৫ জুলাই ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:০৩

সংশয় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে

আশিকুল হামিদ

শেষ পর্যন্ত যা কিছুই ঘটুক না কেন, ক্ষমতাসীন দল এবং তার জোটের সঙ্গীদের সুচিন্তিত উদ্যোগে দেশে ভোটের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ক’দিন আগে, গত ২৬ জুন অনুষ্ঠিত হয়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। আগামী ৩০ জুলাই রাজশাহী, সিলেট ও খুলনা- এই তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওদিকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরেই একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন বা ইসি নয়, প্রধানমন্ত্রীর পর সরকারের সবচেয়ে প্রভাবশালী মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়ে দিয়েছেন, সংসদ নির্বাচনের তফসিল নাকি অক্টোবর মাসে ঘোষণা করা হবে। এ ধরনের বিভিন্ন কারণে একদিকে ভোটের হাওয়ার পাশাপাশি সংসদ নির্বাচন নিয়ে যেমন ব্যাপক আলোচনা ও জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি প্রাধান্যে এসেছে নির্বাচন কমিশনও।
এটাই স্বাভাবিক। কারণ, নির্বাচন সংক্রান্ত সকল বিষয়ে মানুষ নির্বাচন কমিশনের দিকেই লক্ষ্য রাখে। বর্তমানেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। কমিশন অবশ্য জনগণকে আশান্বিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। কেনÑ সে সম্পর্কে বলার আগে জানানো দরকার, বেশি আশা করার যুক্তিসঙ্গত কারণ না থাকলেও জনগণের সচেতন অংশের ধারণা ছিল, কয়েক বছর ধরে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন সম্ভবত সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কিছুটা হলেও ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবে। অন্তত নির্বাচনের প্রশ্নে জনমনে যে অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করার জন্য লোক দেখানোর মতো হলেও তৎপরতা দেখাবে। অন্যদিকে বাস্তব অবস্থা কিন্তু সেই যাহা ৫২ তাহা ৫৩-ই রয়ে গেছে। এ সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য গাজীপুরের সর্বশেষ নির্বাচনের উল্লেখ করাই যথেষ্ট। সকল গণমাধ্যমের রিপোর্টেই জানানো হয়েছে, প্রিসাইডিং অফিসার ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আইন-শৃংখলা বাহিনীর সামনেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা ব্যাপক সংখ্যায় জাল ভোট দিয়েছে। তারও আগে বিএনপির পোলিং এজেন্ট ও নেতা-কর্মীদের বের করে দিয়ে অঘোষিতভাবে ভোটকেন্দ্র দখল করে নিয়েছিল তারা। অবস্থা এমন পর্যায়ে পেঁৗঁছেছিল যে, কোনো ভোটকেন্দ্রেই বিএনপির কোনো পোলিং এজেন্টকে থাকতে দেয়া হয়নি।
চমৎকার সে অবস্থার সুযোগ নিয়ে গণহারে জাল ভোট দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়েছে এমনকি ১২/১৩ বছরের কিশোররাও। কিন্তু এসব অনিয়ম ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্যও বিএনপির কোনো নেতা-কর্মীকে পাওয়া যায়নি। বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার জেলা রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ জানিয়ে ভোটগ্রহণ স্থগিত করার অনুরোধ করেছেন। অন্যদিকে জেলা রিটার্নিং অফিসার সাংবাদিকদের শুনিয়েছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, সব ভোটকেন্দ্রেই ভোটাররা নাকি শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পেরেছেন! কোথাও কোনো সংঘাত বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি! সাংবাদিকদের উপর্যুপুরি জিজ্ঞাসার মুখে জেলা রিটার্নিং অফিসার অবশ্য স্বীকার করেছেন, ৪২৫টির মধ্যে মাত্র নয়টি কেন্দ্রে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া গিয়েছিল। তিনি ওই কেন্দ্রগুলোর ভোটগ্রহণ স্থগিত করেছেন। অন্য আরো কয়েকটি কেন্দ্রে বিচ্ছিন্ন কিছু সংঘাতের ঘটনা ঘটলেও আইন-শৃংখলা বাহিনীকে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে এবং ভোটাররা তাদের ইচ্ছামতো প্রার্থীদের ভোটও দিতে পেরেছেন।
