৭ জুলাই ২০১৮, শনিবার, ১০:৪৬

৮ বছরে পিডিবি’র গচ্চা ৫৭ হাজার কোটি টাকা

কুইক রেন্টাল থেকে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কেনার দায় জনগণের ঘাড়ে চাপাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ফলে বার বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট থেকে টাকা আদায় করছে সংস্থাটি। বেশী দামে বিদ্যুৎ কেনার ফলে প্রতিবছরই পিডিবি তাদের বার্ষিক রিপোর্টে লোকসান দেখাচ্ছে। সদ্য সমাপÍ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ লোকসান দেখায় তারা। প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসান দেখানোর পেছনে আবারো বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা বলে মনে করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পিডিবি মূলত জনগণের টাকা গচ্ছা দিচ্ছে। লোকসানের নামে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেনার দায় জনগণের ঘাড়ে ছাপাচ্ছে। কম দামে বিদ্যুৎ কেনার সুযোগ থাকার পরও অতি পরিচিত কুইক রেন্টাল থেকে বেশী দামে বিদ্যুৎ কিনছে।
সূত্র জানায়, রেন্টাল বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে অর্থনেতিক ক্ষত বেড়েই চলছে। এসব কেন্দ্র থেকে বেশী দামে বিদ্যুৎ কেনার কারণে গত ৮ বছরে ৫৭ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এর মধ্যে সদ্য সমাপ্ত (২০১৭-১৮) অর্থবছরে লোকসান দেখানো হয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। অব্যাহত লোকসানের মুখে এসব রেন্টাল, কুইক রেন্টালের মেয়াদ বেড়েই চলছে। বুধবার সংসদে আরো ৩ বছর মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২১ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন রেন্টাল, কুইক রেন্টাল থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এ বোঝা আরো বাড়বে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এমপি দাবি করেছেন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন এমনভাবে বেড়েছে আগামী দিনে কার কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হবে তা নিয়ে ভাবনায় পড়েছে সরকার। তবে প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্য ফিকে হয়ে আসছে কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষত বেড়ে যাওয়ায়।
পরিসংখ্যান বলছে, সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে বেসরকারী উদ্যোগে। দরপত্র ছাড়া বেসরকারী খাত থেকে বিদ্যুৎ কিনে কোটি কোটি টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে। সর্বশেষ হিসেব মতো বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনায় গত ৮ বছরে লোকসান গুণছে হাজার কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসতে শুরু করে। বেসরকারি খাতের এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনায় ওই অর্থবছরই লোকসানে পড়ে পিডিবি। ওই সময় পিডিবির লোকসান হয় ৬২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। পরবর্তীতে লোকসানের পরিমাণ আরো বাড়তে থাকে। ২০১১-১২ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান বেড়ে দাড়ায় ৮১ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। তবে পরের অর্থবছরে লোকসান কিছুটা কমাতে সক্ষম হয় পিডিবি। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসান হয় ৬৪ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আবারো লোকসান বেড়ে হয় ৮৭ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৯৩ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। টাকার হিসেবে দাড়ায় প্রায় ৩৯হাজার কোটি টাকা এছাড়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ৩ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৪ হাজার৬৮৫ কোটি টাকা এবাং সদ্য সমাপ্ত অর্থবছর (২০১৭-২০১৮) লোকসান ৮ হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, ২০১০ সালে ১৩টি কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট অনুমোদন দেয়া হয়। এদের কাছ থেকে বিনা টেন্ডারে গড়ে ১২ টাকা থেকে ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা দামে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কেনার সিদ্ধান্ত হয়। আবার কোন কোন কেন্দ্র থেকে ২০ টাকা থেকে ২৪ টাকা পর্যন্ত দামে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ক্রয় করা হয়েছে। প্রথম দিকে কম নেয়া হলেও ২০১২ সালের শেষ দিকে থেকে চলতি বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত হিসাবে দেখা গেছে, এই দামে কেন্দ্রগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ৮শ’ থেকে ১৩শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নেয়া হয়।
জ¦ালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলভিত্তিক নতুন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ক্ষতি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে । সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরেই উৎপাদন পর্যায়ে ক্ষতির পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছে বিপিডিবি। আগের অর্থবছর এ ক্ষতি ছিল ৪ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে অতিরিক্ত ৭০ পয়সা অনুদান হিসেবে চায় পিডিবি।
