৮ জুলাই ২০১৮, রবিবার, ৯:৩০

বামপন্থীরাও বলছেন ছাত্রলীগ এন.এস.এফ’র গুন্ডামিকেও হার মানিয়েছে

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন যে পাকিস্তান আমলে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে গুন্ডামি করেছে এনএসএফ বা জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন। ঐ দলটি মুসলিম লীগের ছাত্র ফ্রন্ট ছিল। বর্তমানে সাধারণ ছাত্রদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ যে ভয়াবহ গুন্ডামি করছে সেটি পাকিস্তান আমলের এনএসএফের গুন্ডামিকেও হার মানিয়েছে। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ছাত্রফ্রন্ট।
গত ৫ জুলাই বৃহস্পতিবার যখন এটি লেখা শুরু করেছিলাম তখন দেখলাম ছাত্রীরা ছাত্রলীগের গুন্ডামির প্রতিবাদ করার জন্য টিএসসিতে জমায়েত হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানেও ছাত্রীদেরকে জমায়েত হতে দেয়া হয়নি। ছাত্রলীগ আগে থেকেই ছাত্রী হলসমূহে অবস্থান নেয় এবং ছাত্রীদেরকে হল থেকে বের হতেই দেয়নি। এভাবে ছাত্র এবং ছাত্রীদেরকে হলের মধ্যে বন্দী করে ছাত্রলীগ নিজেরা রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করে। ছাত্রীদের সাথে হলে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন একটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। এর প্রতিবাদ করার জন্য বেগম রোকেয়া হলে রাত সাড়ে ১০টা, শামসুন্নাহার হলে রাত সাড়ে ১১টা এবং শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
রাতে বিক্ষোভকারী ছাত্রীরা জানান, নিরাপদ ক্যাম্পাস ও ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে তারা বিক্ষোভ করছেন। এদিকে হলে হলে বিক্ষোভের খবর পেয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা টিএসসি ও ভিসির বাসভবন চত্বরসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে রাতেই সতর্কাবস্থান নেয়।
কেন এই ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলো? একটু পেছনে ফিরলে দেখা যাবে যে, কোটা সম্পূর্ণ বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। চলতি বছরের ১১ এপ্রিল পার্লামেন্টের ফ্লোরে এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তারপর মে মাস পার হয়ে গেছে। জুন মাসের ২৯ তারিখও পার হয়ে গেছে। এই দুই মাস ২০ দিন পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে কোনো নির্বাহী আদেশ আসেনি। কোনো গেজেট নোটিফিকেশনও হয়নি। এমনকি একটি কমিটিও গঠিত হয়নি। বরং উল্টো কোটা আন্দোলনের নেতাদেরকে দুই মাস ধরে ছাত্রলীগ বিভিন্ন হুমকি ধামকি দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যেই নুরুল হক নুর ও রাশেদুল হকসহ কোটা আন্দোলনের ৩ নেতাকে ডিবি পুলিশ সাদা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নেয় এবং ডিবি অফিসে বেশ কিছুক্ষণ আটক রাখে। এগুলো তো কোটা সংস্কার বা কোটা বাতিলের কোনো আলামত ছিল না। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, সরকার এই ২ মাস ২০ দিন করলো কি?
