১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ১০:৫৪

উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পানির তীব্র সংকট : মরুময়তার আশংকা; দেশের প্রথম ‘পানি সংকটপূর্ণ’ এলাকা ঘোষণা হচ্ছে

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পানির জন্য চলছে হাহাকার। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বহু নলকূপ এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। জীবন বাঁচাতে এসব এলাকার মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে পানি আনছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে শুধু পানযোগ্য পানি নয়, কৃষি কাজের জন্যও ন্যূনতম পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে সরকার বরেন্দ্র অঞ্চলের কয়েকটি এলাকাকে দেশের প্রথম ওয়াটার ট্রেস এরিয়া বা ‘পানি সংকটপূর্ণ’ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে যাচ্ছে। পানির এ তীব্র সংকটে এসব এলাকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে দারুণভাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পানি সংকটের কারণে রাজশাহীর তানোর উপজেলার একটি ইউনিয়নকে সরকার প্রথম ওয়াটার ট্রেস এরিয়া বা পানি সংকটপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘ডাসকো ফাউন্ডেশন’-এর সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (আইডব্লিউআরএম) পরিচালিত জরিপে বাধাইড় ইউনিয়ন এলাকাকে নিরাপদ পানির জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানি তোলা বন্ধে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) চেয়ারম্যান ড. আকরাম হোসেন বলেছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কৃষি মন্ত্রণালয় এ অঞ্চলে নতুন করে গভীর নলকূপ স্থাপন না করার নির্দেশ দিয়েছে।

সরকারের পানিবিষয়ক টাস্কফোর্সের সদস্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান যুগান্তরকে বলেন, ‘গত শুক্রবারও (১০ ফেব্রুয়ারি) আমি বাধাইড় ইউনিয়নের জোত গোকূল ও কালিকান্দর গ্রাম ঘুরে এসেছি। বিশেষ করে এই এলাকাতে খাবার পানির ভয়াবহ রকমের সংকট চলছে। এরই মধ্যে গভীর নলকূপ চালু থাকলেও খাওয়ার জন্য তা দিয়ে পানি উঠে না। তবে আনুষ্ঠানিক ওয়াটার ট্রেস এরিয়া ঘোষণা দেয়ার আগে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে এ অঞ্চলের বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রাম ঘুরে দেখছি, ডাটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করছি যাতে বিকল্প সমাধানের পথ খোঁজা যায়।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ষা মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়া, নদীর নাব্যতা সংকট, যত্রতত্র গভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে ইচ্ছামতো পানি উত্তোলন, নদীর উৎসমুখে বাঁধ দিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা ইত্যাদি কারণে এই অঞ্চলের পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচে নেমে গেছে। মরুময়তার আশংকা করা হচ্ছে।

পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত যুগান্তরকে বলেন, এ অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নামার ফলেই পানিস্বল্পতা দেখা দিয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানি অফুরন্ত নয়। ৫ থেকে ৬ বছর ধরে বর্ষাকালে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় গ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেল অনেক নিচে নেমে গেছে। পদ্মার পানির লেভেলটাও শুষ্ক মৌসুমে অনেক কম থাকে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিকের তুলনায় নিচে নেমে যায়। এছাড়া বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রকল্পের নলকূপ ছাড়াও অবৈধভাবে অসংখ্য নলকূপ বসিয়ে পানি তোলা হয়। এরফলেও পানি নিচে নেমে যাচ্ছে। এই সমস্যা সামাধানে এসব নলকূপ বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি গঙ্গার পানি বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে।

ডাসকো ফাউন্ডেশনের জরিপে জানা গেছে, ২০১৫ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলের ৩ পৌরসভা ও ১৫ ইউনিয়নকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বাধাইড় ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই ইউনিয়নে বিএমডিএ’র ৭০টি গভীর নলকূপ রয়েছে। ২০ বছর ধরে এই এলাকার দুই হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ সুবিধা দেয়া হলেও বর্তমানে তা বন্ধের পথে। ইতিমধ্যে বৌদ্যপুর মৌজার নলকূপটি বন্ধ হয়ে গেছে। ঝুঁকিতে আছে আরও ২৫টির বেশি। তানোরের বাধাইড় ও মণ্ডুমালা এলাকায় সরকারি ১৫ হাজার ও ব্যক্তিগত ৮ হাজার টিউবওয়েল রয়েছে। এর মধ্যে এখন ৯ হাজারের মতো টিউবওয়েলে পানি উঠে না।

