৩ জুলাই ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৫৫

গার্মেন্টে বাড়তি দায়িত্ব এড়াতে পদোন্নতি চান না নারী শ্রমিকরা

গার্মেন্ট কারখানায় নারী শ্রমিকদের নানা দুর্ঘটনার কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। দেশের শ্রমঘন পোশাক খাতের প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিকের মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। যদিও এক দশক আগেও মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশের বেশি ছিলেন নারী। এখন তা ৬০-৬৫ শতাংশে নেমে এসেছে। সংসারের কাজের চাপে ও পরিবারের আপত্তির কারণে গার্মেন্টসে বাড়তি দায়িত্ব এড়াতে পদোন্নতি চান না নারী শ্রমিকরা। তাই দেশের বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানায় বছরের পর বছর একই পদে কম মজুরিতে নারী শ্রমিকরা কাজ করছেন। নারী শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা সহ বিভিন্ন বিষয়ে নজর দিতে বলছেন আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও নারী শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন। এ সব সংগঠনের অভিযোগ, বাংলাদেশে বড় তৈরি পোশাক কারখানার সাব-কন্ট্রাক্ট পাওয়া ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া সহজ নয়। সাব-কন্ট্রাক্ট পাওয়া এ সব প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে বড় পোশাক নির্মাতারা স্বচ্ছতা অবলম্বন করেনা। ফলে সেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারী শ্রমিকদের দিয়ে দীর্ঘসময় কাজ করানো, কম মজুরি দেয়া, যৌন নির্যাতন, শ্লীলতাহানির অভিযোগ রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ এলাকার একটি পোশাক কারখানায় ১০ বছর আগে কাজ শুরু করেন সোনিয়া বেগম। কর্মজীবনের ছয় বছরের মাথায় সুইং অপারেটর থেকে সুপারভাইজর হওয়ার প্রস্তাব পান। যদিও সে প্রস্তাবে রাজি হননি তিনি। পারিবারিক কারণেই দায়িত্বটি এড়িয়ে যান সোনিয়া। ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) ‘কাটিং থ্রু দ্য ক্লথ সিলিং’ শীর্ষক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় এইসব তথ্য উঠে আসে। 

