১১ জুলাই ২০১৮, বুধবার, ১০:০৭

দেশের রাজনীতি ও জনগণকে বিভিন্নপন্থীতে ভাগ করা কা-জ্ঞানহীনতা

বিদেশের মাটিতে বসে বাংলাদেশের রাজনীতি ও জনগণকে ভারত, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভাজন করে সরকারি দলের বক্তব্যে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এর মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জনগণকে চরমভাবে অপমানিত করা হয়েছে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
গত ৭ জুলাই ২০১৮ তারিখে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে একটি মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও সরকারের অন্যতম নীতিনির্ধারক এইচ.টি ইমাম বাংলাদেশের রাজনীতিকে ভারত, পাকিস্তান ও চীনের রাজনীতির মধ্যে বিভাজিত করে বক্তব্য দেন। ভাষ্যকাররা বলছেন, সেখানে জনাব ইমাম যে বক্তব্য ও মন্তব্য করেন তাতে তিনি বুঝাতে চান যে, ভারতের যা কিছু লাভ তা কেবল আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেই সম্ভব। আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে সমর্থন না দিতে এবং আবারো আ’লীগকে ক্ষমতায় আনতে ভারত সরকারের সহযোগিতা চাওয়ার জন্য ভারতকে প্রকারান্তরে তোয়াজ করেন তিনি। তাঁর মতে, বিএনপিজোট ক্ষমতায় আসলে ভারতের ক্ষতি আর পাকিস্তান ও চীনের লাভ হবে। তিনি নিজেকে ভারতের মুখপাত্র সাজিয়ে উল্লেখ করেন, বিএনপির মতো পাকিস্তানপন্থী ও জামায়াত-সমর্থক দলের ওপর দিল্লী কিছুতেই ভরসা রাখবে না এবং বিশ্বাস করবে না। এইচটি ইমাম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ভারতের মন ভোলানোর হাজার চেষ্টা চালালেও বিএনপির নেতারা সফল হবেন না।’ আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে সমর্থন না দিতে এবং সেই সাথে আবারো আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে ভারত সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হয় এই বক্তব্যের মাধ্যমে। জনাব ইমাম আরো বলেন, কিছুদিন আগে বিএনপির তিন নেতা দিল্লীতে এসেছিলেন। আমি তাদের কারো নাম বলবো না, তবে তাদের একজন তো আমাদের দেশে পাকিস্তান ও চীনের এজেন্ট হিসেবেও দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত।

ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর এই রাজনৈতিক উপদেষ্টা আরো নানা দ্বিপক্ষীয় ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে খোলামেলা মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে যে ধরনের গভীর সম্পর্ক আছে, আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক তার কোনও তুলনাতেই আসবে না। বরং পাকিস্তান আমাদের চিরশত্রু একটা দেশ, পাকিস্তান ভেঙেই আমাদের জন্ম। এটা মাথায় রাখলে বলতে হয় চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কখনো সেই স্তরে পৌঁছাবে না। এ সময় সাংবাদিকসহ ভারতীয় নীতি-নির্ধারকদের নানা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হন আওয়ামী লীগের এই নীতি-নির্ধারক। তবে এসব বিষয় পাশ কাটিয়ে তিনি বারবার বিএনপিকে পাকিস্তানপন্থী, জামায়াতে ইসলামী দ্বারাই বিএনপি পরিচালিত, বিএনপি ক্ষমতায় এলে পাকিস্তান ফের বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করবে, যা ভারতের জন্যও অশান্তির কারণ হবে- এমনটা বোঝানোর চেষ্টা করেন। চীন প্রসঙ্গে দিল্লীর ওই বৈঠকে আ’লীগের এই উপদেষ্টা বলেন, ‘চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা পুরোপুরি বাণিজ্যিক। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। তারা শুধু ঢাকায় একটা রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল সরকার দেখতে চায়, যা তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের অনুকূল হবে। তা ছাড়া চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে যে ধরনের গভীর সম্পর্ক আছে, আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক তার কোনো তুলনাতেই আসবে না। চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কখনো সেই স্তরে পৌঁছাবে না।’

