২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ৯:২০

চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়!

ফরহাদ মজহার

সীমান্ত শুধু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আছে তা তো না, দেশ-সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র যবে থেকে আছে তবে থেকে সীমান্তও আছে, প্রতিবেশী আছে, খুঁটিনাটি ঝগড়া আছে। এমনকি সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া, দেয়াল ইত্যাদির নজিরও কম নাই। গ্রেট ওয়াল অব চায়নার কথা তো আমরা জানি। সেই কবে যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও সাতশ’ বছর আগে থেকে চীনা সাম্রাজ্য বাইরের হানাদারদের রুখতে এই দেয়াল তুলেছিল। হানাদারি রোখা আর লোকের আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ- এই ছিল দেয়াল তোলার মতলব। অন্যদিকে একটা সীমানা দাগ দিয়ে সেটা রক্ষা করার জন্য দেয়াল তোলার ও ঘেরা ভূখণ্ডটিকে নিজের দাবি করার সঙ্গে দেশের ধারণা যেমন, তেমনি সার্বভৌমত্বের ধারণাও যুক্ত। একদিক থেকে নিজের বাড়ির চারদিকে দেয়াল বা বেড়া দিয়ে সেই ভূখণ্ড বা বাড়ির ওপর নিজের দখলি স্বত্ব ও সার্বভৌম অধিকারের দাবি ও স্বীকৃতি আদায়ের ব্যাপারের মতো। মতাদর্শিক লড়াইয়ের যুগে গড়ে উঠেছিল বার্লিন ওয়াল। সেটা ছিল কোনো একটি মতাদর্শকে চরম সত্য দাবি করার যুগ; দেশ, আধুনিক রাষ্ট্র আর মতাদর্শের ব্যাকরণ দিয়ে গঠিত তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক আর পুঁজিবাদী শিবিরের মাঝখানে আর্টিফিশিয়াল দেয়াল।

মার্কসের ভাষ্য অনুযায়ী ‘‘পুঁজি ‘বিশ্ব-ঐতিহাসিক’, অর্থাৎ পুঁজির আবির্ভাব মানেই পুরনো জগৎ দ্রুত ভাঙতে বাধ্য। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক যখন ঘটতে পেরেছে, জগতের ইতিহাস পুঁজির ইতিহাস হবে, এটাই অনিবার্য। সবকিছুকে নিজের অধীনে আনতে গিয়ে পুঁজি অভূতপূর্ব ভাংচুর ঘটাতে থাকবে। পুঁজির আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে যে বুর্জোয়া যুগের আবির্ভাব ঘটেছে তার বৈশিষ্ট্যই হল ‘উৎপাদনে অবিরাম বৈপ্লবিক পরিবর্তন, সব সামাজিক অবস্থার বিরতিহীন গোলমাল, সর্বদা জারি থাকা অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা। মজবুত আর বরফঠাণ্ডা সব ধরনের জমাট সম্বন্ধ তাদের পুরনো-প্রাচীন-সনাতনী কুসংস্কার আর চিন্তাভাবনাসহ ঝেঁটিয়ে বিদায় নেয়া, যা কিছুই নতুনভাবে দানা বাঁধতে চাইবে তারা জমাট ধরার আগেই সেকেলে হয়ে যাবে। যা কিছু নিরেট-শক্ত তারা গলে যাবে মোমের মতো বাতাসে, যা কিছুই পাক-পবিত্র তারা হয়ে যাবে নাপাক; শেষতক মানুষ বাধ্য হবে তার জীবনের আসল অবস্থা এবং তার আপন প্রজাতির অপরের সঙ্গে তার সম্বন্ধকে বোধেবুদ্ধিতে হুশিয়ার থেকে দেখতে।’’ (মাকর্সের ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’র এ অংশটুকুর অনুবাদ আমিই করেছি। প্রগতি প্রকাশনী, মস্কোর বাংলা অনুবাদ না পড়ে ইংরেজিটাই বরং পড়ুন)।

পুঁজির স্ফীতি ও পুঞ্জিভবন প্রক্রিয়ার তোড়ে বার্লিন ওয়াল ভেঙেছে। প্রতীকী অর্থে এই ভাঙনকে বলা যায় সমাজতান্ত্রিক শিবির আর পুঁজিতান্ত্রিক শিবিরের মাঝখানে ওঠা কৃত্রিম দেয়ালের ভাঙন। ‘সমাজতন্ত্র’ নামে যে পরীক্ষা একটি দেশে এবং একটি রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে বানানোর চেষ্টা হয়েছিল, সেটা টেকেনি।

