেশে সাঁওতালদের সাধারণ চালচলন হয়ে উঠছে বাংলাভাষী মানুষেরই মতো। এমনকি, সাঁওতালি ভাষার মধ্যে ঢুকে পড়েছে বহু বাংলা শব্দ। ফলে সাঁওতালি ভাষা আর আগের মতো নেই। এখন বলা হচ্ছে উপজাতি সংস্কৃতি সংরক্ষণের কথা। কিন্তু বাস্তব কারণে সেটা আর হতে পারছে না। বাংলাদেশে কেউ সাঁওতালদের গায়ের জোরে বাংলা শিখতে বাধ্য করছে না। তারা নিজেদের প্রয়োজনেই বাংলাদেশে শিখছেন বাংলা ভাষা। আর গ্রহণ করছেন বৃহত্তর জনসমাজের সংস্কৃতির নানা উপকরণ।

বলা হচ্ছে, আমাদের ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল নাকি সবার মাতৃভাষাকে রক্ষা করা। কিন্তু ১৯৫২ সালে বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষাকে আমরা মাতৃভাষা বলে ভাবিনি। আমাদের বাম বুদ্ধিজীবীরা উপজাতির ভাষাকে তুলনা করতে চাচ্ছেন বাংলা ভাষার সঙ্গে। কিন্তু এরকম তুলনা করা কি আসলেই সঙ্গত? বাংলা ভাষা ছিল একটা খুবই উন্নত ভাষা, যার সঙ্গে কোনো উপজাতির ভাষার তুলনা চলে না। সাবেক পাকিস্তানের মোট জনসমষ্টির মধ্যে বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিল অর্ধেকের বেশি। বাংলাভাষীরা কেন্দ্রীয় সরকারের মোট রাজস্বের অর্ধেকের বেশি প্রদান করেছে। পূর্ব বাংলার পাট, চা ও ছাগলের চামড়া বিক্রি করে তদানীন্তন পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার অর্ধেকের অনেক বেশি অর্জিত হতে পেরেছে। তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিমাংশের মধ্যে স্থলপথে ব্যবধান ছিল এক হাজার ৭০০ কিলোমিটার। আর নৌপথের ব্যবধান ছিল পাঁচ হাজার কিলোমিটার। এই পরিস্থিতিতে সাবেক পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যে হতে পেরেছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। আমরা বাংলাভাষীরা সে সময় কোনো ক্ষুদ্র নৃ-জাতির ভাষার কথা ভাবতে পারিনি। এ যুক্তিও দেখিনি।

বাংলাভাষী মুসলিম কৃষকেরা গলাপানিতে ডুবে পাট জাগ দিয়েছেন। কিন্তু এই ক্ষুদ্র নৃ-জাতিরা তখন কী করেছেন এ দশের অর্থনীতিতে, তাদের অবদান ছিল কতটুকু, এখন এ দেশের অর্থনীতিতে তারা কতটুকু অবদান রাখছেন, এসব আমরা জানি না। কে দেবে তাদের মাতৃভাষা রক্ষার খরচ? তারা যদি সংখ্যায় অনেক বেশি হতেন, তবে তাদের করের টাকা দিয়ে তাদের মাতৃভাষা রক্ষার ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু তাদের সংখ্যা তা নয়। শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্র“য়ারি রাঙ্গামাটি যেয়ে এক সভায় বলেছিলেন, ‘সবাইকে হতে হবে বাঙালি।’ কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ যেন সরে যেতে চাচ্ছে মুজিবের এই নীতি থেকে। এর ফলে বাংলাদেশের শতকরা কম করে হলেও ১০ ভাগ জমি হয়ে যেতে পারে হাতছাড়া। আমি তাই এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে অনুরোধ রাখতে চাই, এ ধরনের নীতি জাতীয় স্বার্থেই গ্রহণ না করা উচিত।

চাকমারা এখন সাহিত্যচর্চা করছেন বাংলা ভাষার মাধ্যমে। তারা শিল্পকলার চর্চা করছেন বাংলাদেশের অন্যান্য মানুষেরই মতো। শিক্ষা-দীক্ষায় অন্য উপজাতিদের তুলনায় তারা হয়ে উঠেছেন খুবই অগ্রসর। উপজাতি সংস্কৃতি সংরক্ষণের দাবি যতটা না করা হচ্ছে বাস্তব কারণে, তার চেয়ে বেশি করা হচ্ছে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যেটাকে আমরা সমর্থন দিতে পারি না।

