১৩ জুলাই ২০১৮, শুক্রবার, ১১:২৮

হ্যাকিং করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র

হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিদেশি চক্র। তাদের টার্গেট এখন বাংলাদেশ। ভ্রমণ ভিসায় এই দেশে এসে বসবাস করছে চক্রের সদস্যরা। স্থানীয় অপরাধীদের সঙ্গে মিশে তৈরি করছে ভয়ঙ্কর অপরাধ সিন্ডিকেট। প্রকৃত পরিচয় গোপন করে একেক সময় একেক স্থানে বসবাস করে তারা। নানা কৌশলে এই অপকর্ম করে যাচ্ছে চক্রটি।

প্রায়ই বিভিন্ন ব্যক্তি ও কোম্পানির টাকা লুটে নিচ্ছে তারা। সর্বস্ব হারিয়ে অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হচ্ছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হ্যাকাররা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা ভিনদেশি হওয়ায় হ্যাক করার পর দ্রুত দেশত্যাগ করে অনেকে। অনেকে দেশের বাইরে থেকে দেশে অবস্থান করা চক্রের সদস্যদের তথ্যানুসারে ই-মেইল, ফেসবুক ইত্যাদি হ্যাক করে। এছাড়া প্রায়ই একই নামে ই-মেইল তৈরি করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভুয়া মালিক সেজে যোগাযোগ করে। অন্যের একাউন্টের টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রতারক চক্রের সদস্যরা কখনও কখনও গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বের হয়ে আবারও একই অপকর্মে লিপ্ত হয়।

গত জানুয়ারিতে ইমদাদুল হক নামে ঢাকার একজন ব্যবসায়ীর প্রায় অর্ধ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে হ্যাকিং চক্রের সদস্যরা। এ বিষয়ে থানায় মামলা করতে গেলে তা গ্রহণ না করে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেয় পুলিশ। গত ৬ই এপ্রিল সাইবার ট্রাইব্যুনালে পিটিশন মামলা করেন ইমদাদুল হক। মামলা সূত্রে জানা গেছে, তার এশিয়ান ওভারসেজ ট্রেডিং কোম্পানি একটি অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের ই-মেইল ব্যবহার করে নেদারল্যান্ডভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘আনসালড তমাসেন বিভি’র সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছিলেন ইমদাদুল হক। ঘটনাটি ঘটে ১৬ই জানুয়ারি। ইমদাদুল হকের ই-মেইল হ্যাক করে একই নামে নতুন ই-মেইল করে শুধু মেইল শব্দ সংযোজন করে হ্যাকার চক্র। তারপর প্রতিষ্ঠানের লেটার হেড পরিবর্তন করে। সিল সাক্ষর জাল করে হ্যাকারদের প্রতিষ্ঠান ‘এএলসি এন্টারপ্রাইজ আসিয়ানা’র নামে আমেরিকান ব্যাংকে ই-মেইল পাঠায়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইমদাদুল হক সেজে ই-মেইলের মাধ্যমে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নতুন হিসাব নম্বরে ডলার পাঠাতে অনুরোধ করা হয়। যথারীতি অনুসারে ব্যাংক ডলার ট্রান্সপার করে দেয়। এতে প্রায় অর্ধকোটি টাকা লুটে নেয় হ্যাকাররা।

একইভাবে হ্যাকারদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন ব্যবসায়ী নবাব আলী। তিনি রাজধানীর বারিধারার ডিওএইচএস এলাকার ১২ নম্বর সড়কের ৫৪২ নম্বর বাড়ির মৃত চাঁদ আলীর পুত্র। নবাব আলী দীর্ঘদিন ধরে ‘সকপো করপোরেশন ইউএসএ’র সঙ্গে ব্যবসা করছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, তার ই-মেইল হ্যাক করে সকপো করপোরেশনে ভুয়া ই-মেইল পাঠিয়ে প্রায় ১৫ লাখ টাকা লুটে নেয় চক্রটি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নাইজেরিয়ান এক নাগরিক ও বাংলাদেশি এক নারী ও পুরুষ মিলে হ্যাক করে প্রতারণার মাধ্যমে এই টাকা লুট করে। আমেরিকা থেকে তারা টাকা আনে দেশের একটি ব্যাংকের গুলশান শাখায়। ‘রয়েল এসকট ভেনসারস লিমিটেড’ নামে প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ব্যাংকে একাউন্ট করা হয়েছে। এতে রামপুরা বনশ্রীর ই ব্লকের পাঁচ নম্বর সড়কের ৪০ নম্বর বাড়িতে তাদের অফিস রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে চক্রটি।
সূত্রমতে, এটিএম কার্ড জালিয়াতি, ই-মেইল হ্যাকিং, বিদেশি জাল মুদ্রা তৈরি, মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িত এই চক্রের সদস্যরা। তাদের বেশিরভাগই ঘানা ও নাইজেরিয়ার নাগরিক। এরমধ্যে কিংসলে লিভিং স্টোন নামে এক নাইজেরিয়ান রয়েছেন। বারিধারা এলাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতো কিংসলে। ওই সময়ে বাংলাদেশি নাগরিক সোনিয়া শারমিনের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। ওই এলাকাতেই একটি বাসায় থাকে তারা। ইতোমধ্যে প্রতারণার অভিযোগে কিংসলে ও সোনিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কিংসলের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে দেশের বাইরের ও ঢাকার কিছু অপরাধীর। মেইল হ্যাক ও রাতারাতি ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে এই চক্র। এছাড়াও ই-মেইলের তথ্য চুরি করে ব্যাংক একাউন্ট থেকে ব্যালেন্স ট্রান্সপার করে চক্রটি। তারা ঢাকার শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে অপতৎপরতা চালায়।

এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বসিয়ে এটিএম কার্ড জালিয়াতির অভিযোগে ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত জার্মান নাগরিক, প্রাইম ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে জালিয়াতি করে অর্থ উত্তোলনের দায়ে চীনা নগরিক, জাল টাকা তৈরির মেশিনসহ কোরিয়ান নাগরিকসহ প্রায়ই নানা অপরাধে বিদেশিরা গ্রেপ্তার হচ্ছে। হ্যাকিং সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের রফিকুল ইসলাম বলেন, হ্যাকিং করে অর্থ আত্মসাৎকারীরা আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্য। তারা দেশে-বিদেশে অবস্থান করে। যে কারণে অনেক সময় তাদের গ্রেপ্তার করা দুস্কর হয়ে যায়। তারপরও আমরা এই চক্রের কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছি। এ বিষয়ে এনসিআই ইন্টারপোল আরও সক্রিয় হলে চক্রটির অপতৎপরতা রোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=125439&cat=2/