১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১০:৪১

জ্বালানি তেলের দাম কমালে জিডিপি বাড়ে

অর্থ মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ : তেলের দাম কমলে বেড়ে যায় রফতানি, বেসরকারি বিনিয়োগ, কমে মূল্যস্ফীতি; দ্রুত জ্বালানি তেলের দাম কমানোর পরামর্শ অর্থ মন্ত্রণালয়ের; দাম কমাতে রাজি হচ্ছে না জ্বালানি মন্ত্রণালয়


জ্বালানি তেলের দাম কমালে জিডিপি বাড়ে। একই সাথে বৃদ্ধি পায় কৃষি ও শিল্প উৎপাদন। বেড়ে যায় রফতানি ও বেসরকারি বিনিয়োগ। কমে মূল্যস্ফীতি। এ জন্য জ্বালানি তেলের দাম দ্রুত কমানোর পরামর্শ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তেলের দাম কমানো হলে এর প্রভাব অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের ওপর কী হবে, তারও একটি বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। এ বিবরণটি এখন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছেন।
কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একাধিকবার জ্বালানি তেলের দাম কমানোর পরামর্শ দিলেও তা মানতে চায় না জ্বালানি মন্ত্রণালয়, বরং নানা ‘ওজর-আপত্তি’ দিয়ে তারা তেলের দাম কমাতে চায় না। এ ক্ষেত্রে কোনো যুক্তিও তারা মানতে চায় না বলে জানা গেছে।
অপর দিকে তেলের দাম কমানোর সুফল বর্ণনা করে বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যের সাথে সমন্বয় করা হলে অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাবসহ এর সুফল দেশের জনগণের কাছে পৌঁছে। জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় বা হ্রাসের পর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থনৈতিক সমীক্ষায় প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা দেয়া যায়, ২০১৪-২০১৫ থেকে ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, একই সময় রফতানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ, বেসরকারি বিনিয়োগ ২২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ থেকে ২২ দশমিক ৯৯ শতাংশে উত্তীর্ণ হয়েছে। শুধু তাই নয়, জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ফলে দেশে মূল্যস্ফীতিও কমে এসেছে। চলতি ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে ৭ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ।’
এখানেই শেষ নয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবরণে তেলের দাম কমানোর সুফল সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে, ‘মূলত জ্বালানি তেলের দাম কমানো হলে অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে এর সুফল পাওয়া যায়। দেশের মোট চাহিদার বেশির ভাগই অর্থাৎ ৩৩ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল বছরে প্রয়োজন হয়। এর মূল্য সমন্বয় বা হ্রাস করা হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, বিনিয়োগ, পরিবহন, কৃষি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে প্রতীয়মান হয়।’ এই ডিজেল বাংলাদেশে জ্বালানি হিসেবে বেশি ব্যবহার করা হয় এবং তা ব্যবহৃত হয় শিল্পকারখানায় ও কৃষিতে পানি সেচের কাজে। এতে করে কৃষি উৎপাদন খরচও কমে যায়।
ডিজেল বিক্রি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রচুর মুনাফা করছে উল্লেখ করে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ডিজেলের ক্ষেত্রে দেখা যায় ৮৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ আমদানি এবং ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ পরিশোধনের পর বিক্রি করা হয়। বিপিসির জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২০১৬-এর তথ্য মতে, (১২ মাসে) শুধুু আমদানিকৃত ডিজেল থেকে গড়ে লিটারপ্রতি লাভ হয় ১৪ টাকা এবং স্থানীয়ভাবে পরিশোধনের পর লাভ হয় ২৬ টাকা ২১ পয়সা। যেহেতু বেশির ভাগ ডিজেলই আমদানি করে সরাসরি বিক্রি করা হয়, তাই হিসাব করলে দেখা যায় ২০১৬ সময়ে এ বাবদ গড়ে লাভ হয় চার হাজার ৮৪৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। অপর দিকে স্থানীয়ভাবে বিক্রিতে লাভ হয় এক হাজার ২৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। ফলে ২০১৬ সালে মোট ডিজেল বিক্রি করে বিপিসির মুনাফা হয়েছে ছয় হাজার ৬২৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। দুই বছরে এই লাভ হবে আনুমানিক ১৩ হাজার ২৫১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ’
পরিশেষে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করা হয়েছে, ‘পুনরায় জ্বালানি তেলের দাম কমানো হলে উল্লেখিত খাতসহ অর্থনীতির অন্যান্য খাতও এর সুফল পাবে।’
এরই প্রেক্ষাপটে গত জানুয়ারি মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চার ধরনের তেলের দাম কমানোর জন্য একটি প্রস্তাব অর্থমন্ত্রীর কাছে দেয়া হয়েছে। এই তেলগুলো হচ্ছেÑ ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেন। লিটারপ্রতি ডিজেল ও কেরোসিন ৮ শতাংশ এবং পেট্রল ও অকটেনের দাম ৫ শতাংশ কমানোর সুপারিশ করা হয়। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলের দাম কমানোর কোনো প্রস্তাব দেয়া হয়নি। কারণ, বিগত দিনে এই তেলের দাম লিটারপ্রতি ৩০ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছিল।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতি লিটার অকটেন বিদ্যমান ৮৯ টাকা থেকে কমিয়ে ৮৪ দশমিক ৫৫ টাকা, পেট্রল ৮৬ টাকা থেকে ৮১ দশমিক ৭০ টাকা, ডিজেল ও কেরোসিন ৬৫ টাকা থেকে কমিয়ে ৬০ টাকা করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বিমানের জন্য জেট ফুয়েল ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলের মূল্য কমানোর কোনো প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে না। এগুলো বিদ্যমান দামে বিক্রি হবে। এখন এ দু’টি পণ্য লিটারপ্রতি বিক্রি হচ্ছে জেট ফুয়েল ৬৩ টাকা ও ফার্নেস অয়েল ৪২ টাকা করে।
চার ধরনের তেলের দাম কমানো হলেও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এগুলো বিক্রি করে লাভ করবে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রস্তাব অনুযায়ী তেলের দাম হ্রাস করা হলেও বিপিসি লিটারপ্রতি অকটেনে মুনাফা করবে ছয় টাকা ৯ পয়সা, কেরোসিনে ১০ টাকা ৫৬ পয়সা, ডিজেলে তিন টাকা ২২ পয়সা ও পেট্রলে মুনাফা হবে পাঁচ টাকা আট পয়সা। আর বছরে এই চার পণ্য বিক্রিতে বিপিসির মুনাফা দাঁড়াবে মোট এক হাজার ৮৫৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/197113