এর আগে গত জুনের প্রথম দিকে বিএনপির তিন নেতা দিল্লী সফর করেন। সেই সফরে তারা বিভিন্ন মহলে দুটি রাজনৈতিক বার্তা দিয়ে আসেন। তা হচ্ছে, পারস্পারিক স্বার্থে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিএনপি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দ্বিতীয় বার্তা ছিল, ভারতের উচিত তার নিজের স্বার্থে বাংলাদেশের নির্বাচনে কোনো বিশেষ দলকে সাহায্য না করা। ভারতের এটা করা উচিত গণতন্ত্রের স্বার্থে। প্রতিবেশী হিসেবে দু’দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি প্রকৃত বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্বই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দেখতে চায় বিএনপি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দীর প্রান্তে এসে দেশের জনগণকে এভাবে বিশেষ বিশেষ দেশের ‘পন্থী’ হিসেবে চিহ্নিত করা রাজনীতিতে ‘হীনমন্যতা’ আমদানি ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যে রাজনৈতিক দলটিকে ‘পাকিস্তানপন্থী’ হিসেবে উল্লেখ করে বক্তব্য দেয়া হয়েছে সেই দলের প্রধান ব্যক্তি জিয়াউর রহমান নিজে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। তাঁর গঠিত বিএনপির অতীতে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন এবং বর্তমানে নেতৃত্বে আছেন কয়েকজন সেক্টর কমান্ডারসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা। বিএনপি’র আদর্শও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। জিয়াউর রহমানের অধীনে একাধিক নির্বাচনে অংশ নিয়েছে আওয়ামী লীগসহ ‘স্বাধীনতাপন্থী’ হওয়ার দাবিদার অনেক রাজনৈতিক দল। বিএনপি চারবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছে। জিয়া পরবর্তী বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সকল নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী দলসমূহ অংশ নিয়ে এসেছে। দক্ষিণ এশিয় সহযোগিতা সংস্থা সার্ক-এর প্রতিষ্ঠাতাও জিয়াউর রহমান। যে সার্ক-এর প্রভাবশালী সদস্য ভারত। যার শরিক পাকিস্তানও। বিএনপি দেশের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত একটি রাজনৈতিক দল। এর একটি গঠনতন্ত্র রয়েছে। যাতে তাদের নীতি-আদর্শ-কর্মসূচির প্রকাশ্য ঘোষণা রয়েছে। লাখ লাখ সাধারণ মানুষ তাদের অনুসারী।

বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, অন্যদিকে বিএনপিজোটের শরিক দল জামায়াতে ইসলামীও কোন গোপন দল নয়। স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী দীর্ঘকাল ধরে দেশের রাজনৈতিক ময়দানে প্রকাশ্যে সক্রিয় রয়েছে। দেশের প্রতিটি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং জাতীয় সংসদ ও সরকারে ভূমিকা রেখে এসেছে। কেবল রাজনৈতিক মতাদর্শগত কারণে এর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো হলেও এবং একই কারণে দলীয় নিবন্ধন স্থগিত রাখা হলেও তারা প্রকাশ্যেই রাজনীতি করে যাচ্ছে। এর হাজার হাজার সমর্থক রয়েছে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে এর নেতৃত্বও দিচ্ছে এই প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।

অপরদিকে, ‘পাকিস্তান আমাদের চিরশত্রু একটা দেশ’ এবং ‘চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কখনো সেই স্তরে পৌঁছাবে না’- জনাব ইমাম এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে একধরণের ঘৃণা ও স্থায়ী শত্রুতার আবর্তে ঠেলে দিতে চেয়েছেন বলে ভাষ্যকাররা মনে করেন। ভারতের মতো একটি বৃহৎ প্রতিবেশীকে তারই অপর দুই প্রতিবেশী সম্পর্কে ‘কু-ধারণা’ প্রচার করতে যাওয়া কতোটা উচিৎ হয়েছে- সে প্রশ্নও উঠেছে। নিছক ক্ষমতার স্বার্থে নিকট প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিশেষ রাজনৈতিক দলকে নিয়ে এধরণের বিভাজনমূলক কথাবার্তা প্রকাশ্যে এবং অন্য একটি দেশের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে তার কথা বলার যৌক্তিকতা নিয়ে কথা উঠেছে। আর কেবল নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে ভারতের একচেটিয়া ও একতরফা সর্মথনলাভের প্রত্যাশী হওয়ার এই প্রবণতাকে দেশপ্রেমিক জনগণ ও রাজনৈতিক মহল অনৈতিক ও অরুচিকর হিসেবে বিবেচনা করছেন বলেও জানা গেছে।
এবিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য এবং ফাইন্যান্স বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান ড. এম. আমজাদ হোসেন বলেন, যে রাজনৈতিক দল সম্পর্কে জনাব এইচ.টি ইমাম এ ধরণের মন্তব্য করেছেন দেশের কয়েক কোটি মানুষ সেসব দলের অনুসারি। তারা বাংলাদেশেরই সাধারণ মানুষ। তাদের প্রিয় দল সম্পর্কে বিশেষ দেশের ‘পন্থী’ হওয়ার প্রচারণা কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না। এদেশের মানুষ এধরণের বক্তব্য ও মন্তব্য প্রত্যাশাও করে না। তিনি বলেন, এধরণের কথা মনগড়া এবং অসত্য। এর সঙ্গে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কোন সম্পর্ক নেই। প্রফেসর আমজাদ আরো বলেন, স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠাকারি একটি সরকারকে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত কেন সমর্থন দেবে সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

http://www.dailysangram.com/post/337351