৪ জুলাই ২০১৮, বুধবার, ১০:৫৫

দেশে ফেরার অপেক্ষায় কয়েক লাখ মানুষ

অবৈধভাবে বিদেশ গিয়ে কঠিন সংকটে পড়েছেন দেশের কয়েক লাখ মানুষ। কেউ জেল খাটছেন; আবার কেউ পালিয়ে পালিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কোনো কোনো দেশ থেকে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে খালি হাতে। আবার কোনো কোনো দেশে নতুন নতুন নিয়মনীতি জারি করার কারণে বাধ্য হয়েই দেশে ফিরতে হবে। তারা সবাই দেশে ফেরার প্রহর গুনছেন।

জানা গেছে, মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে ইউরোপেও কঠিন সংকটে আছেন বাংলাদেশীরা। নানা কারণে তাদের দেশে ফিরে আসতে হচ্ছে। আর যারা অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করছেন তারা ওই দেশে জেলের মধ্যে অথবা বাইরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সবকিছু মিলিয়ে এক সংকটময় সময় পার করছে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির বাজার।
জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় চলতি বছরে ২০ হাজার অবৈধ অভিবাসী আটক করেছে অভিবাসন বিভাগ। এর মধ্যে প্রায় ৪ হাজার বাংলাদেশী রয়েছে। গত ৬ মাসে এসব অভিবাসী আটক করা হয়। অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যায় ইন্দোনেশিয়ানদের পরেই বাংলাদেশীদের অবস্থান রয়েছে। দেশটিতে বসবাসরত অবৈধ অভিবাসীদের ধরতে ১ জুলাই থেকে ইমিগ্রেশন এবং পুলিশ শুরু করেছে মেগা-থ্রি নামে অভিযান। মেগা থ্রি অভিযানের তিন দিনে বাংলাদেশীসহ প্রায় ১৭শ’ অবৈধ অভিবাসী আটক হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে ৪শ’ জনের অধিক বাংলাদেশী আটক হয়েছেন।
দেশটির ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে (পিকেনানাস ক্যাম্প) মালয়েশিয়ান আইন অনুযায়ী পাসপোর্ট ও ভিসা না থাকা, পাসপোর্ট ও ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়া এবং সাগর বা স্থলপথে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের পুলিশ গ্রেফতার করে বিচার ও জেল শেষে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য রাখা হয়। এরপর হাইকমিশন থেকে অস্থায়ী ট্রাভেল পাশ ইস্যু করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে নিজেকে বিমান ভাড়া বহন করতে হয়। পিকেনানাস ক্যাম্পে ১৩৭ জন বাংলাদেশী দেশে ফেরতের অপেক্ষায় আছেন। তাদের জাতীয়তা নিরূপণ করে ট্রাভেল পাশ ইস্যু করা হচ্ছে বলে জানান কাউন্সিলর (শ্রম) মো. সায়েদুল ইসলাম।
বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা যায়, বন্দীশিবিরে যারা আটক আছেন তাদের দ্রুত দেশে পাঠানোর সব রকম ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যাদের কেউ নেই অথবা টিকিটের ব্যবস্থা হচ্ছে না তাদের দূতাবাসের পাশাপাশি জনহিতৈশী কাজে নিয়োজিতদের সহযোগিতায় বিমান টিকিট দিয়ে দেশে পাঠানো হয়।
প্রসঙ্গত, মালয়েশিয়াতে ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় অবৈধ অভিবাসীদের বৈধকরণ প্রক্রিয়া। এরপর ১৬ সালের ১৫ আগস্ট নিবন্ধনের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সর্বশেষ সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত চলে নিবন্ধন প্রক্রিয়া। দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালক দাতুকে সেরি মোস্তাফার আলী জানান, গত জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে জুনের ৩০ তারিখ পর্যন্ত মোট ১৯ হাজার ৯৭৯ জন বিদেশী অভিবাসীকে আটক করা হয়েছে। এছাড়াও ৯ হাজার ৮৫৮ জন অবৈধ অভিবাসীকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। বাকিদেরও শিগগিরই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
তিনি জানান, আটক হওয়া অভিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন ইন্দোনেশিয়ান। প্রতিবেশী এই দেশটির ৬ হাজার ৮৯৫ জন অবৈধ অভিবাসীকে আটক করা হয়েছে। এরপরই রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ। ৬ মাসে ৩ হাজার ৯৭৫ জন বাংলাদেশিকে আটক করা হয়েছে। ১ হাজার ৯৯৫ জন মিয়ানমারের নাগরিক।

জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে জনশক্তি রফতানি শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক পাড়ি দিয়েছে। আরও প্রায় ৫০ হাজার যাওয়ার অপেক্ষায়। তবে এ সময়ের মধ্যে দুই দেশের ইমিগ্রেশনকে ম্যানেজ করে এক মাসের এন্ট্রি নিয়ে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে অনেকেই ঢুকছে। যার বেশিরভাগই পরবর্তী সময়ে পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ে মানবেতর জীবন কাটিয়ে খালি হাতে দেশে ফিরেছে। এখনো অনেক বাংলাদেশী দেশটির ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক হয়ে রয়েছে। তারপরও অবৈধপথে লোক যাওয়া অব্যাহত রয়েছে। এর সঙ্গে চিহ্নিত চক্রগুলো দুই দেশের ইমিগ্রেশনের কিছু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে আদম পাচারের মতো কাজ নির্বিঘেœ চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে অভিবাসন ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন চুক্তির কারণে ইউরোপের জোটভুক্ত বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে বসবাসকারী ১ লাখের বেশি বাংলাদেশিকে দেশে ফিরতে হচ্ছে। ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাশীদের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এছাড়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া বন্ধ করতে এবং তুরস্ক ও লিবিয়ার মতো ইউরোপের সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে অভিবাসন ঠেকাতে প্রণোদনা দেয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় জোট। এসব কারণে বিভিন্ন সময়ে ইউরোপে প্রবেশ করা ১ লাখের বেশি অবৈধ অভিবাসী বাংলাদেশী বিপাকে পড়তে যাচ্ছেন। এতে করে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় পড়েছে সেখানকার অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশীরা।

সংশিষ্টরা বলছেন, অবৈধ বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে আনতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশকে গত বছর থেকে চাপ দিচ্ছে। এমনকি ইউরোপে অবৈধ বাংলাদেশীদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ে বাংলাদেশ দেরি করলে তাদের পাঠিয়ে দেওয়ারও হুমকি দিয়ে আসছিল। কিন্তু শুক্রবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পাদিত নতুন চুক্তিটির কারণে অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের এবার ফিরতেই হচ্ছে।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রায় প্রতিদিনই ফিরছে নির্যাতিত নারী। তারা সংসারে সুখের আশায় বিদেশ পাড়ি দিলেও দেশে ফেরত এসে নির্যাতনের কথা জানাচ্ছেন। এছাড়া ইকামার অর্থ বৃদ্ধি, ১২ পেশায় প্রবাসীদের কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা, শীতল কূটনৈতিক সম্পর্কসহ সব মিলিয়ে সৌদি আরবে বাংলাদেশী প্রবাসীদের ভাগ্য একেবারে অনিশ্চিত। এ সংখাটা পঁচিশ লাখের ওপরে।
অভিবাসন খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, ফেরত আসা নারীদের শুধু আর্থিক সহায়তা নয়, দীর্ঘ মেয়াদে তাঁদের সমাজে পুনর্বাসন করার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। এ ক্ষেত্রে শুধু সৌদি আরব নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলো থেকেও যাঁরা ফেরত আসছেন, তাঁদের বিষয়েও সরকারকে ভাবতে হবে।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর বিষয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ। এরপর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ নারী সৌদি আরবে গেছেন। আর ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে গেছেন প্রায় ৭ লাখ নারী। তবে তারা এখন দেশে এসে নির্যাতনের অভিযোগ করছেন।
নারী গৃহকর্মীদের ফিরে আসার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) সমন্বয়ক সি আর আবরার বলেন, নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসা নারীরা সবাই সরকারের বৈধ পথে বিদেশ গিয়েছিলেন। বর্তমানে নারীদের ফেরত আসার সংখ্যাটা বেড়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/336440