কৃত্রিম কেন? এক দেশে সমাজতন্ত্র টিকবে কিনা সেটা একটা পুরনো তর্ক। বার্লিন ওয়াল ভেঙে যাওয়ার গুরুত্ব তাই অপরিসীম। তা নিয়ে বিস্তর কথা হতে পারে, সেদিকে যাচ্ছি না। তবে জার্মান ভাবাদর্শে মার্কসের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, বিশ্বব্যাপী পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপান্তর না ঘটলে এক দেশে সমাজতন্ত্র টিকবে না। আত্মস্ফীতি ও পুঞ্জিভবনের তোড়ে উড়ে যাবে। তাছাড়া পুঁজি যে ‘বুর্জোয়া যুগ’ এনেছে তার মধ্যে থাকতে থাকতে আমাদের ভাষা, চিন্তা, চিন্তার পদ্ধতি, জগতকে দেখা ও বিচার করা, আমাদের নীতিনৈতিকতা, আনুগত্যের ধারণা, সমাজ এবং ব্যক্তির দ্বন্দ্ব ও সম্পর্ক ইত্যাদি নানান বিষয়ে ধ্যানধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক না হয় রাষ্ট্রের হুকুমে জবরদস্তি বদলিয়ে ‘সমাজতন্ত্র’ হল, যার আরেক নাম ‘সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র’; কিন্তু মানুষের ধ্যানধারণা, আকাক্সক্ষা, কামনা, বাসনা ইত্যাদির অন্দরমহলের ভেতরটা বদলানোর কারিগরি সম্পর্কে কার্ল মার্কস বিশেষ কোনো শিক্ষা দিয়ে যাননি। ‘নতুন মানুষ’ তৈরির কথা মাও জে দং-এর কাছ থেকে আমরা শুনেছি; কিন্তু অতটুকুই। সেটা করতে গিয়ে চীনে যে জবরদস্তি সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা হয়েছিল, তার ব্যর্থতার জের ধরে চীন শেষমেশ পুঁজিতান্ত্রিক পথই ধরেছে। একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে গড়ে ওঠা ধ্যানধারণা থেকে মুক্তি দীর্ঘ ও সময় সাপেক্ষ সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের ব্যাপার। সে ফ জবরদস্তি ওপর থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বা ব্যবস্থা চাপিয়ে দিলে হয় না। সারকথা হচ্ছে, ‘সমাজতন্ত্র’ নামক কিছুকে যদি পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার রূপান্তর ঘটিয়ে নতুন ‘বিশ্ব-ইতিহাস’ শুরু করতে হয় তবে তাকেও হতে হবে ‘বিশ্ব-ঐতিহাসিক’। সেটা কেমন হবে, কীভাবে ঘটবে, আদৌ ঘটা সম্ভব কিনা সেসব জিজ্ঞাসা বাস্তবের ‘সমাজতন্ত্র’ নামক কারবারের পর সাময়িক খামোশ হয়ে গিয়েছে বটে; কিন্তু মানুষের জিজ্ঞাসা মেটেনি। এখনও একালের প্রধান বৈপ্লবিক ভাবনা। সোভিয়েত, পূর্ব ইউরোপ, চীনে সমাজতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা টেকেনি, চীনও পুঁজিতান্ত্রিক রাস্তায় গিয়েছে। কিন্তু দাড়িভর্তি মুখের কার্ল মার্কস মহাশয়ের কথা থেকে গিয়েছে। মিথ্যা হয়নি।

কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া, দেয়াল ইত্যাদি তো পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই আমরা এখন দেখছি তোলা হয়েছে এবং তোলা হচ্ছে। অথচ পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, গোলকায়ন, কানেক্টিভিটি ইত্যাদি কত জবরদস্ত কথাবার্তা আমরা হামেশা শুনি। কিন্তু দিন শেষে আমরা দেখছি কাঁটাতারের বেড়া আর ভারতের সীমান্তরক্ষীদের হাতে গুলি খেয়ে বাংলাদেশী নাগরিকদের মৃত্যু। ব্যাপারটা কী? একে আমরা কীভাবে বিচার করব? পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে একে বোঝার উপযুক্ত পদ্ধতি কী? যদি বাংলাদেশ-ভারত আর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তকে আমরা পুঁজির বিচলন ও গতির অভ্যন্তর থেকে বুঝতে চাই তাহলে কীভাবে বুঝব? পত্রিকার উপ-সম্পাদকীয় পাতায় এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার জন্য নয়, বরং গুরুতর জিজ্ঞাসা হিসেবে তুলে রাখার জন্যই আজকের লেখা।

