উন্নয়ন বনাম গণতন্ত্র এ বিতর্কটি অনেক পুরনো। গণতন্ত্রায়নের সাথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কাঠামোগত উন্নয়ন কতটা সম্পৃক্ত তা নিয়ে তত্ত্বকথার শেষ নেই। গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে, নাকি স্থবির করে তোলে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এস পি হান্টিংটন বিষয়টিকে দুটো শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করতে চান। প্রথমটি সঙ্ঘাত, দ্বিতীয়টি উপযুক্ততা। অনেকেই যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, সাধারণত গণতান্ত্রিক সরকারগুলো উন্নয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে। আর কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো তার একক নেতৃত্বের কারণে উন্নয়নকে দ্রুততার সাথে এগিয়ে নেয়। এ তত্ত্বকথার প্রধান কারণ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। মনে করা হয়Ñ উন্নয়ন মানেই পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন। এসব বিষয় যদি জনসাধারণের মর্জিমাফিক করতে হয়, তাহলে দ্বন্দ্ব-বিরোধ, সময়ক্ষেপণ ও লালফিতার দৌরাত্ম্য একটি স্বাভাবিক বিষয়। আর এক হাতে সিদ্ধান্ত নিলে কারো তোয়াক্কা করতে হয় না। পৃথিবীর তাবৎ স্বৈরতান্ত্রিক শাসকেরা, সামরিক একনায়কেরা এবং গণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদীরা সিদ্ধান্ত নিতে কোনো জবাবদিহিতার ধার ধারেন না।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পরবর্তী নির্বাচন সম্পর্কে ভাবতে হয়। জনগণ যদি বিগড়ে যায়, তাহলে গদি”্যুতি ঘটতে পারে। সুতরাং গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী যেমন উন্নয়ন ও কার্যব্যবস্থা আশা করে, তেমনটিই সরকারকে করতে হয়। গণতন্ত্রবাদীরা যুক্তি দেখান যে, তারা অধিকতর উন্নয়ন ঘটাতে পারেন। কারণ, তারা জনগণের সাথেই আছেন। সে উন্নয়ন কাঠামোগতÑ রাস্তাঘাট, পুল-সেতু, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি এবং কলকারখানা, আমদানি-রফতানি এবং ব্যবসাবাণিজ্যের উন্নয়ন হতে পারে। গণতান্ত্রিক সরকারগুলো তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই দেশের বেশির ভাগ পেশাজীবী মানুষের অনুকূলে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এভাবে উন্নয়নকামী এবং গণতন্ত্রপন্থীদের বিষয়টি একাডেমিকভাবে বিশ্লেষণ করলে এ রকম দাঁড়ায়Ñ ক. উন্নয়নকামীদের জনগণকে অগ্রাহ্য করে একক সিদ্ধান্ত এবং একক বাস্তবায়ন করতে হয়। খ. কর্তৃত্ববাদী সরকার সব বিরোধী শক্তিকে কঠোরহস্তে দমন করেÑ তারা নিজ দলের হলেও। গ. যারা রাজা-উজির, দেশের সম্পদকে তারা নিজেদের সম্পদ মনে করেন। যে উন্নয়ন হয় তা ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। ঘ. তারা যখন কর্তৃত্বের কারণে সম্পদ বণ্টনের মালিক-মোক্তার হয়ে দাঁড়ায় তখন তারা সমবণ্টন তো দূরের কথা, ন্যায্যভাবে বণ্টন করেন না। সেখানে স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি ও গোষ্ঠীপ্রীতি প্রাধান্য পায়।
ঙ. এভাবে কর্তৃত্ববাদীরা সব রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিজেদের সম্পদ মনে করতে থাকেÑ সব কিছুই সাময়িক বা লুটপাটের বিষয় মনে করে। সব কার্যক্রমের লক্ষ্য থাকে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে লাভবান করা। আর তা করতে গিয়ে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয় সব কার্যক্রম। অপর দিকে গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থায় জাতীয় প্রবৃদ্ধির সুবিধা পায় সব জনসাধারণ। যেহেতু উন্নয়নটি হয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা, সেহেতু উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জনগণের সম্পৃক্ততা পরিদৃষ্ট হয়। সরকারের কাঠামোগত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুবিধা দ্বারা গোটা দেশ উপকৃত হয়। গণতান্ত্রিক দল যেহেতু ভবিষ্যৎ ভোটের আশঙ্কায় থাকে, সেহেতু তারা অপেক্ষাকৃত কম দুর্নীতিবান হয়। কোনো কোনো রাজা-বাদশা, আমির-ওমরাহ এবং সামরিক শাসকেরা ‘সুশাসক’ হতেও পারেন। কিন্তু গণতন্ত্রের নামে যারা নির্বাচনব্যবস্থাকে ভণ্ডুল করে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চান, তাদের কার্যক্রম সবচেয়ে নিকৃষ্টতম হয়ে থাকে। তার কারণ, স্বীকৃত উত্তরাধিকারের নিশ্চয়তা ও মহত্ত্বÑ কোনোটাই তারা ধারণ করেন না।