ঢাকায় থাকি না। সারা দেশের খবরও রাখি না। তবে রাজশাহী শহরে দেখলাম, বেশ ঘটা করে ২১ ফেব্র“য়ারি পালিত হতে। অনেকে বললেন, ২১ ফেব্র“য়ারি আজ কেবল বাংলাদেশের নয়, তা এখন সারা বিশ্বের। কেননা ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে এটাকে ঘোষণা করা হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। জানি না, দিবসটি আর কত বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হতে পারবে। কেননা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস থেকে নাকি আইন পাস হতে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র আর জাতিসঙ্ঘে থাকতে পারবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি জাতিসঙ্ঘে না থাকে, তবে জাতিসঙ্ঘ মনে হয় বিলুপ্ত হবে। আর সেই সাথে বিলুপ্ত হবে জাতিসঙ্ঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কো। আমরা জানি, লিগ অব নেশনস বিলুপ্ত হওয়ার কথা। সেই সাথে তার অঙ্গসংগঠনগুলো বিলুপ্ত হওয়ার কথা। অনুরূপ কিছু ঘটতে পারে নিকট ভবিষ্যতে। ১৯৪৬ সালে গঠন করা হয় জাতিসঙ্ঘের অন্যতম অঙ্গসংগঠন UNESCO (United Nations Education, Scientific and Cultural Organization)| ইউনেস্কো নামটা বেশ গোলমেলে। এতে শিক্ষা (Education), বিজ্ঞান (Science) ও সংস্কৃতি (Culture) কে আলাদা আলাদাভাবে দেখা হয়েছে। বলা হয়নি কাকে বলব শিক্ষা, কাকে বলব বিজ্ঞান আর কাকে বলব সংস্কৃতি। সব দেশের পরিস্থিতি এক নয়। প্রত্যেক দেশের আছে নিজ নিজ শিক্ষানীতি। সব দেশ বিজ্ঞানে অগ্রসর নয়। ইউনেস্কো সব দেশের বিজ্ঞান চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে সক্ষমও নয়। আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বলতে গেলে এর কোনো নীতিই নেই। তাই এই সংগঠনটির কোনো প্রয়োজনীয়তা এখন আর অনুভূত হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) প্রয়োজন আছে। বিশ্ব কৃষি সংস্থার (FAO) ও প্রয়োজন আছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) কিছু কিছু কাজ করছে, যা শ্রমজীবী মানুষকে দিচ্ছে শ্রমের অধিকার। কিন্তু ইউনেস্কো তেমন কোনো কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর বক্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছেÑ সুন্দরবনের নরখাদক বাঘ, কুমির ও বিষধর সর্প রক্ষা করা। বলা হচ্ছে, সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশ নাকি থাকবে না। কিন্তু সুন্দরবনের বয়স খুব বেশি নয়। খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর আগে এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না।

বিখ্যাত ঐতিহাসিক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এখন যেখানে সুন্দরবন, সেখানে ছিল সমৃদ্ধ জনপদ। কিন্তু হঠাৎ বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে মাটি ধসে নিচু হয়ে যায়, যার কারণ জানা যায়নি। ধ্বংস হয়ে যায় সমৃদ্ধ জনপদ। জনশূন্য জায়গায় গড়ে ওঠে দুর্গম বন। তার কথাকে অনেকেই সমর্থন করেন। কেননা সুন্দরবনের অনেক জায়গায় মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে মন্দির ও ইমারতের ধ্বংসাবশেষ। পাওয়া গিয়েছে ঘাট বাঁধানো পুষ্করিণীর নিদর্শন। অনেক জায়গায় পাওয়া গিয়েছে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের গুঁড়ির সারি। কিন্তু ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞরা মানতে চাচ্ছেন না ইতিহাসের এসব সাক্ষ্য। এই বিশেষজ্ঞরা আসলেই কতটা প্রাজ্ঞ তা নিয়ে অনেকের মনে জাগছে জিজ্ঞাসা।

বাংলাদেশে দক্ষিণে সমুদ্রে পড়ছে চর। সুন্দরবন ক্রমেই সরে যাচ্ছে দক্ষিণে। সুন্দরবন তাই অচিরেই বিলুপ্ত হবে বলে ভাবার কোনো কারণ নেই। সব দেশেই বনের প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশেরও আছে। এখন বনের গাছ যেমন কাটা হয়, বন বিভাগ থেকে তেমনি আবার লাগানো হয় গাছের চারা। হতে পারে তাই বনভূমির নবায়ন। বনভূমি আসলে পড়ে FAO-এর কার্যতালিকায়, UNESCO-এর কার্যতালিকায় নয়। আমি জানি না, কেন আমাদের দেশের কথিত বহু বুদ্ধিজীবী এবং স্বনামধন্য অধ্যাপকেরা ইউনেস্কো নিয়ে এতটা উল্লাস প্রকাশ করতে চাচ্ছেন। ইউনেস্কোর জন্মের বহু আগে থেকেই বাংলা ভাষা তার রস সাহিত্যের জন্য বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছে। ইউনেস্কোর জন্য বাংলা ভাষার বিশ্বখ্যাতি বাড়ছে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস যাদের জানা আছে, তারা কখনোই ভাবতে পারেন না যে, বাংলা ভাষার গৌরব বাড়ছে ইউনেস্কোর কারণেই।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/198839