সীমান্ত, কাঁটাতারের বেড়া ও দেয়াল

কাঁটাতারের বেড়া কিংবা দেয়াল নতুন কোনো বিষয় নয়। টেক্সাস আর মেক্সিকো, সাউথ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ে, ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যকার দেয়াল। দেয়াল তোলার পক্ষে রাষ্ট্র নানান অজুহাতও খাড়া করে। কয়েকটি ইস্টারেস্টিং অজুহাতের কথা বলি।

আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানা ২০০৩ সালে জিম্বাবুয়ের সীমান্তে ৩০০ মাইল ইলেক্ট্রিক তারের বেড়া তোলার সময় দাবি করেছে, প্রতিবেশী দেশ থেকে যেন খুরা রোগ তাদের দেশের পশুদের আক্রান্ত করতে না পারে তার জন্যই এ ব্যবস্থা। তারের কাছে এসে ইলেক্ট্রিক শক খেয়ে গরুর পাল বা জন্তু-জানোয়ার ফিরে যাবে, বাধা পেয়ে আর আসতে পারবে না। জিম্বাবুয়ে পাল্টা বলেছে, কথাটা মিথ্যা। কারণ ইলেক্ট্রিক তারের বেড়া এতটাই উঁচু যাতে বোঝা যায় ইলেক্ট্রিক বেড়ার উদ্দেশ্য খোদ মানুষের আসা-যাওয়া বন্ধ করা। বতসোয়ানা অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা বলছে, গরু ঠেকানো তো বটেই, তবে জিম্বাবুয়ে থেকে যারা বতসোয়ানা আসতে চায় তারা যেন বৈধভাবে সীমান্তে প্রবেশের নির্ধারিত দরজায় তাদের জুতা জীবাণুমুক্ত করে প্রবেশ করে তার জন্যই ব্যবস্থা। আসলে গরু আর মানুষ দুটোই ঠেকাতে চায় বতসোয়ানা। মানুষ যেন বৈধ পথে আসে সেটাই ইলেক্ট্রিক বেড়া দেয়ার উদ্দেশ্য। যাই হোক, জিম্বাবুয়ে উত্তরে খুশি হয়নি। দুই দেশের মধ্যে এ বেড়া নিয়ে উত্তেজনা ও অস্বস্তি আছে।

দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৭৫ সালে মোজাম্বিকের বিপ্লব যেন টপকিয়ে তাদের দেশে চলে না আসে তার জন্য ১২৯ কিলোমিটার (প্রায় ৭৫ মাইল) লম্বা ৩৩০০ ভোল্টের মোজাম্বিক-জিম্বাবুয়ে সীমান্তে বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা বেড়া তোলে। বার্লিন ওয়ালে যত মানুষ মরেছে, এ বৈদ্যুতিক বেড়াতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মানুষ মরেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। একটা হিসাবে বার্লিন ওয়ালে ২৮ বছরে মানুষ মরেছে ৮০ জন, আর আফ্রিকার বৈদ্যুতিক বেড়ায় আগস্ট ১৯৮৬ আর আগস্ট ১৯৮৯-এর মধ্যে মানুষ মরেছে ৮৯ জন। এটা সরকারি হিসাব। আফ্রিকার চার্চের সঙ্গে যুক্ত মানবাধিকার কর্মীরা বলেন, সংখ্যা ২৯০০ ছাড়িয়ে যাবে।

কিছু কিছু দেয়াল ইতিমধ্যে নানা কারণে বিখ্যাত। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র আর মেক্সিকোর মধ্যে তোলা দেয়াল। ডোনাল্ড ট্রাম্প একে আরও বিখ্যাত করেছেন এখন। তেমনি ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে দেয়াল। সৌদি আরব সম্প্রতি ইয়েমেন সীমান্তে ১০ ফুট উঁচু দেয়াল তুলেছে। এরপর ইরাক সীমান্তেও দেয়াল উঠবে। ইন্দো-কাশ্মীর সীমান্তে দিল্লি শুধু কাঁটাতার দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, দুই কাতারের কাঁটাতারের মাঝখানে ভূমিতে মাইন পুঁতে রেখেছে। কাশ্মীর দমন এর প্রধান উদ্দেশ্য। যেন কাশ্মীরি গেরিলারা সীমান্তের কোনো সুবিধা নিতে না পারে। প্রতিবেশী গরিব দেশ থেকে শরণার্থীরা যেন প্রবেশ করতে না পারে ভারত সেটা ঠেকানোর জন্য পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে বা দিচ্ছে। অজুহাত হচ্ছে, ইসলামী সন্ত্রাসীদের চলাচল বন্ধ করা। ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর সীমান্ত চিহ্নে গোলমাল ছিল। এখন বর্ডার ঠিক করে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব জাহির করা আর কী! আরও অজুহাত হচ্ছে গরু পাচারকারীদের আসা-যাওয়া রোধ, শরণার্থী ঠেকানো, ইত্যাদি।

