উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের মানববন্ধন থেকে আটক কয়েকজনকে পুলিশ ভ্যানে তোলা হচ্ছে
৪ জুলাই ২০১৮, বুধবার, ১০:৫৭

প্রেস কাবের সামনে অভিভাবকদের দাঁড়াতেই দেয়নি পুলিশ

দুইজন আটকের পর মুক্ত; অধ্যাপক ফাহমিদুল লাঞ্ছিত

কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং হামলাকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের দাবিতে সমাবেশ ডেকেছিলেন উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও নাগরিক সমাজ। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় জাতীয় প্রেস কাবের সামনে এই সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাদের দাঁড়াতেই দেয়নি পুলিশ। নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই সমাবেশ ঘিরে কঠোর বলয় গড়ে তোলে পুলিশ। প্রস্তুত রাখা হয় জলকামানের গাড়ি, রায়ট কার, প্রিজন ভ্যান ও দাঙ্গা পুলিশ। সেখানে চেয়ারে বসে চা-পান করতে থাকেন পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা। সারিবদ্ধভাবে অবস্থান নেন পুলিশ সদস্যরা। সমাবেশের ব্যানারও পুলিশ কেড়ে নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন। এ সময় প্রেস কাবের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ফাহমিদুল হক পুলিশের দ্বারা লাঞ্ছিত হন বলে তিনি অভিযোগ করেন। সেখান থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বাকি বিল্লাহ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদকে ধরে প্রিজন ভ্যানে তুলে নেয়া হয়। অবশ্য পুলিশ তাদের ছেড়ে দিয়েছে। বাকি বিল্লাহ জানান, পুলিশ আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে রমনা থানায় নিয়ে যায়। পরে সোয়া ৫টার দিকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়।

জানা যায়, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী জাতীয় প্রেস কাবের সামনে সারা দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিার্থীদের ওপর হামলা, গ্রেফতার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশস্থলে অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে বাধা দেয় পুলিশ। দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে তাদের সরিয়ে দেয়া হয় ধাক্কা দিয়ে। সেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সাবেক অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আহমেদ কামাল, সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকী, সাবেক সচিব হাসিব উদ্দিন, সর্বজন দলের আহ্বায়ক এনামুল হক, সঙ্গীতশিল্পী অরুপ রাহী, শ্রমিক নেত্রী মোশরেফা মিশু, অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম, ঢাবির সাবেক ছাত্র আবু তৈয়বসহ বাম দল ও ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। কিছুক্ষণ পরে উপস্থিত হন গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
একপর্যায়ে সাবেক সচিব হাসিব উদ্দিনকে আটকের চেষ্টা করলে তার সাথে পুলিশের ব্যাপক ধস্তাধস্তি হয়। সমাবেশের আয়োজকেরা জানতে চান কেন তারা প্রতিবাদ সমাবেশ করতে পারবেন না? কিন্তু পুলিশ কোনো কথা শুনতে নারাজ। তারা ধাক্কা দিয়ে অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সরিয়ে দেয়। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বাকী বিল্লাহকে আটক করে প্রিজন ভ্যানে তোলে পুলিশ। তাকে ছাড়িয়ে আনতে চেষ্টা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হকসহ কয়েকজন। কিন্তু তাদেরও পুলিশের রমনা জোনের এডিসি আজিমের নেতৃত্বে একটি দল ধাক্কা দেয় ও গালমন্দ করে। বাকি বিল্লাহকে না ছাড়ায় প্রতিবাদ হিসেবে রেহনুমা আহমেদ প্রিজন ভ্যানেই থেকে যান। ওদিকে ফাহমিদুল হককে ধাক্কা দিয়ে মূল সড়কে নিয়ে যায় পুলিশ। এ সময় তিনি রাস্তায় পড়ে যান। পুলিশ তার গায়ে হাত তুলেছে বলে অভিযোগ করেন অধ্যাপক ফাহমিদুল হক।

পরে তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ছাত্রদের ওপর চালানো হামলার প্রতিবাদে উদ্বেগ জানাতে এসেছিলাম। আমাদের সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। দুইজনকে আটক করা হয়েছে। আমি তাদের ছাড়িয়ে আনতে গেলে আমাকে পুলিশ লাঞ্ছিত করে। গায়ে হাত তুলেছে। ধস্তাধস্তি করেছে। এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। তিনি বলেন, আমার পরিচয় দেয়ার পরও পুলিশ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। বাকি বিল্লাহকে আটক করলে আমি আর রেহনুমা আহমেদ ভ্যানে উঠে যাই এবং অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে চাই। অফিসার এসে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে আমি প্রিজন ভ্যানের ‘তি সাধন’ করেছি। তাই গ্রেফতার করা হবে। পুলিশের সঙ্গে আমার ধস্তাধস্তি হয়েছে, তারা গ্রেফতারও করতে চেয়েছে, কিন্তু আন্দোলনকারীরা করতে দেয়নি।

গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতরে ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে, আমাদের সন্তানদের আহত করেছে। অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আজকে এখানে তাদের অভিভাবকেরাসহ আমরা সবাই আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তা জানাতে এসেছি। আমরা জানি না যে এখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। আমরা পুলিশের কাছে কাগজপত্র বা নির্দেশনা দেখতে চেয়েছি, তারা তাও দেখাতে পারেনি। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বাকি বিল্লাহ এবং অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে আমাদের মানববন্ধন শুরু হওয়ার আগেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হককে লাঞ্ছিত করায় তীব্র নিন্দা জানাই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সমাবেশের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম বলেন, আমরা এখানে উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের প থেকে জানাতে এসেছি যে, আমাদের সন্তানেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নিরাপদ নয়। আমরা চাই অবিলম্বে আমাদের সন্তানদের ওপর সরকার ও রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে, নির্দেশে বা অনুমোদনে যে হামলা ও নির্যাতন পরিচালিত হচ্ছে সে বিষয়ে অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেয়া হোক। যাদের নামে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে ও গ্রেফতার করা হয়েছে, সেসব মামলা প্রত্যাহার করে তাদের দ্রুত মুক্তি দেয়া হোক। যাদের তুলে নেয়া হয়েছে এবং যারা নিখোঁজ তাদের অবিলম্বে অভিভাবকদের কাছে ফেরত দেয়া হোক। আহতদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক এবং হল ও ক্যাম্পাসে যে দলীয় সন্ত্রাস ও ভীতির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তার চিরতরে অবসান ঘটানো হোক।
সমাবেশ করতে না দেয়া এবং আটকের বিষয়ে প্রেস কাবের সামনে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, নিরাপত্তার জন্যই অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত অভিভাবক নজরুল ইসলাম তালুকদার সাংবাদিকদের বলেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যে ছাত্রটাকে মারা হয়েছে সে আমার ছেলে। আর মেয়েটি ইডেন কলেজের ছাত্রী আমারই মেয়ে। আমি বলবÑ এভাবে নির্যাতন না করে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিন। পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করুন। আমাদের টাকায় তো রাষ্ট্র চলে। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিচার দাবি করেন তিনি।
ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, যখন কোনো সরকারের জনপ্রিয়তা থাকে না তখন তারা পুলিশ ও বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার ওপর ভর দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়। যার প্রমাণ প্রেস কাবের সামনে সরকার সমাবেশ করতে দেয়নি। আসলে এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিসর্জন দিচ্ছে। তিনি অবিলম্বে ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, শেখ হাসিনা কারো ফাঁদে পা দিবেন না।
একই দাবিতে পরে প্রেস কাবের সামনে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করে কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ-সিপিবি ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/330054