৩০ ডিসেম্বর ২০১৬, শুক্রবার, ৪:০৯

কমেনি শ্রমিক অসন্তোষ: আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান দাবি

র্যাব, পুলিশ, শিল্প পুলিশ ও বিজিবির উপস্থিতিতে আশুলিয়ার বন্ধ কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। শ্রমিকদের উপস্থিতিতে কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে কারখানাগুলো। ১০ লাখ শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকাটি ফিরে পেয়েছে চিরচেনা রূপ। তবে আপাতদৃষ্টিতে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে মনে হলেও শ্রমিক অসন্তোষ রয়েই গেছে বলে জানান বিশ্লেষকেরা। জোর করে শ্রমিক অসন্তোষ বেশি দিন ঠেকিয়ে রাখা যায় না মন্তব্য করে তারা বলেন, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা না হলে যেকোনো সময় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।
বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিক নেতা ও কারখানার মালিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, আশুলিয়ার শ্রমিক বিক্ষোভকে কেবলই ‘ষড়যন্ত্রকারীদের উসকানি’ বলে চালিয়ে দেয়ার যে মানসিকতা সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা মালিকপক্ষ থেকে দেখানো হচ্ছে, তাতে সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হবে না। তা ছাড়া দুই বছরের মধ্যে মজুরি বাড়ানোর সুযোগ নেই মর্মে শ্রম প্রতিমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন সেটিও মেনে নিতে পারছেন না শ্রমিকেরা। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাপের মুখে তারা আন্দোলনের পথ থেকে সরে গিয়ে কাজে যোগদান করেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় আবারো চরম পরীক্ষায় পড়েছে দেশের তৈরী পোশাক শিল্প খাত। তাজরীনে অগ্নিকাণ্ড, রানা প্লাজা ধস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা হারানো, একের পর এক বিদেশি নাগরিক খুন এবং সর্বশেষ গুলশানের হোলে আর্টিজান বেকারিতে হত্যাকাণ্ডের পর নতুন করে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে রফতানি আয়ে ৮২ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী এ খাতটি। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে পাঁচ দিন বন্ধ রাখা হয় ৫৯টি কারখানা। একপর্যায়ে কারখানা খুলে দেয়া হলেও শ্রম আইনের ১৩(১) ধারা অনুযায়ী বন্ধ থাকাকালীন শ্রমিকদের মজুরিও বন্ধ থাকবে বলে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান যে ঘোষণা দিয়েছেন তাতে চরম ুব্ধ সাধারণ শ্রমিকেরা। তাদের অভিযোগ, কারখানা বন্ধ করেছে মালিকপক্ষ। তাতে শ্রমিকেরা কেন ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
শ্রম আইনের একটি ধারাকে ব্যবহার করে কারখানা বন্ধ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদও। আশুলিয়ার পোশাক কারখানাগুলো হঠাৎ করে এভাবে বন্ধ করা ঠিক হয়নি মন্তব্য করে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমি চেয়েছিলাম কারখানা চালু হোক। তারপর সবাই মিলে শ্রমিকদের সমস্যার সমাধান করব। কিন্তু কারখানা মালিকেরা শ্রম আইনের ১৩ এর ১ ধারা অনুযায়ী কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। শ্রমিকেরাও তাদের কথা রাখেননি। নৌমন্ত্রীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে শ্রমিকেরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অথচ তারা তাদের কথা রাখেনি।
শ্রমিকদের মনোকষ্টের সবচেয়ে বড় কারণ শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর একটি ঘোষণা। গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে আয়োজিত গার্মেন্টবিষয়ক ক্রাইসিস কোর কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আপাতত পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। দেশে ৫৩০টি ট্রেড ইউনিয়ন ও ৪৩টি ট্রেড ফেডারেশন চালু আছে। তাদের কারো কাছ থেকে এ জন্য কোনো আবেদন জানানো হয়নি। তবে কেউ ব্যক্তিগতভাবে আবেদন করলে তার দায় আমাদের নয়। প্রতিমন্ত্রী বলেন, তিন বছর আগে তাদের জন্য ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা করা হয়। ওই ঘোষণার পাঁচ বছর পূর্ণ হলে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব বিবেচনা করা হবে।
শ্রমিকদের যারা ভুল বুঝিয়ে রাস্তায় নামিয়েছে তাদের খোঁজা হচ্ছে জানিয়ে চুন্নু বলেন, শ্রম আইনানুযায়ী কারখানার মালিক যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এর বাইরে মালিকেরা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না, তা আমার জানা নেই। আমি এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখব। আশুলিয়া এলাকায় বাড়িভাড়া না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এটি অঞ্চলভিত্তিক সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার সিদ্ধান্ত নিলে সারা দেশের জন্যই এমন ব্যবস্থা করা হবে।
মজুরি বৃদ্ধি, বিনা কারণে শ্রমিক ছাঁটাই না করা, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি না করাসহ ১১ দফা দাবিতে শ্রমিকেরা গত ১১ ডিসেম্বর থেকে আন্দোলন করে আসছিলেন। গত সোমবার থেকে কারখানাগুলো খোলা হলেও শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার বিষয়টি আমলেই নিতে রাজি নন সরকার বা মালিকপক্ষ। উল্টো বিজিএমইএ নেতাদের দাবি, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে তারা প্রতিদিন গড়ে ৮০ কোটি টাকা তির সম্মুখীন হয়েছেন। সে হিসেবে ১৫ দিনে শিল্পের ক্ষতি প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। শ্রমিক অসন্তোষের মুখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে ২০ ডিসেম্বর ৫৫টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল বিজিএমইএ।
আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় প্রায় এক হাজার জনকে আসামি করে ফাউনটেন, এনআরএন, দ্য রোজ ড্রেসেস, উইন্ডি গ্রুপ ও হামীম গ্রুপ কারখানা কর্তৃপ এবং পুলিশের প থেকে দু’টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় আটজন শ্রমিক নেতা, ১০ জন শ্রমিক, একজন অভিনেতা, স্থানীয় একজন সাংবাদিক ও সাভার উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিনিসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। উসকানি মামলায় প্রধান আসামি করা হয় সাবেক সংসদ সদস্য ও ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি ডা: দেওয়ান মো: সালাউদ্দিন বাবুকে। বরখাস্ত করা হয় ১২০ জন শ্রমিককে। মোতায়েন করা হয় ১০ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্য।
স্কপসহ গার্মেন্টসংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংগঠন এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো দমনমূলক পদক্ষেপ না নিয়ে শ্রমিকদের দাবি যৌক্তিকভাবে বিবেচনার কথা বলছেন। যাতে দ্রুত মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক আন্তরিক হয়।
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/183029