সরকারের চরম নির্লিপ্ততার মাঝে ৩০ জুন শনিবার কোটা আন্দোলনের নেতারা তাদের সর্বশেষ অবস্থান বা কর্মসূচি জানানোর জন্য একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। কিন্তু ৩০ জুন সংবাদ সম্মেলন শুরু হওয়ার পূর্বক্ষণে ছাত্রলীগের মাস্তান বাহিনী ঐ এলাকা দখল করে এবং কোনো কথা না বলে আন্দোলনের নেতাদের বেধড়ক পেটাতে থাকে। সেদিনের ঘটনা এবং তার পরের ঘটনাবলী আপনারা সবই জানেন। প্রেস ক্লাবে মারধর করেই ওরা ক্ষান্ত হয়নি। ঐ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেও অন্তত দুইটি স্পটে সাধারণ ছাত্রদেরকে মারপিট করে ছাত্রলীগ। তখন আন্দোলনকারীরা শাহবাগে জমায়েত হওয়ার চেষ্টা করে। সেখানেও ছাত্রলীগ তাদেরকে ইচ্ছে মতো পেটায়। মার খাওয়া নেতারা শহীদ মিনারে জমায়েত হতে চাইলে সেখানেও তাদেরকে প্রচন্ড মার দেওয়া হয়। শহীদ মিনারে পুলিশ ছিল। শহীদ মিনার থেকে প্রায় ১০০ হাত দূরে যখন ছাত্রলীগের ঝটিকা বাহিনী আসছিল তখন তাদের দেখে পুলিশ সরে যায়। অর্থাৎ ছাত্রলীগ যেন ইচ্ছেমতো সাধারণ ছাত্রদেরকে পেটাতে পারে তার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই পুলিশ সেখান থেকে সরে যায়। তারপর দুই দিন ছাত্রলীগের এই গুন্ডামির প্রতিবাদে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা প্রতিবাদ সভা ও মানব বন্ধন করতে চাইলে সেখানেও ছাত্রলীগ তাদেরকে বেদম পেটায়। এই গুন্ডামির প্রতিবাদে ছাত্রদের অভিভাবকরা প্রেস ক্লাবে জমায়েত হলে সেখানেও তাদের ওপর পুলিশি হামলা হয় এবং দুই জন বিশিষ্ট নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়।
॥দুই॥
সর্ব শ্রেণির ছাত্র এবং জনগণের সমর্থন পুষ্ট কোটা সংস্কার আন্দোলনের কন্ঠ রোধ করার জন্য ছাত্রলীগ কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ, প্রগতিশীল ছাত্রজোট, ছাত্র ইউনিয়ন, বাসদ ও কমিউনিস্ট পন্থী ছাত্র ও গণ সংগঠনের মানববন্ধন ও সমাবেশ গায়ের জোরে পুলিশের সাথে মিলে পণ্ড করে দিয়েছে এবং অন্তত ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের অমানুষিক প্রহারে কোটা আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা নূরুল হক নূরের শরীরের মাংস পেশীর ৪০ ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে ইনফেকশনও দেখা দিয়েছে। প্রতি দুই ঘন্টা পর পর নূরুল হকের জ্বর আসছে। ছাত্রলীগের পাশবিক প্রহারে কোটা আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা তরিকুল ইসলামের ডান পা পুরোপুরি ভেঙে গেছে। ছাত্রলীগের ঝটিকা বাহিনী লোহার হাতুড়ি দিয়ে তার পায়ের হাড্ডিতে মেরেছে। এখন অপারেশন না করলে তার পা ভাল হবে না। আর অপারেশন করলেও কতখানি ভাল হবে তাতে সন্দেহ রয়েছে।
কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ? দেশটা কি মগের মুল্লুকে পরিণত হলো? মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের স্বপ্ন ছিল এমন একটি দেশ আমরা পাবো যেখানে আমরা বুক ভরে নিতে পারবো মুক্ত বাতাস, দেশের এবং নিজেদের উন্নতির জন্য কথা বলতে পারবো প্রাণ খুলে। যেখানে থাকবে বাক, ব্যক্তি ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। যেখানে আমরা ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের মতো বলতো পারবো, ‘‘I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it.” “I may not agree with you, but I will defend to the death your right to make an ass of yourself.” বাংলা অনুবাদ, তুমি যা বলবে আমি সেটা অনুমোদন নাও করতে পারি। কিন্তু তোমার সেটি বলার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত আমি লড়াই করে যাবো। আরেক জায়গায় তিনি বলেছেন,“তুমি যা বলো তার সাথে আমি একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার সেই কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমি মৃত্যু পর্যন্ত লড়ে যাবো।
অথচ, আমাদের সেই স্বপ্নের বাংলাদেশে আজ আমরা কি দেখছি? আমার সাথে তুমি যদি ভিন্ন মত পোষণ করো তাহলে আমি তোমাকে কথা বলতে দেবো না। তুমি যাতে কথা বলতে না পারো তার জন্য আমি তোমার কন্ঠরোধ করবো। এটি আব্রাহাম লিঙ্কনের গণতন্ত্র নয়। এটি ইটালির ডিক্টেটর মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ। এটি জার্মানির স্বৈরশাসক হিটলারের নাৎসিবাদ।