এই তাত্ত্বিক কাঠামো দ্বারা যদি আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাবো বিগত সরকারগুলো যারা গণতন্ত্রের নাম ধারণ করে আচরণ করেছে স্বৈরতন্ত্রের মতো। আর যারা স্বৈরতান্ত্রিক অভিধায় অভিযুক্ত, তাদের নিয়ে তো আলোচনার অবকাশই নেই। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের রকমফের হয়েছে। ১৯৯০ সালের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের পর ২০০৯ সাল পর্যন্ত নির্বাচন নির্ভেজাল না হলেও সবাই তা অবশেষে মেনে নিয়েছে। তখন পর্যন্ত একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরে গণতান্ত্রিক প্রথা-পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন অসম্ভব হয়ে ওঠে। এই নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীনদের গণতন্ত্র সম্পর্কে নতুন সংজ্ঞা দিতে দেখা যাচ্ছে। দলের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা প্রথমত বলাবলি করছিলেন, তারা বেশি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। সুতরাং প্রকারান্তরে কর্তৃত্ববাদের ধ্বনিই প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
এখন আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’-এর কথা বলছেন। আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা উন্নয়নের গণতন্ত্রের বয়ান করছেন নিত্যদিনÑ চ্যানেলে অথবা পত্রিকার পাতায়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি বিলবোর্ডে দেখলাম লেখা হয়েছেÑ ‘নেত্রীর মূলমন্ত্র উন্নয়নের গণতন্ত্র’। তার মানে হচ্ছে আমরা যে আদি-আসল-অকৃত্রিম গণতন্ত্রের কথা জানি, সেটি এর থেকে ভিন্নতর কিছু। পৃথিবীব্যাপী বহুল উচ্চারিত গণতন্ত্রের সংজ্ঞা সবারই জানা কথা। আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই চিরায়ত উচ্চারণ, ÔDemocracy of the people, by the people and for the people’। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাই পাল্টে যাচ্ছে। এখন বলতে হবে ‘উন্নয়নের জন্য, উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং উন্নয়নের দ্বারা’। এই নতুন ধারার সংজ্ঞায় জনগণের পরিবর্তে উন্নয়নকে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ধরা হয়েছে। উন্নয়ন সম্পর্কে ক্ষমতাসীনেরা যা ব্যাখ্যা করেন এবং যা দৃশ্যমান হচ্ছে, তা হচ্ছে কাঠামোগত উন্নয়ন। বাংলাদেশের মানুষ যদি এই কাঠামোগত উন্নয়নে সুখী থাকত তাহলে আইয়ুব খানের ‘উন্নয়নের এক দশকের’ বিরুদ্ধে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান হতো না। বাংলাদেশের জনগণ যদি এরশাদীয় উন্নয়নের সহায়ক হতো, তাহলে ৯ বছরের মাথায় একটি গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাকে বিদায় নিতে হতো না। আইয়ুব অথবা এরশাদ উভয় ক্ষেত্রেই একটি বিষয়ের অভাব ছিল তা হলো গণতন্ত্র। আমরা সবাই জানি, পাকিস্তানের লৌহশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পাকিস্তানে ‘বুনিয়াদি গণতন্ত্র’ (Basic Democracy) কায়েম করেছিলেন। সেখানে জনগণের সার্বজনীন ভোটাধিকার অস্বীকার করে ৪০ী২= ৮০ হাজার ইউনিয়ন কাউন্সিল মেম্বারকে ভোটের অধিকারী করেছিলেন। এরশাদ সাহেব ’৮৬ ও ’৮৮ সালে যে দুটো নির্বাচন করেছিলেন তাতে জনগণের ভোটাধিকার অস্বীকার করে একটি ‘কৃত্রিম’ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিলেন। এরশাদ সাহেবের যথেষ্ট গুণাবলি সত্ত্বেও কেবল ভোটাধিকার অস্বীকার করায় মানুষ তার বিরুদ্ধে জীবন দিয়েছিল।
