১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১০:৪৩

অস্থির গুঁড়ো দুধের বাজার

আমদানি করা কৌটাজাত গুঁড়োদুধসহ বিভিন্ন বিকল্প ‘শিশুখাদ্যের’ দাম হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুধের দাম বেড়েছে কৌটাপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। আর গত বছরের তুলনায় এসব দুধের দাম ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিসংখ্যান এবং রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা-পাইকারি বাজার থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো মোড়কজাত পণ্যের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে ট্যারিফ কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে দাম বৃদ্ধি করতে হয়। এছাড়া পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রদানের মাধ্যমে ক্রেতাদের জানাতে হয়। কিন্তু গুঁড়ো দুধের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোনো নিয়মই কোম্পানিগুলো মানেনি বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। গুঁড়ো দুধ যেহেতু শিশুখাদ্য সেহেতু এই পণ্যটির দাম যেন সাধারণের নাগালে থাকে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ নজর দেয়ার আহ্বান জানান তারা।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে দেশি ও বহুজাতিক দুই ধরনের কোম্পানিই তাদের সরবরাহকৃত ব্র্যান্ডের গুঁড়োদুধের দাম বাড়িয়েছে। তবে বহুজাতিক ও দেশি কোম্পানির মধ্যে গুঁড়োদুধের দাম বৃদ্ধির চিত্রে সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়নি। বাজারে বর্তমানে ভোক্তা পর্যায়ে বহুজাতিক কোম্পানি ‘ডানো’ প্রতি কেজি ননীযুক্ত দুধ (মোড়কে সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য) বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা, যা আগে ৫৮০ টাকা ছিল। সেখানে দেশের ব্র্যান্ড মার্কস প্রতি কেজি দুধের দাম আগের ৪৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা নির্ধারণ করেছে। একই ব্র্যান্ডের আধা কেজি দুধ ৩৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ২৭০ টাকা। এছাড়া ফ্রেশ ব্র্যান্ডের প্রতি কেজি প্যাকেট ৫৫ টাকা বাড়িয়ে ৪৯০ টাকা ও ৩০ টাকা বাড়িয়ে ৫০০ গ্রামের প্যাকেট ২৬৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
হুট করে দুধের এই বাড়তি দামের কারণ স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেনি। তবে বিক্রেতারা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বাজারের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দাম সামান্য বেড়েছে। ২০১২ সালে বিশ্ববাজারে দুধের দাম ছিল প্রতি টন প্রায় ৩ হাজার ডলার। কিন্তু ২০১৩ সালে ওই দুধের দাম ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার ডলারে ওঠে। গত পাঁচ বছরে সেটাই ছিল সর্বোচ্চ দর। কারণ এর পরের বছরে দ্রুত গুঁড়োদুধের দামে পতন হয়। সেই বছর গুঁড়েদুধের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে আসে। সেই নিম্নমুখী বাজার কার্যকর ছিল গত বছরের জুলাই পর্যন্ত। এরপর থেকে আবার দ্রুত গুঁড়ো দুধের দর বাড়ছে। এ বছর শুরুতে গুঁড়ো দুধের দাম সাড়ে ৩ হাজার ডলারে এসে ঠেকেছে।
গ্লোবাল ডেইরি ট্রেডের তথ্যানুসারে, ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে গুঁড়োদুধের দাম ছিল প্রতি টন ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ ডলারের মধ্যে। ২০১৩ সালে এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৫ হাজার থেকে ৫ হাজার ২৪৫ ডলারে পৌঁছে, যা গত সময়ের সর্বোচ্চ। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্ববাজারে গুঁড়োদুধের দাম কমতে শুরু করে; যা ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এসে মাত্র ১ হাজার ৫৯০ ডলারে নেমে যায়। কিন্তু ২০১৬ সালের জুলায় থেকে গুঁড়োদুধের দাম আবার ঊর্ধমুখী। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ দাম ২ হাজার ৬২ ডলার থেকে বাড়তে বাড়তে ৩ হাজার ৫৯৩ ডলার পর্যন্ত হয়েছিল। এর প্রভাবে বিভিন্ন কোম্পানি গুঁড়োদুধের দাম বাড়িয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, এ পর্যন্ত বহুজাতিক কোম্পানির গুঁড়ো দুধের দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা। কিন্তু দেশি কোম্পানিগুলোর ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এ ছাড়া বাজারে দেশে ব্র্যান্ড যেমন কোয়ালিটি, প্রাণ, ড্যানিশ, আড়ং, মিল্ক ভিটা, টুডের গুঁড়োদুধ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
বেশিরভাগ কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় সব কোম্পানিই দাম বাড়িয়েছে। তবে দাম যেটুকু বেড়েছে, তা সম্পূর্ণ ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তে। তবে সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্ববাজারের যে অজুহাতে দেশে দুধের দাম বাড়ানো হচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ যৌক্তিক নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে গুঁড়োদুধের দাম কমার ক্ষেত্রে তা সহসাই সমন্বয় হয়নি। কিন্তু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে দাম সমন্বয় হচ্ছে।
একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক তৌফিক আলী বলেন, প্রতি মাসেই তার মেয়ের জন্য গুঁড়ো দুধ কিনতে হয়। সম্প্রতি দুধ কিনতে গিয়ে দেখি, ১৮০০ গ্রাম এককৌটা গুঁড়ো দুধের দাম ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়েছে। এ নিয়ে দোকানির সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়। এভাবে হুট করে দাম বাড়ানো হলে আমাদের মতো নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে সমস্যায় পড়তে হয়।
কাওরান বাজারের বিক্রতা আবুল হোসেন বলেন, বিদেশে দাম বাড়লেই সঙ্গে সঙ্গে দেশি কোম্পানিরা লাফিয়ে লাফিয়ে মূল্য বাড়ায়। কিন্তু কমলে তার খবর থাকে না। তার মন্তব্য, পাইকাররা হঠাৎ করেই গুঁড়ো দুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই আমরাও বাড়াই। এ নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে কয়েক দিন ধরে বাকবিতণ্ডা হচ্ছে।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কর্মকর্তা হুমায়ুুন কবীর বলেন, কোম্পানিগুলো নিয়ম না মেনে দাম বাড়িয়েছে। নজরদারিরও অভাব আছে। হুট করে দাম বাড়ানোর কারণে ভোক্তাসাধারণকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
টিসিবি থেকে সরবরাহ করা পণ্যের মূল্যতালিকায় দেখা যায়, গত এক মাসে ডানো, ডিপ্লোমা, মার্কস, ফ্রেশ ব্র্যান্ডের গুড়ো দুধের মূল্য ২ থেকে আড়াই শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ডানো প্রতি কেজি ৫৭০ থেকে ৫৮০ টাকা, ডিপ্লোমা ৫৪৫ থেকে ৫৫০ টাকা, ফ্রেশ ৪২০ থেকে ৪৫০ টাকা এবং মার্কস ৪২০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগে ডানো প্রতি কেজি ৫৪০ থেকে ৫৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। তবে বিকল্প শিশুখাদ্য হিসাবে পরিচিত কোনো গুঁড়ো দুধের নাম ওই তালিকায় নেই।
http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=54146&cat=3/%E0%A6%85%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%81%E0%A7%9C%E0%A7%8B-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%A7%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B