কিছু কিছু বর্ডার সীমান্তরক্ষীদের নিষ্ঠুরতা ও দমনপীড়নের জন্য কুখ্যাত। যেমন প্যালেস্টাইন-ইসরাইল বর্ডার। কিন্তু সীমান্তে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার ক্ষেত্রে প্যালেস্টাইন-ইসরাইল নয়, সবচেয়ে মশহুর হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। বাংলাদেশের নাগরিকদের এখানে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়; শুধু তাই নয়, ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করতে করতে হত্যা করা হয় আর প্রায়ই বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে এসে বিএসএফ সদস্যরা কুকুর-বেড়াল ধরার মতো মানুষ ধরে নিয়ে যায়। পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর তথ্য থেকে এ তথ্যচিত্রটি দাঁড় করিয়েছি। নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের হত্যা, জখম ও অপহরণের বছরওয়ারি সংখ্যাটি দেখুন।

কাঁটাতারের বেড়া ও বাংলাদেশের জনগণকে কুকুর-বেড়াল গণ্য করা নতুন কিছু নয়, আমাদেরই একই ভাষায় কথা বলা পশ্চিম বাংলার ভাইবোনদের বাংলাদেশ সম্পর্কে আদৌ কোনো ধারণা আছে কিনা সন্দেহ। আর ইদানীং এই প্রপাগান্ডা নরেন্দ্র মোদির সমর্থকরা জোরেশোরে চালায় যে, শেষমেশ এটা মোছলমানদের দেশ। একে কাশ্মীরের মতো গুলিবারুদ মেরেই দাবড়িয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনার কানে কথাটা হয়তো গিয়েছে, তাই তাকে একটা চীন নীতি বের করতে হয়েছে। তিনি চীন থেকে সাবমেরিন কিনেছেন। সেটা দিল্লিতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। এর ফলে তার দিল্লি সফর কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়!

কাঁটাতার, মানুষের চলাচল বন্ধ করার জন্য দেয়াল তোলা, সীমান্তে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা, বিশেষ একটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে অসুর বা দানবে পরিণত করা- যেন তাদের বিবেকহীন ও আইনবহির্ভূতভাবে হত্যা ও নির্যাতন করা যায়, ইত্যাদি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন বা নতুন বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে রাষ্ট্রের ভূমিকার ক্ষেত্রে গুণগত রদবদল যেমন ঘটছে, সমাজে অস্থিরতা ও নিরাপত্তাবোধের অভাবও সেই মাত্রায় বেড়েছে। মানুষে মানুষে বিভক্তি-বিভাজন টিকিয়ে রেখে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাকে আরও তীব্র করা, আর অন্যদিকে কাঁটাতারের বেড়া ও দেয়াল তুলে রাষ্ট্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাওয়ার মধ্যে একটা মস্ত বড় ফাঁক আছে।

পণ্য ও পুঁজির অবাধ চলাচল রাষ্ট্র নিশ্চিত করে; কিন্তু সস্তা শ্রমকে কাঁটাতার আর দেয়াল দিয়ে আটকে রাখতে চায়। যেন মুরগির ফার্মের মতো যখন সাপ্লাই লাগে তখন গরিব দেশ থেকে নিয়ন্ত্রিত সংখ্যায় তাদের খাটানো চলে।

বাস্তবতা বিচার করলে মনে হয় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দিল্লির সৈনিকদের প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এখানে তারা নিরস্ত্র মানুষ মারা আরও ভালোভাবে প্র্যাকটিস করে। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য ও কাশ্মীরে তারা যা শিখেছে, সেটা তারা এই সীমান্তে নিত্যপ্রয়োগ ও চর্চার মধ্য দিয়ে একে পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তাক্ত সীমান্ত হিসেবে সুখ্যাতি দিয়েছে।

