২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ৯:৪৪

গ্যাসের দাম এবং মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা

আশিকুল হামিদ

রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানোর এবং লক্ষ-হাজার কোটি টাকার অংকে বাজেট চাপিয়ে দেয়ার মতো যে কয়েকটি মাত্র বিষয়ে বর্তমান সরকার ‘সফল’ হয়েছে সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে দাম বাড়ানো। এ ব্যাপারেও সরকার সব সময় আগে থেকে হইচই ফেলে দেয়ার বিচিত্র কৌশল অবলম্বন করে এসেছে। গ্যাসের কথাই ধরা যাক। ‘বাঘ এলো, বাঘ এলো’ ধরনের শোরগোল শোনানো হচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। হাতেগোনা কিছু বিশেষজনকে নিয়ে গণশুনানিসহ নানা ধরনের নাটকীয়তার মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হয়েছে। কৌতূহলোদ্দীপক তথ্যটি হলো, গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারীরাও মূল্য বাড়ানোর ব্যাপারে একমত পোষণ করেননি। অধিকাংশই বরং বিরোধিতা করেছেন। অন্যদিকে নিজের ইচ্ছামতোই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিইআরসি। যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ দেখাতে না পারলেও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে সংস্থাটি।

নতুন মূল্য কার্যকর করার ক্ষেত্রেও নাটকীয়তার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। চক্ষুলজ্জা বা অন্য যে কারণেই হোক, এক ধাপে না বাড়িয়ে দুই দফায় দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন কর্তা ব্যক্তিরা। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে তারা জানিয়েছেন, প্রথম ধাপে আগামী মার্চ থেকে এক চুলার জন্য ৭৫০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৮০০ টাকা দিতে হবে। এর ফলে এক চুলার জন্য শুধু নয়, দুই চুলার জন্যও মানুষকে ১৫০ টাকা বেশি গুণতে হবে। এ পর্যন্ত এসেও থেমে যায়নি বিইআরসি। কর্তা ব্যক্তিরা আগাম জানিয়ে রেখেছেন, তিন মাস পর জুন থেকে আবারও বেড়ে যাবে গ্যাসের মূল্য। তখন এক চুলার জন্য ৯০০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৯৫০ টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ কিছুটা ভদ্রতা দেখিয়ে গ্যাসের দাম আসলে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ৬০০ টাকার স্থলে ৯০০ টাকা এবং ৬৫০ টাকার স্থলে ৯৫০ টাকা করা হলে হিসাবটা সেরকমই দাঁড়ায়। পার্থক্য হলো, বিইআরসি একবারে উল্লম্ফন দেয়নি!

বলা দরকার, আবাসিক গ্রাহকদের পাশাপাশি অটোরিকশা ও কারসহ সিএনজি চালিত সকল যানবাহনের ক্ষেত্রে তো বটেই, শিল্প-কারখানার ক্ষেত্রেও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে আনুপাতিক হারে। এসবের হিসাব ২৪ ফেব্রুয়ারির সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তি দেখানোর ব্যাপারে কর্তা ব্যক্তিরা অবশ্য কসরত যথেষ্টই করেছেন। মূল কথায় তারা বলেছেন, দেশে গ্যাসের মজুদ দ্রুত কমতে থাকায় সরকারকে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে। কিন্তু প্রতি মিলিয়ন ঘনফুট তিতাস গ্যাসের দাম যেখানে দুই দশমিক চার মার্কিন ডলার সেখানে এলএনজির দাম পড়ে যাচ্ছে প্রায় নয় ডলার। দুটি মিলিয়ে প্রতি মিলিয়ন ঘনফুটে দাম পড়ছে চার থেকে পাঁচ মার্কিন ডলার। ফলে ঘাটতি হচ্ছে দুই দশমিক পাঁচ ডলার। সমন্বয়ের পাশাপাশি এই ঘাটতি পূরণই নাকি বর্তমান পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্য!

