১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ১০:৫৩

রাজধানীর বিপণিবিতান: ৯৬% বিপণিবিতান ঝুঁকিপূর্ণ

মেঝের আয়তন, অবস্থানকারী জনসংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, লিফট, স্মোক হিট ডিটেক্টর, মাটির নিচের জলাধারের ধারণ ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয় খতিয়ে দেখে ঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতান চিহ্নিত করা হয়
ঢাকার ১ হাজার ১২৬টি বিপণিবিতানের মধ্যে আগুন ধরলে নেভানোর যথাযথ ব্যবস্থা আছে মাত্র ৪৬টিতে। এই তথ্য সরকারের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের। তারা বলছে, অনিরাপদ এসব বিপণিবিতানের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, পুলিশের মালিকানাধীন বিপণিবিতানগুলো যেমন আছে, তেমনি আছে বিলাসবহুল বিপণিবিতানও।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক শাকিল নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগার পর ঢাকায় সংস্থাটির চারটি অঞ্চলেরই কর্মকর্তাদের পরিদর্শনে পাঠানো হয়। পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬১৯টি বিপণিবিতান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, ৪০০টি ঝুঁকিপূর্ণ। পুরোনো বিপণিবিতানগুলো যেসব ভবনে, তার বড় অংশেরই বৈদ্যুতিক তার নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলোতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। বেশির ভাগ নতুন ভবনে ‘নিরাপত্তা’র বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পরিদর্শনের কাজ শুরু করে গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগার পর। ওই অগ্নিকাণ্ডে ৩৮৯টি দোকান পুড়ে যায়, ভবন ধসে পড়ে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ খুঁজে দেখছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ছাড়াও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তদন্ত কমিটি, পুলিশের বিশেষ শাখা সিআইডি ও এসবি। এখন পর্যন্ত কোনো সংস্থাই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিদর্শন তালিকা থেকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে বড় ১০টি বিপণিবিতান ঘুরে দেখা হয়। বিপণিবিতান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অগ্নিনিরাপত্তা বলতে তাঁদের অনেকেই শুধু ‘ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার’কে (অগ্নিনির্বাপক) বুঝে থাকেন।
ভবনের উচ্চতা, দোকান ও ক্রেতা-বিক্রেতা অনুপাতে কতগুলো অগ্নিনির্বাপক প্রয়োজন, সে সম্পর্কে অধিকাংশের ধারণা নেই। এই অগ্নিনির্বাপকগুলো আবার দোকানের সবাই ব্যবহারও করতে পারেন না। অবকাঠামোটি কতটা নিরাপদ, সে সম্পর্কেও তাঁরা খুব ভালো জানেন না। এ ছাড়া অতিরিক্ত লোকসমাগম হয় যেসব জায়গায়, সেসব জায়গায় স্মোক/হিট ডিটেক্টর লাগানোর যে শর্ত আছে সেগুলোও মানা হয় না। স্মোক হিট ডিটেক্টরের কাজ হলো একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ধোঁয়া তৈরি হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সতর্কসংকেত বাজানো ও পানি ছিটানো।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, শুধু অগ্নিনির্বাপক বা পানির ব্যবস্থা থাকলেই আগুন থেকে বাঁচা যাবে, বিষয়টি এমন নয়। ভবনটি তৈরির ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা থাকলেও আগুন লাগতে পারে, ছড়িয়ে পড়তে পারে। বাংলাদেশের অন্যতম বড় বিপণিবিতানে কিছুদিন আগে আগুন লাগে সব রকম আধুনিক ব্যবস্থা থাকার পরও। ওই আগুন যে দোকানে লেগেছে সেখানেই স্থির থাকার কথা ছিল। কিন্তু দোকানগুলোর দেয়াল ছাদ পর্যন্ত লাগানো ছিল না। ছিল ফলস সিলিং। ফলস সিলিং সহজেই পুড়ে যাবে, এমন উপকরণে বানানোয় এক দোকান থেকে আগুন অন্য দোকানে ছড়িয়ে যায়।
পরিদর্শনে যা পাওয়া গেছে
