২ জুলাই ২০১৮, সোমবার, ১০:৪৪

তিন কোটি মধ্যবিত্ত বাজেটের চাপে

আয় বাড়াতে বাড়ানো হয়েছে করের আওতা; ৩১ পণ্যের ট্যারিফ বাড়িয়েছে সরকার নিজেই; সংশয় আছে ঘোষিত সুবিধার সফল্য নিয়েও

২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট এরই মধ্যে সংসদে অনুমোদিত হয়েছে। আজ রোববার থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে দেশের ইতিহাসে বৃহত্তম এ বাজেট। নির্বাচন সামনে রেখে দিয়ে একে ভোটার তুষ্টির বাজেট বলা হলেও এ বাজেটের কারণে এরই মধ্যে চাপে পড়েছেন দেশের তিন কোটি মধ্যবিত্ত। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ করের বোঝা চেপেছে তাদের ঘাড়ে। খরচ বেড়েছে অথচ আয় বাড়েনি। রাষ্ট্রের আয় বাড়াতে বাড়ানো হয়েছে করের আওতা ও ধরন। সরকার নিজেই বাড়িয়েছে ৩১ ধরনের পণ্যের ট্যারিফ মূল্য। অভিযোগ উঠেছে, এবারের বাজেটে কিছু ব্যাংকমালিক ছাড়া খুশি হয়নি ব্যবসায়ীদের কোনো পক্ষই। স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা এবং কৃষকদের সুবিধা দেয়ার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার ফসল ঘরে তোলা কতটা সম্ভব হবে সে বিষয়েও রয়েছে বিস্তর সংশয়।

বাজেটের প্রভাবে মধ্যবিত্তের ব্যবহার্য রিকন্ডিশন্ড গাড়ি, ফলের জুস, এনার্জি ড্রিংক, বডি স্প্রে, চকোলেট, ফিলামেন্ট বাল্ব, আইপিএস-ইউপিএস, কফি, মোবাইল চার্জার, ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার, গ্রিন-টি, টমাটো কেচাপ, টমাটো সস, শেভিং ব্লেড, শেভিং জেল, চশমার ফ্রেম, সানগ্লাস, লুব্রিকেটিং অয়েল, সিরামিক বাথটব, সব ধরনের বাদাম, ক্যালেন্ডার, জার্সি, কার্ডিগান, শাল, চুলের ক্রিম, হেয়ার রিমুভার, সিআর কয়েল, জিপি শিট, সিআই শিট, আমদানিকৃত মধু, প্লাস্টিক ব্যাগ এবং বিভিন্ন ধরনের কাগজ প্রভৃতির দাম এরই মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। তা ছাড়া চালের মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ লেগেছে সবশ্রেণীর মানুষের গায়ে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশের জনগণের ভোগ্যপণ্যের বড় অংশই যেখানে আমদানিনির্ভর সেখানে আমদানি পর্যায়ে সব পণ্যের েেত্র আগাম ট্রেড ভ্যাট (এটিভি) ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার মাধ্যমে মূলত দেশের আপামর জনগণের ওপর বাজেটীয় চাপ বাড়ানো হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, কাগুজে নিয়মে পরবর্তীতে এটি মূল ভ্যাট থেকে সমন্বয়য়ের বিধান থাকলেও বাস্তবে সব পণ্যে সমন্বয় হয় না। ফলে এ সিদ্ধান্তের ফলে খাদ্যপণ্য এবং পোশাকসহ ফিনিশড গুডসের দাম বাড়বে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, যেখানে খাদ্যপণ্য মূল্যস্ফীতিও ঊর্ধ্বমুখী, সেখানে এটিভি বাড়ানোর ফলে আগামী বছর মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা কঠিন হবে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের আমদানি ব্যয় দ্রুত বাড়ছে। রফতানি যেখানে ছয় শতাংশ হারে বাড়ছে সেখানে আমদানি ব্যয় বাড়ছে ১৫ শতাংশ হারে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঘাটতি বাড়ছে এবং চাপ পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ৫৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়। এ সময়ে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৩৫ বিলিয়ন ডলার। আর নিষ্পত্তি হয়েছিল ৩৩ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে এই নয় মাসে এলসি খোলার হার বেড়েছে ৫৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর নিষ্পত্তি বেড়েছে ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ।