খবরে আরো কিছু তথ্যও জানা গেছে। যেমন গ্যাস বিতরণের কাজে নিয়োজিত সব কোম্পানি লাভে থাকলেও কোম্পানিগুলো এতদিন বিদ্যমান মূল্যের তুলনায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল। কোনো কোনো কোম্পানি এমনকি ১৫০ থেকে ২৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর জন্যও চাপ দিয়েছে। কিন্তু কোনো কোম্পানি নিজেদের দাবির পক্ষে গ্রহণযোগ্য যুক্তি দেখাতে পারেনি। তা সত্ত্বেও বিইআরসি কোম্পানিগুলোর জানানো দাবিকেই মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে অজুহাত হিসেবে তুলে ধরেছে। সেই সাথে এনেছে সমন্বয় এবং ঘাটতি পূরণের খোঁড়া যুক্তি।

আমরা কিন্তু গ্যাসের দাম বাড়ানোর এসব যুক্তিকে সমর্থনযোগ্য মনে করি না। এর কারণ, পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাসাবাড়িতে তথা আবাসিক খাতে মোট উৎপাদিত গ্যাসের মাত্র দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ ব্যয়িত হয়। সে কারণে আবাসিক খাতে মূল্য বাড়ানোর কোনো অজুহাতই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রাসঙ্গিক দ্বিতীয় তথ্যটি হলো, কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি দেশে উত্তোলিত বিপুল পরিমাণ গ্যাস বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এর ফলেই আসলে দেশের অভ্যন্তরে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যক্রমও প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ, বিভিন্ন উপলক্ষে জনগণকে বোতলজাত করা এলপি গ্যাস বাসাবাড়িতে ব্যবহার করার পরামর্শ শুনতে হয়েছে। এই পরামর্শ ‘খয়রাত’ করেছেন কোনো কোনো মন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনরা। বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, এলপি গ্যাস ব্যবহারের পক্ষে সরকারের প্রচারণা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অনুসন্ধানেও তেমন কিছু তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। জানা গেছে, বেশ কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানি বহুদিন ধরে বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজি ও এলপি গ্যাস বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করছে। বলা হচ্ছে, মূলত তাদের স্বার্থেই সরকার এলএনজি ও এলপি গ্যাসের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে, জনগণ যাতে আবাসিক খাতে এই গ্যাস ব্যবহার করে এবং কোম্পানিগুলো যাতে যথেচ্ছভাবে মুনাফা লুণ্ঠন করতে পারে।

বর্তমান পর্যায়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পেছনেও রয়েছে একই উদ্দেশ্য। বিইআরসির মাধ্যমে সরকার এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে চাচ্ছে, জনগণ যাতে বেসরকারি কোম্পানগুলোর কাছ থেকে এলএনজি ও এলপি গ্যাস কিনতে বাধ্য হয়। প্রসঙ্গক্রমে এখানে ক্ষমতাসীনদের মনোভাব সম্পর্কে একজন প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য উল্লেখ করা দরকার। গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চমৎকার এক যুক্তি তুলে ধরেছিলেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। মাত্র মাস দুই আগে, গত ডিসেম্বরে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, সাধারণ মানুষ নাকি গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ পায় না। গ্যাস নাকি ব্যবহার করে দেশের সুবিধাভোগী একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী। যেহেতু এই সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর কারণে সাধারণ মানুষ গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত রয়েছে সেহেতু ওই গোষ্ঠীর ওপর বর্ধিত মূল্য চাপানোর ক্ষেত্রে আপত্তির কোনো কারণ থাকতে পারে না! মানতেই হবে, মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে এ এক ‘খাসা’ যুক্তিই বটে!

অন্যদিকে আমাদের আপত্তি ও প্রতিবাদের কারণ হলো, বর্তমান সরকারের আমলে দলবাজ ও বিশেষ একটি চাটুকার শ্রেণীর হাতে চাঁদা ও কমিশনসহ নানাভাবে টাকার পাহাড় জমা হলেও সাধারণ মানুষের জন্য চাকরি ও ব্যবসার মতো কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি বললেই চলে। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার বরং ক্রমাগত অবনতি ঘটেছে। তারা শেয়ার বাজারে লুণ্ঠিত হয়েছে, সঞ্চয়ী হিসাব থেকে মুনাফার হার কমিয়ে ব্যাংকিং খাতেও তাদের বঞ্চিত ও বিপন্ন করা হয়েছে। তাদের আয়-রোজগার অনেক কমে গেছে। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে বিশেষ করে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য গ্যাসের দাম প্রায় ৫০ ভাগ বাড়ানোর অর্থ আসলে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো নিষ্ঠুরতার নামান্তর মাত্র। একই কারণে আমরা সিদ্ধান্তটির বিরোধিতা করি।