২০১৪ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের ভোটাধিকারকে অস্বীকার করেছে। অর্ধেকের বেশি আসনে নির্বাচন না হওয়ায় জনগণ তাদের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি। সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধিব্যবস্থা ওলট-পালট হয়েছে। তথাকথিত বিরোধী দল আর সরকার একাকার হয়ে গেছে। মূল বিরোধী দলকে ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে নিক্ষেপ করা হয়েছে। শুধু তাই নয় হত্যা, হামলা, মামলা ও নিপীড়ন-নির্যাতন দিয়ে তাদেরকে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। তাহলে আমরা দেখলাম এখানে ‘নির্বাচনী গণতন্ত্র’ এবং ‘কাঠামোগত গণতন্ত্র’-এর বদলে উন্নয়নের গণতন্ত্র প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এর তাৎপর্য হলো জনগণের ভোটের দরকার নেই। তাদের অংশগ্রহণেরও দরকার নেই। তারা শুধু বাইরের উন্নয়নের জৌলুশ দেখে খুশি থাকবে। এভাবে বছরের পর বছর বিরোধিদলবিহীন সরকার থাকলে বলা হবে স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়েছে! উন্নয়নের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে!
অবশ্য উন্নয়ন প্রত্যয়টি নিয়ে আরো ব্যাখ্যা রয়েছে। উন্নয়ন শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সম্প্রসারণ, জাতীয় আয় বৃদ্ধি এবং কারিগরি অগ্রগতি নয়। উন্নয়ন মানে সামাজিক কাঠামো, দৃষ্টিভঙ্গি এবং জনগণের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি। ব্যক্তির মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। উন্নয়ন মানে জনগণের জীবনযাত্রা এবং সম্পদের সমবণ্টন। উন্নয়নের মাত্রায় আজকাল যুক্ত হয়েছে গণতন্ত্রায়ন, জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। তাহলে উন্নয়নের মাত্রা বোঝা যাবে মৌলিক স্বাধীনতার মাত্রাগত প্রয়োগ দ্বারা। সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থাৎ নাগরিকের ভালো-মন্দের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার অংশগ্রহণ উন্নয়নের স্বীকৃতি প্রদান করবে। উন্নয়নের আধুনিক ভাষ্যকাররা বলেন, তৃণমূল পর্যায় থেকে উত্থাপিত দাবি, উদ্যোগ এবং সমস্যা অবহিতকরণ উন্নয়নের পূর্বশর্ত। জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP) নাগরিক সাধারণের শুধু বস্তুগত উন্নয়নকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। তারা একই সাথে স্বাধীনতা, সম্মান ও মর্যাদার উন্নয়নের কথা বলেন। অমর্ত্য সেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ The Argumentative Indian বইয়ে যে উন্নয়ন ধারণা দিয়েছেন তাও কাঠামোনির্ভর নয়, বরং মানবিকতানির্ভর। তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলের মানুষ সব সময়ই কোনো একক কর্তৃত্ব বা মতাদর্শ মেনে না নিয়ে বরং, মুক্ত আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়েই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজেছে।’ এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, বাংলাদেশের মানুষের জনচরিত্র অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। সম্প্রতি মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’ ৩৩টি দেশের রাজনৈতিক সচেতনতা সম্পর্কে একটি গবেষণাকর্ম প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৬৫ ভাগ মানুষ উচ্চমাত্রায় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে। গবেষণাকর্মে অন্তর্ভুক্ত সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এ ধরনের রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে ‘অতিমাত্রিক রাজনৈতিক অংশগ্রহণ’ বলে অভিহিত করা হয়। যে দেশে জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা এ রকম সর্বোচ্চ মাত্রায় রয়েছে, সে দেশে উন্নয়নের গণতন্ত্র কত দিন চলবে তা বিবেচ্য বিষয়। তবে এ সম্পর্কে গত সপ্তাহে (১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭) একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে তাৎপর্যপূর্ণ মতামত এসেছে।
