প্রতি বছরই বাড়ছে জাতীয় বাজেটের আকার। বাজেটের লক্ষ্য পূরণে বাড়ছে করের বোঝাও। আগামী অর্থবছরে বাজেট হবে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি। বিগত বাজেটের তুলনায় চলতি বছর বাজেটের আকার বেড়েছে ২৯ শতাংশ। চলতি বছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আভ্যন্তরিণ আয় করতে হবে ২ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এতে উন্নয়ন বাজেট ধরা হয়েছে এক লাখ কোটি টাকা। ৩১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে করদাতা ও করের হার বাড়ানোসহ বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। করের জাল যত বিস্তার হচ্ছে মানুষের উপর হয়রানি তত বাড়ছে।
সেবা খাতে কিছু সুবিধা দিয়ে কোনো কোনো খাতে আবার ভ্যাটের আওতা বাড়িয়েছে সরকার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এই বাজেটটি মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট। দেশীয় কোনো কোনো শিল্পে প্রণোদনার কথা বলা হলেও তৈরি পোশাক শিল্পে উৎসকর হার বাড়ানো হয়েছে। বিশাল ব্যয়ের বাজেট বাস্তবায়নের ঝুঁকি রয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে ধীর গতি আর রাজস্ব আদায় লক্ষ্যের চেয়ে কম হওয়া প্রতিবছরের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও অর্থমন্ত্রী মনে করেন, অর্থনীতির আকার বেড়েছে, ফলে বাজেটের আকারও বাড়াতে হবে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের বাজেট হবে প্রায় ৪ লাখ কোটি 1
যদিও সহজ আদায়ের উপায় হিসেবে ভ্যাট খাত থেকেই আদায় করবে বেশি। অবশ্য বহুল আলোচিত নতুন ভ্যাট আইনের কার্যকর পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে বিদ্যমান ভ্যাটের হার ও আওতা বাড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে আয়কর ও শুল্ক কাঠামোতেও বেশকিছু পরিবর্তন আসছে। ফলে উদ্যোক্তাদের উপর নতুন চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ভ্যাট ও আয়করে ভর করে সরকার এযাবত্কালের সর্বোচ্চ হারে রাজস্ব আদায় করতে চায়। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেশীয় অর্থায়নে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। বিশ্লেষকরা বলছেন, আয় ও ব্যয়ের এ বিশাল বাজেট বাস্তবায়নই প্রতি বছরের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে।
নতুন আইনে ঢালাওভাবে সব ধরনের পণ্য, সেবাসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের সাথে এনবিআরের দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে। সরকার নতুন আইনে প্যাকেজ ভ্যাট উঠিয়ে দেয়ার ঘোষণায় সারা দেশে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আন্দোলনে নামে। এমনকি তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাজপথে ধর্মঘট পালন করে। কিন্তু তাতে অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। একইভাবে দেশে পাদুকা ব্যবসায়ীরা এই ভ্যাট আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে।
ব্যবসায়ীরা আমাদের ব্যবসা নেই তারপরেও সরকার প্রতিবছর নানাভাবে ভ্যাট আদায়ের নামে হয়রানি করছে। দেশের প্রতিটি সেবা খাত আজ ভ্যাটের আওতায় আনা হচ্ছে। অথচ সাধারণ জনগণ কোন ধরনের সেবা পাচ্ছে না। উন্নয়ন বাজেটের নামে লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও দৃশ্যত তেমন কোন উন্নয়ন নেই। এতে করে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
প্রতিনিয়তই সরকার বাজেটের আকার বাড়াচ্ছ্ েএতে করে অভ্যন্তরিণ আয়ও বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে এনবিআর। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্র পুরনে এনবিআর সব সেবা প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনছে। আর এতে করে জনগণের উপর নানাভাবে করের বোঝাও চাপছে।
নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি বাজেট পূর্বের তুলনায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি হতে পাবে। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ হারে বাজেটের আকার বাড়ছে। এতে করে অতিমাত্রায় জনগণের উপর করের বোঝা বাড়ছে।
তৈরি পোশাক খাতসহ সব ধরনের রপ্তানি খাতের উপর করের চাপ বাড়তে যাচ্ছে। বর্তমানে সব ধরনের রপ্তানির উপর শূন্য দশমিক ৬০ (০.৬০%) শতাংশ হারে উৎসকর রয়েছে। বর্তমান বাজেটে এটি ১ শতাংশ করা হয়েছে। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, এ খাতের উপরকর বাড়ানো হলে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