উৎপাদন ব্যয় ও পাইকারি পর্যায়ে গড় বিক্রয়মূল্যজনিত আর্থিক ক্ষতি এবং সরকার কর্তৃক প্রদত্ত আর্থিক সহায়তার একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে পিডিবি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য তৈরি ওই সারসংক্ষেপে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ক্ষতি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে পাঁচটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছে ।
এমনিতেই রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্র থেকে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কিনছে বিপিডিবি। নতুন করে আরো রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ স্থাপন হচ্ছে । সেগুলোর সঙ্গেও উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করছে বিপিডিবি। এর মধ্যে ঢাকার কেরানীগঞ্জে হাই স্পিড ডিজেলভিত্তিক (এইচএসডি) ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ অনুমোদন পেয়েছে এপিআর এনার্জি। কেন্দ্রটি উৎপাদিন বিদ্যুতের মূল্য হবে প্রতি ইউনিট ১৯ টাকা ৯৯ পয়সা।
কেরানীগঞ্জে এইচএসডিভিত্তিক মোট ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ স্থাপন করবে অ্যাগ্রেকা ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস। এ কেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৯ টাকা ৬৭ পয়সায় কিনবে বিপিডিবি। উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করতে হবে ডলারে।
পিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ দাবি করেন, ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত বেশকিছু নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র যুক্ত হয়েছে, যেগুলো তেলভিত্তিক। এছাড়া ডলারের অবমূল্যায়ন ও এইচএফওর মূল্যবৃদ্ধির কারণেও ব্যয় বেড়েছে। পাশাপাশি গ্যাসের স্বল্পতা তেলের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে বিপিডিবির ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। ঘাটতির অর্থ সমন্বয় করা প্রয়োজন। এজন্য পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সংস্থাটির ঘাটতি বা ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি এ অর্থের বিপরীতে ২০১৭ সালের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ক্রয়কৃত বিদ্যুতের ক্রয়-বিক্রয়মূল্যের পার্থক্য বাবৎ সরকার ঋণ হিসেবে দিয়েছে ১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর উৎপাদন পর্যায়ে ৪ হাজার ২৪২ কোটি টাকা ক্ষতির বিপরীতে বিপিডিবি সরকারের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে পেয়েছে ৩ হাজার ৯৯৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. তাজুল ইসলাম বলেন, তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ তুলনামূলক বেশি। এ খাতে ভর্তুকি দেয়া না হলে ভোক্তাদের অনেক বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর।
তিনি বলেন, বেসরকারি খাতের কেন্দ্র গুলো সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে। মুনাফা রেখেই এ বিদ্যুৎ বিক্রি করছে তারা। অন্যদিকে সরকার ভর্তুকি দিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিয়েছে।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বলেন, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে অধিক দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে গ্রাহকের কাছে বিক্রির কারণে এ লোকসান। তবে কুইক রেন্টাল থেকে পিডিবি যদি কম দামে বিদ্যুৎ নিত, সেক্ষেত্রে লোকসানের পরিমাণটা অনেক কমে যেত। কিন্ত পিডিবি সেটি করতে পারেনি। যে কারণে বছরের পর বছর লোকসানও বাড়ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম. তামিম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, এটি সত্য। কারণ আগে আমাদের প্রায় ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। কিন্তু সেটি কমে এখন ৬২ শতাংশে নেমে এসেছে। যেখানে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সংখ্যা বাড়ছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বুধবার সংসদের বলেছেন, ‘বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে ক্যাপটিভসহ ১৮ হাজার ৩৫৩ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে।’ তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। সরকার বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন ও ‘সবার জন্য বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করতে তাৎক্ষণিক, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে।’ তিনি বলেন, ‘এ পরিকল্পনার আওতায় উৎপাদন ক্ষমতা ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার কার্যক্রম চলছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের স্থাপিত ক্ষমতার চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ১৮ হাজার ৩৫৩ মেগাওয়াটে (ক্যাপটিভসহ) উন্নীত হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে ভারত থেকে ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে মোট ২ হাজার ৩৩৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ আমদানির লক্ষ্যে কার্যক্রম চলছে। এ বছরই ভারত থেকে আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হবে বলে আশা করা যায়।’

http://www.dailysangram.com/post/336831-