৪ জুলাই ২০১৮, বুধবার, ১১:০৪

বেশি ফলিয়ে উল্টো ফল!

স্বাদ, গন্ধ আর পুষ্টিগুণের কারণে ব্যাপক জনপ্রিয় হওয়ায় দেশে আম চাষে আগ্রহ বাড়ছে মানুষের। নিয়মিত বাগানের পাশাপাশি অনেকে বাড়ির আঙিনায় ছোট আকারের বাগান গড়ে বাণিজ্যিকভাবে আম উত্পাদন করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমের বেশ কিছু নতুন জাতও উদ্ভাবন করেছে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। এতে গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আম উত্পাদন হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার বাম্পার ফলন হয়েছে আমের। কিন্তু বেশি ফলিয়ে এখন বিপাকে পড়েছে আম চাষিরা। অনেক চাষি উত্পাদন খরচের অর্ধেকেরও কম মূল্যে আম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।

সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতি ও পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগারের অভাব, বিপণনব্যবস্থার দুর্বলতা এবং রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য তৈরির উদ্যোগ না থাকাই এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন গবেষকরা।
সংগ্রহ পদ্ধতির ত্রুটির কারণে প্রতি মৌসুমে অনেক আম নষ্ট হয়ে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষিরা। প্রচার ও উদ্যোগের অভাবে কাঁঠাল খাওয়াও কমিয়ে দিয়েছে মানুষ। এই ফল থেকে প্রক্রিয়াজাত খাবার তৈরি করে সারা বছর ভোক্তার চাহিদা মেটানোর সুযোগ থাকলেও এর উদ্যোগ নেই। অন্যান্য দেশি ফলও মৌসুমের বাইরে পাওয়ার সুযোগ নেই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিভিন্ন ধরনের ফল উত্পাদন হয়েছিল এক কোটি ছয় লাখ মেট্রিক টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উত্পাদন বেড়ে হয়েছে এক কোটি ১০ লাখ টনের বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হয়েছে প্রায় এক কোটি ২১ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু আম উত্পাদন হয়েছে ২১ লাখ ৪৩ হাজার টনের বেশি। এ ছাড়া ১৭ লাখ সাড়ে ৫১ হাজার টন কাঁঠাল, ৫৮ হাজার টন জাম এবং প্রায় এক লাখ ৮৫ হাজার টন লিচু উত্পাদন হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমের উত্পাদন অনেক বেশি বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
অধিদপ্তরের একটি সূত্র মতে, সারা বছর দেশে যে পরিমাণ ফল উত্পাদন হয় তার শতকরা ৪০ ভাগই নষ্ট হয়ে যায় সংগ্রহ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণের ত্রুটিতে। অনেকের দাবি, চাহিদা অনুযায়ী দেশে ফলের উত্পাদন যথেষ্ট। কিন্তু হিসাব করে দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলোতে গড়ে প্রতিদিন একজন ২০০ গ্রাম করে বিভিন্ন ফল খায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যে পরিমাণ ফল উত্পাদন হয়েছে তা চাহিদার কাছাকাছি। তবে ৪০ শতাংশ বাদ দেওয়া হলে তা যথেষ্ট নয়। তাই উত্পাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কিভাবে উত্পাদিত ফল নষ্ট হওয়া ঠেকানো যায় সেটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের ফল উত্পাদন ও সংরক্ষণব্যবস্থা নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুধু আমের তথ্য তুলে ধরেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, আম পাড়ার আগে এবং পাড়ার পর থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত মোট ৫৪.৫ শতাংশ নষ্ট বা অপচয় হয়। কৃষক পর্যায়ে ১৬.৬ শতাংশ, সেখান থেকে পাইকারি পর্যায়ে আসতে ১.৯ শতাংশ, সেখান থেকে ভোক্তা বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেতার কাছে পৌঁছা পর্যন্ত আরো ৩৬ শতাংশ অপচয় হচ্ছে। তবে সঠিকভাবে গাছ থেকে আম সংগ্রহ, প্যাকিং, উন্নতমানের ঝুড়ি ব্যবহার, সংরক্ষণ পদ্ধতি ও পরিবহনে সচেতন থাকলে অপচয় ১৮.৪ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব। জানা গেছে, পাকিস্তানে আমের ক্ষেত্রে অপচয়ের হার ১০ শতাংশের নিচে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের উপপরিচালক (ফল ও ফুল) এ কে এম মনিরুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফল দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষণে আমাদের এখনো কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে আমরা আমের ক্ষেত্রে এমন কিছু জাত উদ্ভাবন করতে পেরেছি যেগুলো থেকে প্রায় ১১ মাসই আম পাওয়া সম্ভব। বারি আম-১১ নামের জাতটি ১১ মাসই ফল দেয়। এ ছাড়া ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ফলনের জন্য গৌরমতি, অ্যারেমেনিস, তোতাপুরির মতো জাতগুলোর উদ্ভাবন হয়েছে।’
প্রক্রিয়াজাত খাদ্য তৈরিতে আগ্রহ কম, গতি নেই রপ্তানিতে : সারা বছরই দেশে বিভিন্ন রকমের ফল পাওয়া যায়। কিন্তু আম, কাঁঠালের মতো সুস্বাদু ফল পাওয়া যায় শুধু কয়েক মাস। আম থেকে তৈরি জুস দেশের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করছে। যদিও এগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান ভালো মানের জুস তৈরি করে দেশের বাইরে রপ্তানি করছে। বড় দু-একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যরা তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে চায় না।
তবে প্রক্রিয়াজাতের একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। রাঙামাটির নানিয়ার চরে হর্টিকালচার সেন্টারের তত্ত্ববধানে প্রকল্পটির কাজ চলছে। দেড় কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে স্থাপনা নির্মাণ ও মেশিনপত্র আনার কাজ চলছে। যদিও পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে রাঙামাটি ও রাজশাহী অঞ্চলে দুটি প্রকল্প নিতে চেয়েছিল অধিদপ্তর।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ওই প্রকল্পের আওতায় পেঁপে, কলা, আনারস, আম, কাঁঠাল এবং সমজাতীয় যেকোনো ফলের চিপস বানানো হবে। সেগুলো সারা বছর বাজারজাত করা সম্ভব হবে। প্রতিদিন সেখান থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ২০০ কেজি চিপস উত্পাদিত হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘বছরভিত্তিক ফল উত্পাদন কার্যক্রমের মাধ্যমে পুষ্টির উন্নয়ন’ প্রকল্পের উপপরিচালক মো. নুরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে দুটি প্রতিষ্ঠান করার বাজেট চেয়েছিলাম, একটি পেয়েছি। দ্রুতই এর কাজ শুরু হবে বলে আমরা আশাবাদী।’ অন্যরা কেন প্রক্রিয়াজাত খাবার প্রস্তুত করতে এগিয়ে আসছে না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে অনেকেই সাহস পাচ্ছে না, তবে আসতে চায়। আমাদের প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হলে যখন দেখবে তখন হয়তো অনেকেই এগিয়ে আসবে। তবে কেউ আসতে চাইলে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছি।’
এদিকে রপ্তানির ক্ষেত্রেও বলার মতো কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি। কিছু পরিমাণ আম ও কাঁঠাল বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে, যেগুলোর একমাত্র ক্রেতা ওই সব দেশে বসবাসকারি বাঙালিরা। এর বাইরে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ফল তেমন পাঠানো যাচ্ছে না।