‘উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রের ঘাটতি’ মেনে নেয়া উচিত কি না এ প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে ওই সম্মেলনে। South Asian Network on Economic Modeling –SANEM ঢাকায় অনুষ্ঠিত এর দ্বিতীয় বার্ষিক অর্থনৈতিক সম্মেলনে একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী এ বিষয়ে তার মূল্যবান মতামত তুলে ধরেন। যুক্তরাজ্যের উইলস্টার ইউনিভার্সিটির উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক জনাব ওসমানী বিশ্বব্যাপী চলতে থাকা নানা তাত্ত্বিক আলোচনা তুলে ধরে বলেন, ‘উন্নতির ক্ষেত্রে গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে ভালো ব্যবস্থা। স্বৈরতন্ত্রে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয় স্বল্পমেয়াদি ও টালমাটাল। অন্য দিকে গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয়। এ ব্যবস্থায় মানবসম্পদের উন্নতি বেশি হয়। বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেশি থাকে’। ওই অধ্যাপক বলেন, ‘উন্নয়নের পথে থাকা দেশগুলোতে যখন গণতান্ত্রিক অধিকার খানিকটা কেড়ে নেয়া হয়, তখন দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়।
প্রথমত, সিদ্ধান্তটি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য না হওয়া। দ্বিতীয়ত, প্রতিপক্ষ যুক্তি দেখায় গণতান্ত্রিক অধিকার কিছুটা ক্ষুণœ হলেও এতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন গতি পেতে পারে। তিনি প্রশ্ন করেন ‘গণতন্ত্র কী উন্নয়নের পথে বাধা তৈরি করছে? উন্নয়ন কেবল আর্থিক দিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। উন্নয়ন বলতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারও বোঝায়। এ দিক দিয়ে গণতন্ত্র উন্নয়নের একটি অংশ।’ শাসনব্যবস্থা ও উন্নয়নের সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, ‘তত্ত্বের জায়গায় এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্বৈরাচার গণতন্ত্রের চেয়ে ভালো। একইভাবে গণতন্ত্র উন্নয়নের পথে বাঁধাও তৈরি করে না। স্বৈরাচার যখন দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চায় তখন উন্নয়ন এগিয়ে নেয়। স্বৈরাচারের প্রবৃদ্ধি স্বল্পমেয়াদি হয় ও এতে অনিশ্চিয়তা থাকে।’ জনাব ওসমানী অবশেষে এই বলে উপসংহার টানেন, ‘২০১৭ সালে এসে বলা যায়, উন্নয়ন এগিয়ে নিতে গণতন্ত্র স্বৈরশাসনের চেয়ে ভালো। এটা প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করে। মানবসম্পদের উন্নয়ন করে। বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট থাকে না। উন্নয়নের জন্য গণতান্ত্রিক ঘাটতি মেনে নিতে হবে এ বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই।’ গরিব দেশে গণতন্ত্র হয় নাÑ এ বিতর্ক নাকচ করে জনাব ওসমানী বলেন, কাউকে এ কথা বলতে দেবেন না, আমরা গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নই, বরং গণতন্ত্রের ঘাটতি মেটাতে আমাদের লড়াই করতে হবে। গণতন্ত্রের জন্য অপেক্ষা করুন, তা আসছেÑ এটাও বলতে দেয়া যাবে না।
বাংলাদেশে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের বিতর্কে নাগরিক সাধারণের ভূমিকা কী হওয়া উচিত তা অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অস্ত্র ধারণ করেছিল। মূলত পাকিস্তানের প্রায় সিকি শতাব্দীতে গণতন্ত্রের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করেছে এ দেশের মানুষ। পাকিস্তানিরা আমাদের দিতে চেয়েছিল উন্নয়ন, কেড়ে নিয়েছিল গণতন্ত্র। আমরা যেমন পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ’ আমলে আপস করিনি, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশে উন্নয়নের বিনিময়ে গণতন্ত্রকে বিসর্জন দেবো না। আমরা নিঃসন্দেহে উন্নয়ন চাই, কিন্তু গণতন্ত্রের বিনিময়ে নয়।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com