দেশের শ্রমঘন পোশাক খাতের ৪৫ লাখ শ্রমিকের মধ্যে সোনিয়ার মতো নারীই বেশি। যদিও এক দশক আগেও মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশের বেশি ছিলেন নারী। এখন তা ৬০-৬৫ শতাংশে নেমে এসেছে। নারীর সংখ্যাধিক্য এখনো টিকে থাকলেও শিল্পের শুরু থেকেই তাদের কর্মক্ষেত্র সীমাবদ্ধ ছিল কারখানার নিম্ন গ্রেডে সুইং অপারেটরসহ অন্য পদগুলোয়। পদোন্নতির মাধ্যমে সুপারভাইজর পদে নারীর অংশগ্রহণ দেখা যায়নি সেভাবে। এ ধারা অব্যাহত আছে এখনো।
ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) ‘কাটিং থ্রু দ্য ক্লথ সিলিং’ শীর্ষক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দায়িত্ব এড়াতেই পদোন্নতি চান না পোশাক খাতের অধিকাংশ নারী শ্রমিক। গড়ে দেশের ২০টি সুইং লাইনের মধ্যে ১৯টিতে সুপারভাইজর হিসেবে কাজ করছেন পুরুষ। যদিও প্রডাকশন লাইনের কর্মীদের ৮০ শতাংশই নারী। আর এর মূলে রয়েছে নারী শ্রমিকের দায়িত্ব এড়ানোর মানসিকতা।
সমীক্ষার আওতায় থাকা নারী শ্রমিকরা যেসব কারখানায় কাজ করেন সেগুলোর মধ্যে আছে আধুনিক পোশাক শিল্প, এ কে এইচ নিটিং অ্যান্ড ডাইং, অনন্ত গার্মেন্টস, আরাবি ফ্যাশনস, বার্ড আরএনআর ফ্যাশন, বার্ড ফাডরেক্স, কলাম্বিয়া অ্যাপারেলস, কর্টজ অ্যাপারেল, ক্রিসেন্ট ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন, এসকোয়্যার নিট কমপোজিট, এসেনশিয়াল ক্লথিং, এসেস ফ্যাশন, ফকির ফ্যাশন, জেনেসিস ডেনিম, ইন্টরস্টফ অ্যাপারেল, জেকন গার্মেন্টস, জিন্নাত নিটওয়্যার, নিট এশিয়া, রাকুফ অ্যাপারেল ওয়াশিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, সাফা সোয়েটার, শামস স্টাইলিং, সিনহা নিটওয়্যার, সাউথ ইস্ট টেক্সটাইল, স্প্যারো অ্যাপারেল, স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপ, স্টার্লিং স্টাইল, দ্যাটস ইট গার্মেন্টস ও ভিনটেজ গার্মেন্টস।
আইএফসির সমীক্ষার আওতায় ছিলেন ২৮টি পোশাক কারখানার ১৪৪ জন নারী শ্রমিক। এর মধ্যে ৯২ জন নারী শ্রমিক সমীক্ষার আওতায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সম্পন্ন করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের সবাইকে সুপারভাইজর পদে পদোন্নতির প্রস্তাব দেয়া হয়। এর মধ্যে ৫২ জন বা ৫৭ শতাংশ প্রস্তাব গ্রহণ করায় পদোন্নতি পান। বাকি ৪০ জন বা ৪৩ শতাংশ পদোন্নতি নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এর কারণ জানতে চাইলে প্রায় অর্ধেকই অসুস্থতা বা গর্ভধারণের মতো স্বাস্থ্যগত কারণ উল্লেখ করেন। ২৮ শতাংশ পদোন্নতির পর অতিরিক্ত দায়িত্বের প্রতি তাদের আগ্রহের ঘাটতির কথা বলেন। এছাড়া ২০ শতাংশ উল্লেখ করেন নতুন দায়িত্বে পরিবারের অসহযোগিতার কথা।
তবে প্রশিক্ষণ নেননি তাদের বেশির ভাগই পদোন্নতি চাননি। অনেকেই জানান, উচ্চ পদে কাজ করার বিষয়ে পরিবারের আপত্তির কথা। সমীক্ষার আওতায় থাকা ১৪৪ জনের সবাইকে যখন পদোন্নতির প্রস্তাব দেয়া হয়, তখন ৩০ শতাংশ তা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানকারীদের ৭৫ শতাংশই দায়িত্বটি তাদের পছন্দ নয় বলে জানান। অনেক বেশি সময় ধরে কাজের কথা জানান ১০ শতাংশ শ্রমিক। আর ৫ শতাংশ মনে করেন, কারখানা ব্যবস্থাপকরা নারীদের পদোন্নতি চান না। ৫ শতাংশ সুপারভাইজরের মতো পদে নারীদের ভূমিকা আছে বলে মনে করেন না।
জানতে চাইলে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা কেবল নারী শ্রমিকের নয়। বরং পুরুষ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায় থাকা কর্তাব্যক্তিদেরও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। নারীরা পদোন্নতি চান না আস্থার ঘাটতিতে। আর আস্থার ঘাটতি দূর করতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। আসলে দায়িত্ব এড়াতে নয়, বরং দায়িত্ব নিয়ে নারী শ্রমিকের সচেতনতার ঘাটতি আছে। পাশাপাশি পরিবারও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। সর্বোপরি নারীর ক্ষমতায়নে প্রশিক্ষণে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে মালিকপক্ষকে। কারণ উচ্চপদে নারী থাকলে উৎপাদনশীলতায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সম্ভব।
সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, যেসব কারখানায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী সুপারভাইজর রয়েছেন, সেসব কারখানায় গড় উৎপাদনশীলতা ৫ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি হ্রাস পেয়েছে প্রডাকশন লাইনে অনুপস্থিতির হারও।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর মিডিয়া অফিস (জনসংযোগ) সূত্রে জানাযায়, কাজের ব্যস্ততার কারণে পোশাক কারখানাগুলোয় নিজ উদ্যোগে এ ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আয়োজন করা কঠিন। তার পরও প্রশিক্ষণের বিষয়ে মালিকপক্ষের আগ্রহ আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে নারী শ্রমিকদের মধ্যেও সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/336363-