২০০২ সালে কোটা সংস্কারের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ১৬ বছর পর ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল সেই আন্দোলনের সাময়িক অবসান হয়। কারণ ১১ এপ্রিল স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্লামেন্টে বলেন যে, খোদ কোটা পদ্ধতিই বাতিল করা হলো। এসম্পর্কে পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দেন সেটি নিম্নরূপ। আমরা তার বক্তব্যের সংশ্লিষ্ট অংশ নিচে হুবহু তুলে দিচ্ছি, “বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা বন্ধ, ভিসির বাড়িতে আক্রমণ, রাস্তা বন্ধ, বারবার এই আন্দোলন, সুতরাং এই কোটাই এখন বাতিল।” এর আগে অবশ্য পানি অনেক ঘোলা করার চেষ্টা করা হয়। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী নিজেই পার্লামেন্টে চোখ ঠিকরে বের করে গলা সপ্তমার্গে চড়িয়ে অশ্লীল ভাবে বলেছেন, “আসল গাত্রদাহ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, যারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছে তাদের ছেলে মেয়েরা সুযোগ পাবেনা, এই রাজাকারের বাচ্চারা সুযোগ পাবে, তাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংকুচিত করতে হবে।” বিগত দুই তিন দিনের টক শোতে দেখছি যে, আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অসত্য বলতে এতটুকু আড়ষ্টতা হয়না। তারা অনর্গল মিথ্যা বলতে পারেন। তাই গত বুধবার রাতে অন্তত চারজন আওয়ামী বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ এই মর্মে মিথ্যা কথা বললেন যে, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী নাকি ঢালাওভাবে আন্দোলন পন্থীদের রাজাকারের বাচ্চা বলেন নি। তাই পার্লামেন্টে তিনি যা বলেছেন, ভিডিও ফুটেজে তার স্বকন্ঠে যা ধারণ করা আছে সেটি থেকে অংশ বিশেষ ওপরে উদ্ধৃত করলাম। আসলে এরা এভাবেই উস্কানি দিয়েছেন এবং পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে পুলিশ এবং ছাত্রলীগকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছেন।
॥তিন॥
প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে যে ঘোষণা দিয়েছেন তার পরে তো আর কোনো কথা থাকে না। কথায় বলে, চPrime Minister’s word is law অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর কথাই হলো আইন। বাংলাদেশে এই কথাটি শতকরা ১০০ ভাগ সত্য। কারণ এদেশে প্রাইম মিনিস্টারের কথা ছাড়া জুতা সেলাই থেকে চ-ী পাঠ- কিছুই হয় না। আর তাছাড়া পার্লামেন্টের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি যে ঘোষণা দিয়েছেন সেটি তো সরকারের সিদ্ধান্ত। এখানে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অত্যন্ত পরিষ্কার। কোনো রকম কোটাই তিনি রাখেন নি। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা, অর্থাৎ কোটা বাতিল হলো, এমন একটি সরকারি নির্দেশ বা গেজেট বা প্রজ্ঞাপন জারি করতে ৪৮ ঘন্টার ওপর লাগার কথা নয়।
কিন্তু এখন কি প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে? এর মধ্যে ক্যাবিনেট সেক্রেটারির নেতৃত্বে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এই কমিটি কোটা ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করবে, সংস্কার করবে অথবা বাতিল করবে। এই কথাটি বলেছেন জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জন সংযোগ অফিসার মোমিনুল হক। ক্যাবিনেট সচিবের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিবেচনাধীন রয়েছে। সেই বিবেচনার ফলাফল এখনও আমাদের পর্যায়ে নেমে আসেনি। ক্যাবিনেট সচিব শফিউল আলম বলেন, বিষয়টিতে কিছু জটিলতা রয়েছে। এই জটিলতা নিরসন করতে কিছুটা সময় লাগবে।
তিনি আরো বলেন, আপনারা বিষয়টি খুব সহজ ভাবে বিশ্লেষণ করছেন। কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নয়। খুটিনাটি বিশ্লেষণের পরেই একটি সিদ্ধান্ত আসবে। সেই আলোকে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে বলেছিলেন যে, কোটা সিস্টেম বাতিল করা হলো। তিনি ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, আজ এই দাবি, কাল এই আন্দোলন। এই সিস্টেম যদি না থাকে, তাহলে কোনো দাবি বা আন্দোলন থাকবে না। সুতরাং পুরা কোটা সিস্টেমই বাতিল করা হলো। কিন্তু কমিটি গঠন করার পরে ক্যাবিনেট সচিব বলছেন যে, এর মধ্যে অনেক জটিলতা আছে । তাই এই সিস্টেম পুনর্বিবেচনা, সংস্কার বা বাতিলের বিষয়ে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাহলে প্রধানমন্ত্রী যে কোটা সিস্টেম বাতিল করে দিয়েছিলেন, সেই সিদ্ধান্ত বা ঘোষণা কি আর থাকলো না? এখন কি তাহলে বিষয়টি নতুন করে পুনর্বিবেচনা এবং সংস্কার করা হচ্ছে? তাহলে কি আমরা ফিরে যাচ্ছি সেই প্রবাদ প্রবচনের ভাষায় Back to square one?
Email: asifarsalan15@gmail.com

 

http://www.dailysangram.com/post/337014-