সব কাঁটাতারের বেড়া ও দেয়াল তো ভেঙে যাওয়ার কথা ছিল

বার্লিন ওয়াল ভেঙে যাওয়ার পর সব দেয়ালই তো ভেঙে যাওয়ার কথা ছিল। তাই না? তাহলে জিজ্ঞাসা, এখান থেকেই শুরু হতে পারে। বার্লিন দেয়াল ভাঙার পর পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যে যুগ শুরু হল, দেখা গেল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রীতিমতো দেয়াল ও কাঁটাতার দেয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। দেখা যাচ্ছে, গোলকায়নের গতি যত বেড়েছে, রাষ্ট্র তার পুরনো সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে। রাষ্ট্র প্রথমে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব হারাতে শুরু করে। বিশ্বব্যাংক আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে অনেক রাষ্ট্রই জিম্মি হয়ে যায়। এ যাওয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ক্ষয় স্পষ্টই বোঝা যায়। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব মীমাংসার ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র নয়, বরং সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে নানা কিসিমের আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশনের সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে পুরনো গ্যাটের জায়গায় গঠিত হল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওয়েস্টফিলিয়ার সন্ধির আলোকে রাষ্ট্রের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার খর্ব হল। পণ্য ও পুঁজির অবাধ বিচলন রাষ্ট্রকে মেনে নিতে হল। কাছাখোলা অবাধ বাণিজ্যের যুগে রাষ্ট্র হয়ে উঠল পালক ওঠা কাকের মতো। তার স্বরে রাষ্ট্র সার্বভৌমত্বের কথা হাঁকছে, অথচ পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন তার সিদ্ধান্ত নেয়ার সার্বভৌম ক্ষমতা অনেকাংশেই কেড়ে নিয়েছে।

তাহলে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া কিংবা দেয়াল তোলা কি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ক্ষয় এবং রাষ্ট্রের চরিত্রে, ক্ষমতা ও ভূমিকায় পরিবর্তনের পরিণতি? অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলছেন, এভাবে দেখাটাই সঠিক। রাষ্ট্রের দিক থেকে এটা একটা নাটক, এক ধরনের থিয়েটারি। লেজ নাই, কিন্তু দেখাতে হবে লেজ আছে। নাগরিকদের অর্থনৈতিক দেখভালের দায়িত্ব রাষ্ট্র এখন নেয় না। যার যার তার তার। অর্থাৎ অবাধ বাজার ব্যবস্থায় নাগরিকরা টিকে থাকলে টিকবে, নইলে না। রাষ্ট্র নিজে তার নাগরিকদের দাস-শ্রমিক হিসেবে অন্য দেশে পাঠায়। তাদের রক্তে-ঘামে ভেজা টাকায় রাষ্ট্র নিজেকে চালায়। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা বাসস্থান নিশ্চিত করার কথা বলে এককালে রাষ্ট্র নিজের ন্যায্যতা প্রমাণ করত। এখন সেটা করার কোনো সুযোগ নাই, রাষ্ট্রের সেই ক্ষমতাও নাই।

এটা কি তাহলে প্রাচীন দুর্গ বানিয়ে প্রতিরক্ষার আধুনিক কোনো সংস্করণ? কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া দেয়া বা দেয়াল তোলার একটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হচ্ছে, বাইরের কোনো রাষ্ট্রের আক্রমণ থেকে কাঁটাতারের বেড়া কিংবা দেয়াল জনগণকে রক্ষা করার জন্য তৈরি হয়নি। না। বরং উদ্দেশ্য মূলত তাদের বাধা দেয়ার জন্য, যারা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের ফলে ছিটকে পড়েছে। রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েছে। যেমন অভিবাসী, চাকরির সন্ধানে নিজের জন্মভূমি ছেড়ে সে ফ বেঁচে থাকার জন্য যারা অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছে। আছে যুদ্ধাক্রান্ত দেশের উন্মূল উদ্বাস্তু মানুষ। নিজের দেশে নাগরিক ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দেশ ছাড়া মানুষ।

