২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শুক্রবার, ২:০৬

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন

সুন্দরবন এলাকায় মারাত্মক ঝুঁকিতে ২৭ প্রজাতির মাছ

বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সুন্দরবন এলাকায় ২৭ প্রজাতির মাছ মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিবছর যে হারে সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ছে, তাতে অল্প সময়ের মধ্যে মিষ্টি পানিতে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা ২৭ প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি ঘটতে পারে। আর তাতে সেখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা ও পেশাতেও পরিবর্তন আসবে।

আড়াই বছর ধরে ৮৩ প্রজাতির মাছের ওপর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে গবেষণাটি করেছিল বিশ্বব্যাংক, যেসব মাছের ওপর স্থানীয় মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। তাতে দেখানো হয়েছে, ২৭ প্রজাতির মাছের লবণাক্ত সহিষ্ণুতা অত্যন্ত কম। গত মাসে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে মিষ্টি পানির মাছের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সোয়া ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে। ফলে সুন্দরবন এলাকা থেকে এসব মাছ হারিয়ে যেতে পারে।

সুন্দরবন এলাকা থেকে যে ২৭ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক, সেই তালিকায় উল্লেখযোগ্য হলো মাগুর মাছ, শিং, কই, কাতল, টাকি, শোল ও কাকিলা মাছ। এ ছাড়া বোয়াল মাছ, কাটারি, টিটপুঁটি, জাতপুঁটি, গাচুয়া, পাবদা, কানি পাবদা মাছও আছে এই তালিকায়। একই সঙ্গে ফলি, টেংরা, বাজারি টেংরা, বাটা, মেনি, লোয়াচ, কেওড়া ও কালিবাউস মাছও বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত গবেষক গোলাম মোস্তফা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা আড়াই বছর ধরে ৮৩ প্রজাতির মাছের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে গবেষণায় যেটা দেখেছি তা হলো এই ২৭ প্রজাতির মাছ ০ থেকে ৫ পিপিটি (পার্টস পার ট্রিলিয়ন) লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। এর বেশি লবণাক্ততা তারা সহ্য করতে পারে না। সুন্দরবনে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে মিষ্টি পানির মাছ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এসব মাছ আর সুন্দরবন এলাকায় থাকতে পারছে না। অন্যত্র চলে যাচ্ছে। ’

গোলাম মোস্তফা আরো বলেন, ‘খুলনার পাইকগাছা এলাকায় মিষ্টি পানিতে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির ৫৯ শতাংশ মাছ কমে গেছে। আর বাগেরহাটের রামপালে কমেছে ২১ শতাংশ। পুরো এলাকায় ৫ পিপিটি (পার্টস পার ট্রিলিয়ন) লবণাক্ততা বেশি হলে এসব মাছ আর সেখানে দেখা যাবে না। ’

গবেষণাটি করার সময় যেখানে যেখানে লবণাক্ততার মাত্রা বেশি, সেখান থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। খুলনার পাইকগাছা, বাগেরহাটের রামপাল, সাতক্ষীরা জেলার কয়েকটি স্থান থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। শিবসা, পশুর নদসহ আরো কয়েকটি নদ-নদী থেকে লবণাক্ততার মাত্রা কতটুকু, সে তথ্য নেওয়া হয়েছে। তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে শীতকালে, যখন লবণাক্ততার মাত্রা বেশি থাকে। ২০৫০ সাল নাগাদ সুন্দরবন এলাকায় পানির লবণাক্ততা কোন পর্যায়ে যেতে পারে সেটি নিয়েও গবেষণা করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, বর্ষাকালে লবণাক্ততা কম থাকলেও ডিসেম্বর থেকে মে পর্যন্ত সময়ে লবণাক্ততার হার থাকে অনেক বেশি।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৮৩ প্রজাতির মাছের মধ্যে ২৭ প্রজাতির মাছ ০ থেকে ৫ পিপিটি (পার্টস পার ট্রিলিয়ন) পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। ০ থেকে ১০ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে ১৪ প্রজাতির মাছ। ২০ পিপিটি পর্যন্ত সহনীয় আছে ২১ প্রজাতির মাছ। ৩০ পিপিটি পর্যন্ত সহনীয় ক্ষমতা আছে আট প্রজাতির মাছের। আর সর্বোচ্চ ৩৫ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ততা সহনীয় মাছের জাত আছে চারটি। সেগুলো হলো হরিণা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, কড্ডি চিংড়ি ও হ্যানি।

বিশ্বব্যাংক বলছে, ইলিশ মাছ সর্বোচ্চ ৩০ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। পোয়া মাছও ৩০ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। বহুজাতিক সংস্থাটি বলছে, সুন্দরবনে লবণাক্ততা বাড়ার কারণে যেসব মাছ লবণ পানি সহ্য করতে পারে না তার মধ্যে ২৭ প্রজাতির মাছ আছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে। এরপর আছে আরো ১৪ প্রজাতির মাছ, যেগুলো এখন পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিতে আছে। কিন্তু যে হারে লবণাক্ততা বাড়ছে, তাতে একসময় সেসব মাছও হারিয়ে যাবে।

যে ১৪ প্রজাতির মাছ ১০ পিপিটি পর্যন্ত সহনীয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লাল চান্দা, গুঁড়া ইচা, গোলসা টেংরা, কুইচা বাইম, ডিমুয়া ইচা, বড় ইচা ও বাইলা মাছ।

প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি ইশতিয়াক সোবহান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সুন্দরবনে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। গবেষণায় আমরা দেখিয়েছি, সুন্দরবন এলাকা থেকে ২৭ প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো, লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে সুন্দরবনে কি সামুদ্রিক মাছ আসবে কিংবা সেখানে থাকবে কি না। না। সুন্দরবনে এসে সামুদ্রিক মাছ সেই ধরনের পরিবেশ পাবে না যেটা সে সমুদ্রের মধ্যে পেয়ে থাকে। ফলে কিছু সময়ের জন্য এলেও পরবর্তী সময়ে সামুদ্রিক মাছ সুন্দরবনে স্থায়ী হবে না। ’

ইশতিয়াক সোবহান আরো বলেন, ‘আমাদের আশঙ্কা সেখানেই যে একদিকে আমরা মিষ্টি পানির মাছ হারাচ্ছি। অন্যদিকে সেখানে নতুন করে কোনো মাছের প্রজাতিও আসছে না। ফলে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হবে জীববৈচিত্র্যের। ’

বিশ্বব্যাংক তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে, সুন্দরবন এলাকায় প্রতিবছর প্রায় ২ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ততা বাড়ছে। মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় এরই মধ্যে অনেক জেলে তাদের পেশা পরিবর্তন শুরু করেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সুন্দরবনে লবণাক্ততা যে বাড়ছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা দুটি গবেষণাতেও।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে, স্থানভেদে সুন্দরবন এলাকায় প্রতিবছর গড়ে ১ থেকে ১.৫ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম) লবণাক্ততা বাড়ছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়েছে, সুন্দরবন এলাকায় সময় ও স্থানভেদে লবণাক্ততা বাড়ার পরিমাণ ২ থেকে ২৭ পিপিএম। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে লবণাক্ততা ১ থেকে ৫ পিপিএমের মধ্যে থাকলেও শীতকালে তা বেড়ে যাচ্ছে। এটি ৩০ পিপিএম পর্যন্তও পৌঁছে। প্রসঙ্গত, সুন্দরবনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/02/24/467182