এখানে অন্য কিছু তথ্যেরও উল্লেখ করা দরকার। যেমন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপর, ২০০৯ সালের জুলাই থেকে মাত্র কিছুদিন আগে পর্যন্তও অবাসিক খাতে গ্যাসের নতুন সংযোগ দেয়া বন্ধ ছিল। তাছাড়া অতি সম্প্রতি কিছু কিছু মিল-কারখানায় সংযোগ দেয়া শুরু হলেও চাহিদার তিন ভাগের এক ভাগ গ্যাসও সরবরাহ করা হচ্ছে না। পাম্পগুলোতে বহুদিন ধরেই ছয় ঘণ্টার রেশনিং চালু করা রয়েছে। বাসাবাড়িতেও ঠিকমতো গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এমন অবস্থার মধ্যেও গালগল্পের মাধ্যমে জনগণকে শুধু নতুন নতুন গ্যাস কূপ আবিষ্কারের কথাই শোনানো হচ্ছে না, এ ঘোষণাও দেয়া হচ্ছে যে, গ্যাসের উৎপাদন নাকি সাড়ে চারশ থেকে পাঁচশ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত বেড়ে গেছে! প্রতিদিন নাকি দুই থেকে আড়াই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত উৎপাদন করা হচ্ছে! মাঝেমধ্যে আবার গ্যাসের নতুন মজুত আবিষ্কারের সুখবরও শুনিয়েছেন কর্তাব্যক্তিরা। অন্যদিকে বাস্তব পরিস্থিতি যে মোটেও আশান্বিত হওয়ার মতো নয় তার প্রমাণ তো মূল্য বাড়ানোর সর্বশেষ সিদ্ধান্তই।

আমরা মনে করি, মজুদ ও উৎপাদনের ভিত্তিহীন তথ্য-পরিসংখ্যান দেয়ার এবং ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত সংকট কাটিয়ে ওঠার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া। উৎপাদন যদি সত্যি বেড়ে থাকে তাহলে শীতের মতো কোনো অজুহাতে সংযোগ বন্ধের সিদ্ধান্ত এবং সরবরাহের তীব্র সংকট গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ, সংকটের ফলে শত শত শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শিল্প-কারখানার সংকট অবশ্যই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। গ্যাস না পাওয়ায় চালু কারখানাগুলোকে বেশির ভাগ সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে, সরকার সংযোগ দিচ্ছে না বলে নতুন কোনো কারখানাও চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। ওদিকে রয়েছে লোডশেডিং-এর উৎপাত। যখন গ্যাস পাওয়া যায় তখন বিদ্যুৎ থাকে না আবার বিদ্যুৎ যখন পাওয়া যায় তখন গ্যাস থাকে না। এমন অবস্থায় কোনো শিল্প-কারখানাতেই চাহিদা ও ক্ষমতা অনুযায়ী পণ্যের উৎপাদন করা যাচ্ছে না। নির্ধারিত সময়ে পণ্য পৌঁছাতে না পারায় অনেক অর্ডার বাতিল হয়ে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে রফতানি আয়ে। আয় শুধু কমছেই।

একই গ্যাসের কারণে দেশের ভেতরেও গতি হারিয়েছে অর্থনৈতিক কর্মকা-। ফলে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ার পরিবর্তে কমেছে। এমন অবস্থায় জাতীয় অর্থনীতি একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ার আগেই সরকারের উচিত উৎপাদন বাড়িয়ে বাসাবাড়িতে তো বটেই, শিল্প-কারখানাতেও নতুন সংযোগ দেয়া এবং চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো। কেবলই দাম বাড়ানো কোনো সমাধান হতে পারে না। বিইআরসি তথা সরকারের বরং উচিত বিশেষ করে আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসা। শিল্প-কারখানাসহ অন্য ক্ষেত্রগুলোতে বাড়াতে হলে বৃদ্ধির হারকে অবশ্যই এমন সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে, শিল্প মালিকরা যাতে বিপুল লোকসানের মুখে না পড়েন এবং দেশের রফতানি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

http://www.dailysangram.com/post/273254