সরেজমিন এসব এলাকা পরিদর্শনে দেখা গেছে, প্রায় ৭০ ভাগ কৃষি জমি অনাবাদি হয়ে পড়েছে। বহরলই মৌজার গভীর নলকূপ অপারেটর নুরুজ্জামান জানান, তার নলকূপ দিয়ে প্রথমে ২০০ বিঘার বেশি জমিতে সেচ দেয়া হতো। এখন তা ৩৫ বিঘায় নেমে এসেছে। খরচ বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। বাধাইড় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান, বছর দশেক আগেও ইউনিয়নে কুুয়া ও টিউবওয়েলের পানি দিয়ে মানুষ দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করত। কিন্তু পানির স্তর নেমে যাওয়ায় কূপ ও টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যায় না। বিএমডিএ তানোর জোনের প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম জানান, রাজশাহী জেলার অন্যসব ইউনিয়নের চেয়ে বাধাইড় ইউনিয়ন সবচেয়ে উঁচু। ফলে এ ইউনিয়ন নিয়ে চিন্তিত বিএমডিএ। তানোরের মণ্ডুমালা পৌর এলাকায় বসবাসকারী দুই বোন সীমা (১৫) ও দীবা (৮) জানায়, প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি আনতে হচ্ছে। একই এলাকার ১১ বছর বয়স্ক জেসি জানায়, রান্না-খাওয়ার পানির জন্য প্রতিদিন পাশের গ্রামে যেতে হয়। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে পানি আনতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই চলছে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকার কি ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে জানতে চাইলে পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সরকার আন্তরিক। গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সমস্যার সমাধন হবে। প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চলছে। আশা করি দ্রুত দু’দেশ একটি সমাধানে পৌঁছতে পারবে।

ডাসকোর আইডব্লিউআরএম প্রকল্পের সহকারী সমন্বয়ক জাহাঙ্গীর আলম খান শনিবার যুগান্তরকে জানান, একযুগ আগেও এই অঞ্চলে ৬০ থেকে ৯০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে ১৬০ ফুট বা তার নিচে না গেলেও পানি মিলছে না। ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০-৪৫ মিটার উঁচুতে অবস্থান করছে। ঝুঁকিপূর্ণ ইউনিয়ন ও পৌর এলাকাগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে আবাদ বন্ধ করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ঠেকাতে বিদ্যমান বড় পুকুর ও খাড়ি খনন করে ভূমির ওপরের পানি ব্যবহার বাড়াতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু তানোর উপজেলাতেই এবার ১৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। আলুতে অন্তত চার দফা সেচ দিতে হয়। আর এসব সেচ দেয়া হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি থেকেই। এছাড়া বাধাইড় ইউনিয়নের পরই দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। এর অন্যতম কারণ হল এই একটি ইউনিয়নেই রয়েছে ৩২টি অটোরাইস মিল। এসব মিলে অন্তত ২০০টি গভীর নলকূপে অনরবত পানি তোলা হচ্ছে। ফলে এর সংকট ভয়াবহ হচ্ছে।

আইডব্লিউআরএম প্রকল্পের বাধাইড় ইউপি ও মুণ্ডমালা পৌরসভা এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আগস্টিনা হাঁসদা বলেন, এসব পৌর ও ইউনিয়নে পানির স্তরপরিমাপক কূপ বসানো হয়েছে। প্রতি মাসে দু’বার করে মাপা হচ্ছে। বাধাইড় ইউনিয়নের অবস্থা বেশি খারাপ। বাধাইড় ইউনিয়নের ঝিনাইখোর এলাকায় ২০১৫ সালে পানির স্তরপরিমাপক কূপ বসানো হয়। তখন পানির স্তর ছিল ৯৯ ফুট নিচে। ২০১৭ সালে ১১১ ফুট ৯ ইঞ্চি নিচে পানির স্তর পাওয়া পাচ্ছে। বিষয়টি অ্যালার্মিং।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক যুগান্তকে বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্বাভাবিকতা রক্ষার জন্য গঙ্গার পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। গঙ্গায় পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফসল উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেন, ২০১১ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানি চুক্তি সম্পাদন হওয়ার কথা ছিল। সেই চুক্তি এখনও না হলেও ভারত সরকার একাধিকবার বলেছে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কাজ তারা করবে না। এখন সরকারের উচিত শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গায় পানি না থাকায় যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে তা ভারত সরকারকে জানানো। এ সমস্যা সমাধানে দ্রুত সরকারি পর্যায়ে আলোচনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

প্রসঙ্গত ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা পানি চুক্তি সই করেছিল বাংলাদেশ ও ভারত। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের কাছে পানি ছাড়ছে ভারত। তবে বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে পানির নায্য হিস্যা না পাওয়ার অভিযোগ করছে বরাবরই। গঙ্গা চুক্তির পানিসহ সারা বছর নদীগুলোতে যে পানি পাওয়া যায় তা শেষ পর্যন্ত নেমে যায় সাগরে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট থেকেই যাচ্ছে। এই পানি সাগরে যেতে না দিয়ে জলাধার বা ব্যারেজ তৈরি করতে পারলে শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির সংকট কাটানো সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
http://www.jugantor.com/last-page/2017/02/18/102165/%E0%A6%89%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%95%E0%A6%9F-:-%E0%A6%AE%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%AE%E0%A7%9F%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%B6%E0%A6%82%E0%A6%95%E0%A6%BE