৩০ ডিসেম্বর ২০১৬, শুক্রবার, ৪:০৭

নানান ছাড়েও কমেনি খেলাপি ঋণ

ব্যাংক ঋণের সুদহার কমে এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে। হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক বা বিসমিল্লাহর মতো বড় কোনো আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটেনি। খেলাপি ঋণ কমাতে নানান ছাড়ও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরও বিদায়ী বছরে খেলাপি ঋণ না কমে বরং বেড়েছে। উচ্চ খেলাাপি ঋণের বিষয়টি বছরজুড়ে বারবার আলোচনায় এসেছে। ব্যাংক খাতে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি এবং কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম জালিয়াতি।

খেলাপি ঋণ কমাতে গত কয়েক বছর বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশেষ সুবিধা নিয়ে ব্যাংক খাতে ৫০০ কোটি টাকার বেশি রয়েছে এমন ১১টি গ্রুপ ২০১৫ সালে ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছে। এর আগে ২০১৪ সালে শিথিল শর্তে ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। বিশেষ ছাড়ে পুনঃতফসিল করার এ প্রবণতা এখনও অব্যাহত আছে। এর পরও খেলাপি ঋণ না কমে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। গত সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৭৩১ কোটি টাকায়। আলোচ্য সময় পর্যন্ত বিতরণ হওয়া ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। খেলাপি ঋণের পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ হাজার ২৩ কোটি টাকা বেশি। আর গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় বেশি রয়েছে ১৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। এদিকে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই না করে ঋণ বিতরণসহ নানা অনিয়মের কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এসব অনিয়মে সংশ্লিষ্টতার দায়ে অনেক ব্যাংকারকে এ বছর গ্রেফতার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অন্যদিকে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ব্যাংক খাতের সুদহার এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। বিভিন্ন বিল-বন্ডের বিপরীতে সরকার এখন ২ দশমিক ৯৮ থেকে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে ঋণ পাচ্ছে। বছর দেড়েক আগেও এসব ক্ষেত্রে ঋণ নিতে সরকারকে সাড়ে ৫ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে হতো। সামগ্রিকভাবে পুরো ব্যাংক খাতে ঋণের গড় সুদহার গত অক্টোবরে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। সুদহার কমার এ প্রবণতা উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি এনে দিয়েছে। খেলাপি ঋণ না বাড়লে সুদহার আরও কমত।

অবশ্য ২০১৬ সালে বড় কোনো আর্থিক কেলেঙ্কারি সামনে আসেনি। এর আগে ২০১২ সালে হলমার্কসহ ৬টি গ্রুপের প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি ফাঁসের জের কাটতে না কাটতেই পরের বছর আলোচনায় আসে বিসবিল্লাহ গ্রুপ। জনতাসহ কয়েকটি ব্যাংক থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা নিয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। এই দুই ঘটনা নিয়ে নানা সমালোচনার মধ্যে সামনে আসে বেসিক ব্যাংক। এ ঘটনা নিয়ে পুরো ২০১৪ ও ২০১৫ সাল জুড়ে আলোচনা হয়েছে। চাকরি হারান এমডি, চারজন ডিএমডিসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। এই তিন ঘটনার মতো ২০১৬ সালে বড় কোনো আর্থিক কেলেঙ্কারি খবর শোনা যায়নি। যদিও গত বছরের জুনে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন শাখার ৭৯২ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মে সংশ্লিষ্টতার দায়ে তাকে অপসারণ করা হয়। তবে বিষয়টি একক কোনো প্রতিষ্ঠানের না হওয়ায় এবং রিজার্ভ চুরি নিয়ে ওই সময়ে তোলপাড়ের মধ্যে এ ঘটনা তেমন একটা আলোচনায় আসেনি।

বড় কোনো আর্থিক কেলেঙ্কারি না ঘটলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনা বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বছরজুড়ে আলোচনা হয়েছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্বের সর্ববৃহৎ আর্থিক সাইবার আক্রমণের এ ঘটনা ফাঁসের পর প্রশ্নের মুখে পড়ে আন্তর্জাতিক লেনদেনের বার্তা প্রেরণের মাধ্যম সুইফট সিস্টেম। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে অর্থ চুরি হয়। এ ঘটনায় গত ১৫ মার্চ গভর্নরের পদ ছাড়েন ড. আতিউর রহমান। একই দিন দুই ডেপুটি গভর্নরকে সরিয়ে দেয় সরকার। চুরি হওয়া অর্থের মধ্যে ওই সময়ই শ্রীলংকায় নেওয়া ২ কোটি ডলার ফেরত এসেছে। আর ফিলিপাইনে যাওয়া অর্থের মধ্যে কিম অংয়ের ফেরত দেওয়া এক কোটি ৪৬ লাখ ডলার ফেরত পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি অর্থ ফেরত নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

রিজার্ভ চুরির কয়েকদিন আগে গত ৬ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি ইস্টার্ন, সিটি, ইউসিবি ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ৬টি এটিএম বুথ থেকে ৪০ গ্রাহকের ২০ লাখ ৫৯ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় দুষ্কৃতকারীরা। এর পর ১৪ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি আবার প্রিমিয়ার ব্যাংকের এটিএম বুথ ব্যবহার করে বিদেশি আল-রাজী ব্যাংকের ১৫০টি বিদেশি কার্ডের বিপরীতে ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এর পর সব এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ও পিন শিল্ড ডিভাইস বসানোর নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মূলধন রাখতে সক্ষম হয়েছে অধিকাংশ ব্যাংক। বর্তমানে ৪২টি ব্যাংকের মূলধন রয়েছে ১১ শতাংশের ওপরে। পাঁচটি ব্যাংক ১০ শতাংশের ওপরে মূলধন রেখেছে। তবে সরকারি মালিকানার ৭টি ও বেসরকারি খাতের দুটি ব্যাংকে ১৬ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা ঘাটতি পুরো খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি রয়েছে ৭টি ব্যাংক। মূলধন ও সঞ্চিতি ঘাটতি রেখে কোনো ব্যাংক মুনাফা দিতে পারে না। ফলে ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলো মুনাফা এবারও নেতিবাচক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর ২০১৬ সালের পরিচালন মুনাফার প্রাথমিক হিসাব আগামী সপ্তাহে জানা যাবে। তবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে বেশিরভাগ ব্যাংকের মুনাফায় মিশ্র প্রবণতা দেখা গেছে।
- See more at: http://bangla.samakal.net/2016/12/30/259203#sthash.wBaf7lng.dpuf