৩০ ডিসেম্বর ২০১৬, শুক্রবার, ৪:০৬

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ: ৩০১ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি

প্রবাসীদের মালিকানায় পরিচালিত নতুন ব্যাংক এনআরবি কমার্শিয়ালে ৩০১ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি ও অন্য একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বড় অঙ্কের বেনামি শেয়ার ধারণের তথ্য পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে উদ্যোক্তা

পরিচালকদের মধ্যে চরম দ্বন্দ্বের জেরে ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের এক আদেশে বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. মাসুদ বিশ্বাসকে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর আগে গত ১৩ জানুয়ারি নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রথমবারের মতো ফারমার্স ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসানো হয়।

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ওপর পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকটিতে ৪৩ কোটি ৭১ লাখ টাকার বেনামি শেয়ার রয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. শহিদুল আহসানের। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কামরুন নাহার সাখী এবং এবিএম আবদুল মান্নানের নামে কেনা শেয়ারের বিপরীতে সম্প্রতি তিনি লভ্যাংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সভায় এ দু'জনের উপস্থিতি দেখিয়ে শহিদুল আহসানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অনৈতিক ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অথচ এ দুই ব্যক্তি ২০০৯ সালের পর কখনও দেশে আসেননি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এ ধরনের বেনামি শেয়ার বাতিল হওয়ার কথা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান শহিদুল আহসানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান মেসার্স এজি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অনুকূলে ১৮৩ কোটি এবং ব্যাংকের নোয়াখালীর চন্দ্রগঞ্জ শাখা থেকে বেগমগঞ্জ ফিড মিলের নামে ১১৮ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়েছে। মেসার্স এজি এগ্রোর নামে ২০১৩ সালে ১১৮ কোটি টাকার ঋণ দেয় এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। প্রয়োজনীয় জামানত ছাড়াও এ ঋণ নিয়ে ওই সময়ই আপত্তি তোলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও গত মে মাসে ঋণসীমা বাড়িয়ে ১৮৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। এই ঋণ নিয়মিত রাখতে ব্যাংকের উত্তরা শাখা থেকে জনৈক আজিজ চৌধুরী, তার ছেলে সালাহ উদ্দিন চৌধুরী ও তারেক চৌধুরীর নামে সৃষ্ট প্রচুর ঋণ এজি এগ্রোর অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়েছে। ফলে গ্রাহকের ব্যবসা থেকে ঋণ হিসাব নিয়মিত রাখা হয়েছে, নাকি বিভিন্ন নামে সৃষ্ট ঋণ থেকে এখানে দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ফরাছত আলী সমকালকে বলেন, শহিদুল আহসান এই ব্যাংকের অন্যতম ভালো গ্রাহক। তার মামা এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন, মাঝেমধ্যে দেশেও আসেন। আর মামা পরিচালক হলে ভাগ্নে ঋণ নিতে পারবেন না বিষয়টি তেমন না। ফলে তাকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। আর শহিদুল আহসান এবারও আমাদের ২১ কোটি টাকার ব্যবসা দিয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক যেটা বলেছে তা সঠিক নয়। বেগমগঞ্জ ফিড মিলের মালিক শহিদুল আহসানের ভাই ও ভাতিজা। তাদের নামে ৭৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। আর এজি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিকে দেওয়া হয়েছে ৬৮ কোটি টাকা। শহিদুল আহসানের বেনামি শেয়ার ধারণের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা ঠিক নয়।

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ফরাছত আলী। তার বরাবর পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত মাসুদ বিশ্বাস এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সব বৈঠক ছাড়াও নির্বাহী ও অডিট কমিটির বৈঠকে উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে মতামত তুলে ধরবেন। পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনে এ মহাব্যবস্থাপককে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে বলা হয়েছে। দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে প্রতিটি পর্ষদ বৈঠকের অন্তত তিন কার্যদিবস আগে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ সব এজেন্ডা তার কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।

২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে কার্যক্রম শুরু করা নতুন ৯ ব্যাংকের একটি এনআরবি কমার্শিয়াল। ব্যাংকটিতে বর্তমানে খেলাপি ঋণ রয়েছে ১২৮ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিতরণ করা মোট ঋণের যা ৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এ ব্যাংক। খেলাপি ঋণের দিক দিয়ে নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রথম অবস্থানে থাকা ফারমার্স ব্যাংকে খেলাপি ঋণ রয়েছে ২৭৭ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিতরণ হওয়া মোট ঋণের যা ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।

ঋণ অনিয়ম, পরিচালনা পর্ষদে সুশাসনের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে এ নিয়ে ১২টি ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষক বসল। ব্যাংকগুলো হলো_ ফারমার্স, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বাংলাদেশ কৃষি, বেসিক, বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কমার্স ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। আর দীর্ঘ সময় ধরে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে পর্যবেক্ষক থাকলেও সম্প্রতি তা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
- See more at: http://bangla.samakal.net/2016/12/30/259270#sthash.fv9RZcb6.dpuf