অন্যদিকে দেশের কোনো গণমাধ্যমের রিপোর্টেই কিন্তু প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের বক্তব্য সমর্থন পায়নি। প্রায় সব গণমাধ্যমের রিপোর্টে বরং গাজীপুরের নির্বাচনকে ‘নীরবে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কোনো দৈনিক শিরোনাম করেছে, ‘সুষ্ঠু ভোট’, তবে কোনো প্রতিপক্ষ ছিল না। শিরোনাম হয়েছে ‘নিয়ম-অনিয়মের নির্বাচন’ও। আবার প্রধান একটি জাতীয় দৈনিক ‘বাইরে সুনসান, ভেতরে গড়বড়’ শিরোনামে পৃথক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এসব রিপোর্টে জালভোট ও নীরব সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অনিয়মের খবর জানানো হয়েছে।
সব খবরেই জানা গেছে, নির্বাচনের অনেকদিন আগে থেকেই বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধাওয়ার মুখে রেখেছিল পুলিশ। পুলিশের মামলা দায়ের ও গ্রেফতার করার অভিযানে বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে ঢোকানো হয়েছে। যারা কোনোভাবে গ্রেফতার এড়াতে পেরেছেন তাদের পক্ষেও প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো সম্ভব হয়নি। তারা এমনকি নিজেদের বাড়িতেও থাকতে পারেননি। পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হয়েছেন। একই কারণে নির্বাচনের দিনও তারা কোনো ভোটকেন্দ্রের ধারেকাছে যেতে পারেননি। প্রতিটি কেন্দ্রেই আওয়ামী লীগের গুন্ডা-সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পাহারা দিয়েছে আইন-শৃংখলা বাহিনীর লোকজন। এজন্যই কোথাও প্রকাশ্যে কোনো সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। আর কথিত শান্তিপূর্ণ সে অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মারার মহোৎসব করেছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘নীরবে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’!
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে কথাও উঠেছে এসব কারণেই। বলা হচ্ছে, পুলিশ ও আইন-শৃংখলা বাহিনীকে ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও তার নেতা-কর্মীদের মিথ্যা মামলায় কারাগারে এবং ধাওয়ার মুখে রেখে গাজীপুরে ‘নীরবে নিয়ন্ত্রিত’ যে নির্বাচনের মহড়া করা হয়েছে সে নীতি-কৌশলকেই যদি জাতীয় নির্বাচনেও ভিত্তি করার পরিকল্পনা ক্ষমতাসীনদের থেকে থাকে তাহলে নির্বাচন শুধু নয়, দেশ থেকে গণতন্ত্রও চিরদিনের জন্য বিতাড়িত হবে। এমন আশংকার পরিপ্রেক্ষিতেই দেশের বিশিষ্টজনেরা অভিযোগ করেছেন, নির্বাচন কমিশন স্বেচ্ছাচারী সরকারের ‘তোতা পাখির’ ভূমিকা পালন করছে। কমিশনের অভিসন্ধি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সে কারণে। গত ২৮ জুন রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বিশিষ্টজনেরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন হয়তো সরকারের মতোই এমন গণতন্ত্র চাচ্ছে, যেখানে অওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দলই থাকতে পারবে না। বাংলাদেশ হয়ে পড়বে দলহীন গণতন্ত্রের দেশ।
প্রসঙ্গক্রমে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করা। অন্যদিকে বাস্তব ক্ষেত্রে কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ সেবাদাসের ভূমিকা পালন করে চলেছে। কোনো কোনো বিশিষ্টজন কমিশনের বিরুদ্ধে সরকারের ‘তোতা পাখির’ ভূমিকা পালন করার অভিযোগও তুলেছেন। এর পেছনেও প্রধান ভূমিকা রেখেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। গত বছরের জুলাই মাসে সিইসি কে এম নূরুল হুদা রোডম্যাপের নামে যে কর্মপরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন, তা রাজনৈতিক দলগুলোকে তো বটেই, সাধারণ মানুষকেও আশান্বিত করার পরিবর্তে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন ও শংকিত করে তুলেছিল। একমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো দলই এই রোডম্যাপকে স্বাগত জানায়নি। দেশের প্রধান দলগুলোর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বরং ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে বলেছিল, সিইসি এমনভাবেই তার রোডম্যাপ তৈরি ও ঘোষণা করেছেন, যাতে আওয়ামী লীগই আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এই রোডম্যাপ অনুযায়ী একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আরো একটি ৫ জানুয়ারির উদাহরণ সৃষ্টি হবে বলেও মতপ্রকাশ করেছিলেন অনেকে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ পর্যবেক্ষকরা প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে আয়োজিত দশম সংসদ নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলই অংশ নেয়নি। যার ফলে আওয়ামী লীগের ১৫৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী প্রমুখকেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়নি। তাদের বাইরে যে আসনগুলোতে নামকা ওয়াস্তে নির্বাচন হয়েছিল সেসব আসনেও পাঁচ শতাংশের বেশি ভোটার ভোট দেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে নির্বাচনকেই তখনকার নির্বাচন কমিশন বৈধতা দিয়েছিল। বিশ্বের দেশে দেশে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হলেও ওই নির্বাচনের ভিত্তিতেই আবারও ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ আর প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেছিলেন শেখ হাসিনা।
নিকট অতীতের এমন অভিজ্ঞতার কারণেই নতুন সিইসি কে এম নূরুল হুদার দিকে অনেক আশায় তাকিয়ে থেকেছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। অন্যদিকে সিইসি নূরুল হুদা শুধু নিরাশ করেননি, ক্ষুব্ধও করে তুলেছেন। তার ঘোষিত রোডম্যাপ কেন নিন্দিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং নতুন তথা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কেন আওয়ামী লীগের সেবাদাসের ভূমিকা পালন করার অভিযোগ উঠেছে তার কারণ জানতে হলে এই রোডম্যাপের মূলকথাগুলো স্মরণ করা দরকার। যেমন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রধান পূর্বশর্তই হলো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা, যাতে সকল দল সে নির্বাচনে বাধাহীনভাবে অংশ নিতে পারে। অন্যদিকে সিইসি তার বক্তব্যে এসব বিষয়ে কিছুই বলেননি। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো যে মিছিল-সমাবেশ দূরে থাকুক, ঘরোয়া বৈঠক পর্যন্ত করতে পারছে না এবং সরকারের পুলিশ যে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা দেয়ার পাশাপাশি গ্রেফতারের জন্য তাদের ধাওয়া করে বেড়াচ্ছেÑ এসব বিষয়েও মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছিলেন সিইসি। শত শত রাজনৈতিক মামলার শিকার এবং গ্রেফতারের আতংকে পালিয়ে থাকা নেতা-কর্মী এবং তাদের দলের পক্ষে নির্বিঘেœ নির্বাচনী কর্মকান্ডে অংশ নেয়া সম্ভব কি না, আর সেটা সম্ভব না হলে কোনো নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হতে পারবে কি না সে ব্যাপারেও কিছু বলেননি সিইসি নূরুল হুদা।
তখন অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছিল সহায়ক সরকারের বিষয়টি। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের পক্ষে বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনের আগে একটি সহায়ক সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন। তিনি সেই সাথে জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারবে না। একই কারণে একমাত্র সহায়ক সরকার ছাড়া অন্য কোনো সরকারের অধীনে হলে বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোটের কোনো দল সে নির্বাচনে অংশ নেবে না। তেমন অবস্থায় অনুষ্ঠিত নির্বাচন যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিরই পুনরাবৃত্তি ঘটাবেÑ এই সহজ কথাটা না বোঝার কারণ ছিল না সিইসি নূরুল হুদার। অন্যদিকে তিনি শুধু সহায়ক সরকারের প্রসঙ্গই পাশ কাটিয়ে যাননি, একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের সুরে ও ভাষায় সিদ্ধান্তের আকারে জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব এবং তার নেতৃত্বাধীন কমিশন সেটাই করে দেখাবে!
খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, অতি সম্প্রতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, পরবর্তী তথা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। তবে সে সরকার হবে ‘নির্বাচনকালীন সরকার’। সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পরপরই এই সরকার গঠন করা হবে আগামী অক্টোবর মাসে। পরিকল্পিত নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ওই সরকার আকারে ছোট হবে অর্থাৎ কম সংখ্যক মন্ত্রী থাকবেন। আর সম্পূর্ণ বিষয়টিই থাকবে প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারে।
সিইসি নূরুল হুদার সুরে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচনের আগে নির্দলীয়, সহায়ক, তত্ত্বাবধায়ক বা অস্থায়ী ধরনের কোনো সরকার গঠনের প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, সংবিধানে তেমন কোনো ব্যবস্থার সুযোগ নেই। সুতরাং নির্বাচন হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত ছোট আকারের নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে। সব দলের জন্যই সে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে। কোনো দল যদি অংশ না নেয় তবে সেটা হবে সংশ্লিষ্ট দলটির সিদ্ধান্তের ব্যাপার। কিন্তু কোনো বিশেষ দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসার জন্য সংবিধানের বাইরে গিয়ে বা সংবিধান লংঘন করে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সিইসি নূরুল হুদা এক বছর আগে যা বলেছিলেন সে কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করেছেন ওবায়দুল কাদের। এরই পাশাপাশি গাজীপুরের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিশিষ্টজনেরা সামগ্রিক কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতেও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব, ভূমিকা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। উদাহরণ হিসেবে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন সংক্রান্ত আইনের উল্লেখ করে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, কিছুদিন পরপর নতুন নতুন শর্ত চাপিয়ে কঠিন আইন তৈরি করা কমিশনের কাজ হতে পারে না। যেমন প্রথম থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত নির্দিষ্টসংখ্যক সদস্য ও সমর্থকের নাম দেয়ার যে আইনটি ছিল সাম্প্রতিক সময়ে কমিশন সেখানে সমর্থক হিসেবে এক শতাংশ ভোটারের নাম দেয়ার বিধান করেছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি জেলায় দলের শাখা থাকতে হবে বলেও নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। অথচ গণতন্ত্রে এ ধরনের আইন কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। বিশিষ্টজনেরা তাই না বলে পারেননি যে, রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের আইন যে কারণে তৈরি করা হয়েছিল বর্তমানে তার সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে আইনটিকে নতুন রাজনৈতিক চিন্তা ও দল নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভবিষ্যতে, বিশেষ করে সংসদ নির্বাচনের সময়ও যে নির্বাচন কমিশনের নীতি ও কার্যক্রমে কোনো পরিবর্তন ঘটবে না, সে বিষয়ে এতদিনে সাধারণ মানুষও নিশ্চিত হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ এই কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। গত বছর ঘোষিত রোডম্যাপসহ কোনো উপলক্ষে সিইসি একদিকে আশান্বিত হওয়ার মতো তেমন কিছু বলেননি অন্যদিকে সর্বশেষ গাজীপুরের নির্বাচনের মাধ্যমেও বুঝিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করার কোনো সুযোগ নেই। বাস্তবে বরং এমন আশংকাই শক্তিশালী হয়েছে যে, কে এম নূরুল হুদার কমিশনও আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনার লক্ষ্যে তৎপরতা শুরু করেছে। এই আশংকা সত্য হলে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যাবে এবং একযোগে রাজনৈতিক সংকটও আরো জটিল ও মারাত্মক হয়ে পড়বে।
এমন আশংকার পরিপ্রেক্ষিতেই গণতন্ত্রকামী দেশপ্রেমিক পর্যবেক্ষকরা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ জনগণের সচেতন অংশের সঙ্গে মতবিনিময় করার এবং সকলের পরামর্শের ভিত্তিতে এমন একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের জন্য সিইসির প্রতি আহবান জানিয়েছেন, যাতে পরিকল্পিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে সকল দলের পক্ষে নির্ভয়ে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়া সম্ভব হয়। যাতে সকল দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়। জনগণ চায় না, যুগ যুগ ধরে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে আসা বাংলাদেশে আরো একটি ৫ জানুয়ারির নজীর তৈরি হোক এবং গণতন্ত্রকে আবারও নির্বাসনে পাঠানো হোক।

http://www.dailysangram.com/post/336649-