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিদর্শন দল বিপণিবিতানের মেঝের আয়তন, অবস্থানকারী জনসংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, জরুরি নির্গমন সিঁড়িসহ মোট সিঁড়ি ও লিফটের সংখ্যা, স্মোক হিট ডিটেক্টর, মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা, ফায়ার পাম্প বা জকি পাম্প, প্রতিটি ফ্লোরে সতর্কসংকেত বাজে কি না, রাইজার বা হোজ রিল, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, বৈদ্যুতিক তারসহ অন্যান্য সাজসরঞ্জাম আছে কি না, বিপণিবিতানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ হয় কি না, তা খতিয়ে দেখে। যেসব বিপণিবিতান এসব শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, তাদেরই ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে সংস্থাটি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বিবেচনায় পুরান ঢাকার শতভাগ বিপণিবিতান ঝুঁকিপূর্ণ। অগ্নিনির্বাপণকারী সংস্থাটির ঠিক উল্টো দিকে বঙ্গবাজার। এর অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একজন ফায়ার ফাইটার বলেন, ‘ভয় হয়, আগুন ধরলে একটা লোকও বাঁচবে না।’
১৯৯৫ সালে একবার বঙ্গবাজারে আগুন লেগেছিল। এই বাজারটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন। চার ভাগে দোকানের সংখ্যা ২ হাজার ৩৭০টি। সপ্তাহখানেক আগে কথা হচ্ছিল বঙ্গবাজারের ব্যাগ বিক্রেতা মিঠু মিয়ার সঙ্গে। আগুন লাগলে কী করবেন, নেভানোর কী ব্যবস্থা আছে, জানতে চাইলে তিনি তৃতীয় তলায় মালিকপক্ষের অফিসে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। শাড়ি, শীতবস্ত্রে ঠাসা দোকানগুলোর মধ্য দিয়ে কোনোরকমে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়। এখানে আগুন লাগলে উপায় কী—জানতে চাইলে বেশ কয়েকজন শাড়ি বিক্রেতা বললেন, আগুন লাগবে না। লাগলেও কিছু হবে না। কারণ, বঙ্গবাজারের নিরাপত্তারক্ষীরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন নিউমার্কেট রাজধানীর অন্যতম প্রাচীন ও জনপ্রিয় বিপণিবিতান। নিউমার্কেটে পাঁচটি অংশ। দক্ষিণ অংশের কার্যালয়ে বসে কথা হচ্ছিল মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন নিউমার্কেটের শুধু এই অংশে ১০ হাজার মানুষের সমাগম হয়। দোকানের সংখ্যা ১ হাজার ২০০। আগুন লাগলে কী করবেন জানতে চাইলে বলেন, মাঝে মাঝে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগে। তাঁরা নিজেরাই নিভিয়ে ফেলেন। মার্কেটে ১২টি অগ্নিনির্বাপক আছে। জিনিসপত্রে ঠাসা এই বিপণিবিতানে আগুন লাগলে লোকজন কীভাবে বেরোবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মার্কেটে কমিটি আছে। মালামাল বেশি হলে তারা তদারকি করে। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক মিস্ত্রিও আছেন। নিউমার্কেটের এই অংশে দোকান করেন আবদুর রহমান। হালকা গড়নের ওই বৃদ্ধ দোকানি গজ কাপড়ের স্তূপের পেছন থেকে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন। আগুন লাগলে কী করবেন জানতে চাইলে বলেন, ‘জানি না।’
একই রকম ঝুঁকিপূর্ণ আজিজ সুপার মার্কেট। মার্কেটের একটি বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকানে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল জয়দেব দের সঙ্গে। তিনি বলেন, মার্কেটের পাশে ওষুধের দোকান, সেখানে প্রায়ই আগুন লাগে। তবে মার্কেটে আগুন লাগলে কী করতে হবে, তা নিয়ে কখনোই কোনো আলোচনাও হতে দেখেননি।
ধানমন্ডির রাপা ও মেট্রো শপিং মল দিয়ে ঢাকার আধুনিক শপিং মলের সূচনা। রাপা প্লাজার ব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৮ সালে এই বিপণিবিতানটি যখন চালু হয়, তখন সব শর্তই মানা হয়েছিল। এখন ফায়ার সার্ভিস থেকে সংকেত বাজার ব্যবস্থা আছে কি না, উত্তপ্ত হয়ে উঠলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা আছে কি না জানতে চাওয়া হচ্ছে। এগুলো নেই। তবে তিনি দাবি করেন, তাঁদের মাটির নিচের জলাধারে ১ লাখ লিটার পানি জমিয়ে রাখার ব্যবস্থা আছে। পাশের ভবনে যখন আগুন লাগে তখন তাঁদের কাছ থেকে পানি নিয়ে আগুন নেভানো হয়েছিল বলে তিনি জানান।