কাঁটাতার ও দেয়াল তোলার আরেকটি প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সেসব শক্তি ও গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা, যাদের আধুনিক পরিভাষায় ‘নন স্টেট অ্যাক্টর’ বলা হয়। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংঘবদ্ধ বা বিচ্ছিন্ন দল। যারা রাজনৈতিকভাবে কোনো একটি আদর্শ মাথায় নিয়ে বিশ্বব্যবস্থার বিদ্রোহী। সরকারি পরিভাষায় ‘সন্ত্রাসী’, ‘জিহাদি’ ইত্যাদি। এছাড়াও আছে চোরাচালানে নিয়োজিত ব্যক্তি বা সিন্ডিকেট, নারী ও শিশু পাচারকারী, অবৈধ পণ্যের ব্যবসাদার।

সারকথা হচ্ছে, পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন যে সমস্যা ও সংকট তৈরি করে সেটা রাষ্ট্র আইন, বিধি-বিধান কিংবা কোনো নৈতিক আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এখানেও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ক্ষয় ঘটেছে এবং রাষ্ট্র সেই অভাব পূরণ করার জন্য কাঁটাতারের বেড়া কিংবা দেয়াল তোলার থিয়েটার শুরু করে। কাঁটাতারের বেড়া ও দেয়াল দিয়ে তার ক্ষয়ে যাওয়া সার্বভৌমত্ব এক ধরনের চরম প্রতিক্রিয়াশীল জাতিবাদ দিয়ে পূরণ করতে চায়। তোমরা আর আমরা। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দিল্লি যেমন বোঝাতে চায় তোমরা অপর, তোমরা বাংলাদেশী, কিংবা মুসলমান, ভিন্ন ‘জাতি’। আমরা ভারতীয় এবং হিন্দু। আমাদের জাতিবোধ ও সভ্যতা আলাদা। কাঁটাতারের বেড়া সেই ঘৃণারই প্রকাশ্য চর্চা মাত্র। কারণ কাঁটাতারের বেড়া ভারতীয় নিরাপত্তা কোনোভাবেই নিশ্চিত করতে পারে না। পারবে না। সেটা সম্ভব দুই দেশের মধ্যে মৈত্রীর সম্পর্ক আন্তরিকভাবে চর্চার মধ্য দিয়ে। সেই চর্চার কোনো বিকল্প নাই।

অনেকে তাই বলছেন, পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত পাশ্চাত্য (বা ওয়েস্টফিলিয়ান) ধারণার ক্ষয়ের প্রতীক হচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া বা দেয়াল। ঠুনকা। এগুলো বার্লিন ওয়ালের মতো ভেঙে পড়বে। কী হবে আমরা জানি না। তবে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে আধুনিক রাষ্ট্র তার নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে যেভাবে নিছকই সিকিউরিটি স্টেট মাত্র হয়ে উঠেছে, তাতে কাঁটাতারের দেয়াল তুলে তার ‘সার্বভৌমত্ব’ জাহির করার দিনেরও অবসান হতে বাধ্য, এটা বুদ্ধি দ্বারা বোঝা কঠিন কিছু নয়। থাকবে বহুজাতিক কর্পোরেশন বনাম জনগণ। থাকবে ‘রগ স্টেট’, বদমাশ ও খুনি রাষ্ট্র। পুঁজির পাহারাদার হিসেবে রাষ্ট্র নামক কাঁটাতার, দেয়াল, খুন-খারাবি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ চলবে। কিন্তু কতদিন?

রাষ্ট্র ক্ষয়িষ্ণু বটে; তবে ঠিক যে রাষ্ট্র সহসা বিলুপ্ত হচ্ছে না। রাষ্ট্রের রূপ ও ভূমিকার বদল আমরা দেখছি। ক্ষয়ে যাওয়া সার্বভৌমত্ব নিয়ে রাষ্ট্র নিজের ন্যায্যতা প্রমাণ করার দৃশ্যমান চেষ্টা করছে। গুলি করে নির্বিচারের মানুষ মেরে দিল্লি দেখাতে চায়, এই দেখো আমার সীমান্ত। দিলাম আমি কাঁটাতারের বেড়া। রাষ্ট্রের এই খুন বাস্তব বটে, তবে এটা ভুয়া সার্বভৌমত্বের প্রদর্শন মাত্র- এ কথা যারা বলছেন তাদের কথা মানলে এটাও বিশ্বাস করতে হয় যে, দিল্লির শাসকরা অতিশয় দুর্বল চরিত্রের। খালি কলসি বাজে বেশি। আর দুর্বল বলেই শক্তি পরীক্ষার জন্য সীমান্তে নিরীহ মানুষ গুলি করে মারে।

বিচারবহির্ভূত হত্যার জবাবদিহি একদিন না একদিন করতেই হবে। চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়!

http://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/02/25/104149