আজ থেকে কার্যকর হতে যাওয়া পুরো বাজেটেই প্রত্য করের চেয়ে পরো করের ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে। তুলনামূলকভাবে উচ্চ ও নি¤œ আয়ের মানুষকে সুবিধা দেয়া হলেও চাপে পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। অথচ ভোক্তা শ্রেণী হিসেবে তারা বড়। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচনী অর্থনীতির বড় জোগানদাতা হিসেবে ধনিক শ্রেণীকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখা হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বেছে নেয়া হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগানদাতা হিসেবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের ভাষায়, এবারের বাজেটে উচ্চবিত্তের লালন, মধ্যবিত্তের দলন এবং নিন্মবিত্তদের জন্য ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। এর ফল মধ্যবিত্তরা এরই মধ্যে ভোগ করতে শুরু করেছেন।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে শুল্ক ও কর বসানোর ভিত্তিমূল্য তথা ট্যারিফ মূল্যের পরিবর্তন আনা হয়েছে। দেশে উৎপাদিত হয় এমন ৩১ ধরনের পণ্যের ট্যারিফ মূল্য বাড়ানো হয়েছে। পণ্যগুলোর অন্যতম হলো জুস, বিস্কুট, কেক, টমাটো সস বা কেচআপ, এলপি গ্যাস, তৈরী পোশাকের ঝুট, আমসত্ত্ব, চশমার ফ্রেম, ডুপ্লেক্স বোর্ড ইত্যাদি। ফলে এসব পণ্যের দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। এ ছাড়াও বাজেটের কারণে মধ্যবিত্তকে চাপে ফেলার বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে- করমুক্ত আয়ের সীমা না বাড়ানো, ছোট ফ্যাটে ভ্যাট বৃদ্ধি, ফার্নিচারের উৎপাদন ও বিপণন কর, পোশাকে ভ্যাট বাড়ানো প্রভৃতি।

রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রভাবে এবারের বাজেটে মধ্যবিত্তরা চাপে পড়বে জানিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাজনীতিবিদরা ভোটের কারণে নিন্মবিত্তদের গুরুত্ব দেন। আবার সম্পদশালীদের গুরুত্ব দেন নির্বাচনের টাকা সংগ্রহের জন্য। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে অর্থনীতির সুষ্ঠু বিকাশ এবং শিার গুণগতমান উন্নয়নসহ সমাজে কাক্সিত ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে না।
এদিকে সংসদে অর্থবিলে অনুমোদনের পূর্বে ফিল্ড মিল্ক পাউডার বাল্কে আমদানিতে এর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ বহাল রেখে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, আর্গন, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের রেগুলেটরি ডিউটি শূন্য থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ আরোপ করা হয়।

নিউজপ্রিন্ট আমাদানিতেও সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ করা হয়। এ ছাড়া গুণগত মানসম্পন্ন কোল্ড রোল্ড ও কালার কোটেড কয়েল বা শিটের আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। বিলে রেফ্রিজারেটর ও এয়ার কন্ডিশনারের কাঁচামাল ০.২৫ এমএম পুরুত্বের ফ্যাট রোল্ড প্রোডাক্টের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। লিফ স্প্রিং আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ, ৭৫০ ওয়াট মতার মোটর আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর এবং ৫ শতাংশ অগ্রিম ভ্যাট আরোপ করা হয়। টেলিভিশনের ওপেন সেল আমদানিতেও আলাদা এইচএস কোড তৈরি করে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। এসব কারণে মধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়বে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/329538