মেট্রো শপিং মলের ব্যবস্থাপক আবদুল মোতালেবের দাবি, তাঁদের বিপণিবিতানে আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। পর্যাপ্ত ব্যবস্থা বলতে কী বোঝাচ্ছেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁদের জলাধারে সব সময় দুই হাত পরিমাণ পানি থাকে। এ ছাড়া তাঁদের অগ্নিনির্বাপক আছে। বছরে একবার ফায়ার ড্রিলেরও ব্যবস্থা আছে বলে জানান। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আরও একটা জরুরি নির্গমন সিঁড়ি থাকা উচিত ছিল বলে জানিয়েছে। এই মার্কেটে আগেও আগুন লেগেছে। তাঁরা যথেষ্ট নিরাপদ কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘রাজউক তো ভবনের অনুমোদন দিয়েছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের কাছে ভালো বিপণিবিতান। ফায়ার সার্ভিস ডাকলেই ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। আশা করি সমস্যা হবে না।’
গুলশান-১ নাভানা টাওয়ার শপিং কমপ্লেক্স এখনো ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র পায়নি। তবে দোকান মালিক সমিতির ব্যবস্থাপক মো. দেলোয়ার ইবনে সালাম বলেছেন, তাঁরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই নিভিয়ে ফেলতে পারবেন। ফায়ারের ছাড়পত্র পেতে যা যা লাগে তার মধ্যে শুধু প্রতিটি ফ্লোরে সংকেত বাজার ব্যবস্থা নেই। তিনি আরও বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস যেভাবে চায় সে রকম কোনো ভবন দেশে আছে কি না আমার জানা নেই।’
গুলশান-২-এর পিংক সিটি শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণ করেছে ছায়া ডেভেলপার লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মা. জাফরুল্লাহও দাবি করেছেন, অগ্নি-দুর্ঘটনা মোকাবিলার সব ব্যবস্থা তাঁদের আছে। তবে শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক লুৎফর রহমান বলেছেন, তাঁদের বিপণিবিতানের প্রতি তলায় হোজ রিল আছে। তবে স্মোক বা হিট ডিটেক্টর নেই, ফায়ার পাম্প বা জকি পাম্পও নেই। তা ছাড়া, ফায়ার সার্ভিসের শর্ত অনুযায়ী সবই আছে।
ঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতানগুলো নিয়ে কী হবে
গত বছরের জুন মাসে উত্তরার ট্রপিক্যাল আলাউদ্দিন মার্কেটে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান নয়জন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তালিকায় এই মার্কেটটি ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’। বিপণিবিতানে গিয়ে পলাশ মাহমুদ নামের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি দাবি করেন, এখন আর কোনো সমস্যা নেই। তাঁরা রাজউক, তিতাস গ্যাসসহ সব কটি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি আছে কি না জানতে চাইলে বলেন, ছাড়পত্র না নিলেও মৌখিকভাবে জানিয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার। তিনি তাজরীন ফ্যাশনস দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে গবেষণা করেছেন। মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নি-দুর্ঘটনার একমাত্র কারণ তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারির অভাব। কেউ খোঁজ রাখছে না, অপরাধের বিচার হচ্ছে না। তাই দায়সারাভাবে চলছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1083675/%E0%A7%AF%E0%A7%AC%25-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A6%A3%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%9D%E0%A7%81%E0%A6%81%E0%A6%95%E0%A6%BF