আম-কাঁঠাল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সানড্রি অ্যাপেটিট লিমিটেডের মালিক রেজাউল ইসলাম কল্লোল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের আমগুলো মূলত ইউরোপের দেশগুলোতে যায়। তবে সেটা শুধু বাঙালিদের জন্য। ওয়ার্ল্ড মার্কেটের জন্য উন্মুক্ত নয়। কারণ পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ইন্ডিয়ার আমের যে কোয়ালিটি তার চেয়ে আমাদের আমের কোয়ালিটি অনেক নিম্নমানের। তবে ব্যাগিং পদ্ধতির মাধ্যমে এখন কিছু বেশি আম পাঠাতে পারছি আমরা।’
রেজাউল ইসলাম কল্লোল জানান, মানোন্নয়নের কাজ রপ্তানিকারককেই করতে হচ্ছে। কিছু এনজিওর সহায়তায় কৃষকদের সঙ্গে সামান্য কিছু কাজ হচ্ছে। তিনি বলেন, এখানে সরকার যদি কৃষক পর্যায়ে সহযোগিতা করত তাহলে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো।
সংরক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োগ নেই : প্রচুর পরিমাণ আম একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই পাচ্ছে মানুষ। কিছুদিন পরই ফলটি আর পাওয়া যাবে না। কারণ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ‘হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট’ নামের একটি পদ্ধতিতে ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া আমের লাইফটাইম বাড়াতে পারলেও বাংলাদেশে এর ব্যবহারই চোখে পড়ে না। করাচিতে সবচেয়ে বড় ‘হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’ তৈরি করা হয়েছে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে। সেখান থেকে ব্যবসায়ীরা সুবিধা নিতে পারছে। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানলেও এ নিয়ে কোনো প্রচার চালায় না তারা। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর একটি হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের জন্য মেশিন তৈরি করেছে। সেটি এখনো উদ্বোধনের অপেক্ষায়।

অনেকে বলছে, বড় আকারে হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট পিপিপির মাধ্যমে সরকার তৈরি করতে পারে। এতে আমের লাইফটাইম বাড়ানো সম্ভব হবে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আমের লাইফটাইম যে কেউ সাত থেকে ১০ দিন বাড়াতে পারে। তবে প্রক্রিয়াজাত করেও আম সংরক্ষণ করা যায় এই পদ্ধতিতে। এতে একটি আম বছরখানেক সময় খাওয়ার উপযোগী রাখা যায়।
আম সংরক্ষণ পদ্ধতি : কেউ এক বছরের জন্য আম সংরক্ষণ করতে চাইলে প্রথমে একটি বড় পাত্রে গরম (ফুটন্ত) পানি রাখতে হবে। এরপর পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানিতে প্রয়োজনীয় আম ধুয়ে তা একটি নেটের ব্যাগে ভরে (অন্য কোনোভাবেও হতে পারে) গরম পানিতে তিন থেকে পাঁচ মিনিট ভিজিয়ে রেখে তুলে আনতে হবে। পরে পরিষ্কার খোলা জায়গায় রাখতে হবে আমগুলো। শুকিয়ে যাওয়ার পর প্রথমে সব আমের বোটার অংশ কেটে ফেলতে হবে। এরপর খোসা ছিলে লম্বা স্লাইস করতে হবে এবং আটি বাদ দিতে হবে। এগুলো একটি ফুড গ্রেড ব্যাগে ভরে ডিপফ্রিজে রাখতে হবে। এমনভাবে প্যাকেটগুলো করতে হবে যাতে একটি প্যাকেট খোলা হলে সেটি এক বা দুই দিনের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হয়।


 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/07/04/653913