এবারের বাজেটের আকার হচ্ছে ৩ লক্ষ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। আর আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ লক্ষ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট বাজেটের প্রায় ২৯% তথা ৯৭ হাজার ৮ শত ৫৩ কোটি টাকা ঘাটতি থাকছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের বাজেটও একই প্রকৃতির। এর বরাদ্দ পূর্বের বছরের তুলনায় ২৯% বেশি। কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূর্বের চেয়ে ৫০ হাজার কোটিরও বেশি, তারপরও প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার বিশাল ঘাটতি।
চলতি বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। এর মধ্যে বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে ৩০,৫০০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৭,৫০০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ১৯,৫০০ কোটি টাকা। এবারের বাজেটের অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। এডিপিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৩১ শতাংশ বেশি, যা বর্তমান মন্দা অর্থনীতির মধ্যে অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। যদিও অতীতে কখনও ১৯ শতাংশের বেশি রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়নি। চলতি বছরের বিশাল বাজেট বাস্তবায়ন করাই হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এনবিআর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজস্ব আহরণে করের হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীও করের আওতা বাড়ানোর পক্ষে। ফলে প্রতি উপজেলায় কর অফিস স্থাপন ও বাড়িওয়ালাদের করের আওতায় আনাসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সামর্থ্যবান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনতে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় অফিস স্থাপন করা হবে। বর্তমানে ৬২ উপজেলায় কর অফিস রয়েছে। খুব শিগগির বাকি ৪২৬টি উপজেলাতে কর অফিস স্থাপন করা হবে।
বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীরা মূল বেতনের ওপর কর দেন; কিন্তু ভাতা করমুক্ত। তাদের ভাতাও করের আওতায় আসতে পারে। এ বিষয়েও প্রস্তাবনা দিয়েছে এনবিআর। এছাড়া ঢাকাসহ বিভাগীয় শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবাসরত সামর্থ্যবান করদাতাদের বছরে সর্বনিম্ন ৩ হাজার টাকা, জেলা শহরে বসবাসকারীদের ২ হাজার টাকা ও অন্যান্য এলাকায় বসবাসকারীদের ১ হাজার টাকা কর দিতে হয়। করের এ ৩ স্তর ও সর্বনিম্ন করের হার আগামী অর্থবছর থেকে সর্বনিম্ন ৪ হাজার টাকা কর হার নির্ধারণ করা হয়েছে।
এই সরকারের আমলে একজন কৃষকও করের আওতামুক্ত নয়। দেশে প্রতিটি কৃষকই এখনও মোবাইল ব্যবহার করে থাকেন। আর মোবাইলের কলচার্জ এবং ভ্যাট কর্তন করা হচ্ছে। অথচ সরকার বলছে তারা তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন করবে। এবারের বাজেটের পর এ খাতে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর বসতে পারে। চাল, গম, ভুট্টা বীজ, সানফ্লাওয়ার অয়েল, চিনি, ন্যাপথা, পেট্রোলিয়াম পণ্য, ঝুট, এমএস রড, কম্পিউটার অ্যাক্সেসরিস, মোবাইল সেট, মডেম, রাউটারসহ আরও বেশকিছু পণ্য আমদানিতে অগ্রিম আয়কর বসতে পারে। এর পাশাপাশি সব ধরনের ব্র্যান্ডের বিড়ি-সিগারেটের ওপরও শুল্ক করহার বাড়ানো হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বড় বাজেট হলেও মাথাপিছু বরাদ্দ খুবই কম। সে হিসাবে বাজেটের আকারকে খুব বেশি বড় বলা যাবে না। তবে চলতি অর্থবছরের চেয়ে বাজেটের আকারকে সরকার অতি উচ্চাভিলাষী মাত্রায় নিয়ে গেছে।
জানা গেছে, গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এনবিআর রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হয়নি। তার পরেও বিশাল বাজেট ঘোষণা করছে সরকার। চলতি বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য চলতি বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কাঁটছাঁট করাও হতে পারে ২৯ শতাংশ মত। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন ভালো হওয়ার কারণে এনবিআর আশা করছে, আগামী বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হবে। তাঁরা বলছেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আদায়ের নতুন নতুন খাত বের হয়ে আসায় রাজস্ব আদায় বাড়বে।
আগামী বাজেট সামনে রেখে অর্থ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। চলতি বাজেটের চেয়ে আগামী বাজেটের আকার বড় করতে রাজস্ব প্রাপ্তি বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করতে যাচ্ছে সরকার। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে পারে ৩ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। তবে কম বেশি হতে পারে। এখনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।