১ জানুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ৩:৩০

ভূমি নিয়ে উত্তপ্ত হচ্ছে পাহাড়

তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ভূমি মালিকানা ইস্যুতে। উপজাতি ও বাঙালিদের মধ্যে যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের নাশকতা। এই তিন জেলার গহিন পাহাড়ে এরইমধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে অনেক বাঙালি পরিবারকে। ফসল লাগানো মাঠে গেলেই অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাদেরকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে। এতে কাজ না হলে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে এলাকা ছাড়া করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে এ ধরনের উচ্ছেদ নিয়ে পার্বত্য জেলায় কর্মরত সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। দুর্গম এলাকা হওয়ায় অনেক সময় এ সমস্যার সমাধান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনকে। এদিকে ১৯৯৭ সালে সরকারের সঙ্গে জেএসএস-এর শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন নিয়ে নতুন করে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিয়েছে সংগঠনটি। অন্যদিকে পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে পাহাড়কে অশান্ত করতে তৎপর ইউপিডিএফ ও জেএসএস (সংস্কার)-এর সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যরা। রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরের বুড়িঘাট এলাকার বাসিন্দা মধু মিয়া ও জামান শিকদার জানান, ১৯৮১ সালে তারা এ এলাকায় আসেন। ওই সময় তাদের সঙ্গে ছিল ৮৩২টি পরিবার। সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেককে ৫ একর করে জায়গা দেয়া হয়। পরে উপজাতি সন্ত্রাসীদের হামলা ও ভয়ভীতিতে প্রায় সাড়ে তিনশ’ পরিবার পালিয়ে যায়। এখন ৫শ’ পরিবার বসবাস করছে এ এলাকায়। তারা বলেন, উপজাতি সন্ত্রাসীরা যেভাবে প্রতিনিয়ত অত্যাচার করছে তাতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। ১০ই ডিসেম্বর গভীর রাতে এ দুজনের ৩৫ হাজার আনারস গাছ চাকমা ও মারমা সন্ত্রাসীরা কেটে দিয়ে যায় বলে জানান। বিষয়টি নিয়ে থানায় মামলাও করা হয়েছে। গত কয়েকদিন খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর চুক্তির শর্তানুসারে গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন। দুই যুগের অধিক সময় ধরে পাহাড়ি এলাকায় চলে আসছে সংঘাত। নিজ বাড়ি ছেড়ে দুর্গম পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়া পাহাড়িদের নিজ ভূমিতে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেয়াই ছিল এই কমিশনের প্রধান কাজ। নানা কারণে ওই কমিশন পাহাড়ে ভূমি বিরোধের সমাধান করতে পারেনি। সরকার আবার নতুন করে ভূমি কমিশন গঠন করে দিয়েছে। এই কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে পার্বত্য জেলার ভূমি ব্যবস্থাপনা, জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় প্রশাসনে কমিশনের উপস্থাপিত বা দাখিলকৃত তথ্য উপাত্ত প্রচলিত আইন বিবেচনায় পার্বত্য জেলাধীন পাহাড় এবং জলেভাসা জমিসহ সমুদয় ভূমি (প্রযোজ্য আইনের অধীন অধিগ্রহণকৃত এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প-কারখানা ও সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডকৃত ভূমি ব্যতীত) মৌজাওয়ারি স্থানীয় জরিপ কার্য পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ওই সময় সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে সার্কেল চিফ ও আঞ্চলিক পরিষদ প্রতিনিধি কমিশন সভা বর্জন করার পাশাপাশি পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ থেকে প্রথমে ২৩ দফা পরে ১৩ দফা সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয়। পাহাড়িদের দাবির প্রেক্ষিতে সমপ্রতি সরকার কমিশন আইনের কিছু ধারা সংশোধন করে নতুন কমিশন গঠন করেছে। এ প্রসঙ্গে তিন পার্বত্য জেলার বাঙালি সংগঠনগুলোর নেতারা জানান, সংসদে উত্থাপিত বিলে আইনের ৬ (গ) ধারায় ভূমির পরিবর্তে ‘যে কোনো ভূমি শব্দগুলো জুড়ে দেয়ায় তিন পার্বত্য অঞ্চলের যে কোনো ভূমি/জমি পাহাড়িরা নিজের দাবি করে ভূমি কমিশনে আবেদন করতে পারবেন। এরপর কমিশন বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে দাবি করা ভূমি উপজাতিদের নামে নাম জারি করতে পারবে। এতে একদিকে সরকারের এখতিয়ার যেমন খর্ব হবে তেমনি তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত বাঙালিরাও ভূমিহীন হতে বাধ্য হবে। পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের ‘ঘ’ অনুচ্ছেদের ৪-এ বলা হয়েছে ‘গঠিত ভূমি কমিশন পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জায়গা-জমির বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করাসহ এ যাবৎ যে সব ভূমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হয়েছে, সেসব জমি ও পাহাড়ের মালিকানার স্বত্ব বাতিলে পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। এখানে ১২ হাজার ২২২ ভারত প্রত্যাগত পরিবারকে পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে। এসব প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, উপজাতিদের দাবি অনুযায়ী সব দফা বাস্তবায়ন করা হলে পার্বত্য অঞ্চল আর বাংলাদেশের অংশ থাকবে না। কারণ তখন তাদের হাতে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও বন বিভাগ চলে যাবে। এখান থেকে সব নিরাপত্তা সংস্থার লোকজনকে চলে যেতে হবে। এসিল্যান্ড চলে যাবে। এসব যদি চলে যায় দেশের এক-দশমাংশের সার্বভৌমত্ব থাকবে না। সরকার ভূমি কমিশন করেছে। ভূমি কমিশন কাজও শুরু করেছে। ভূমি বিরোধ মিটে গেলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। উপজাতি নেতৃবৃন্দ নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছে যাতে তারা এই অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন পান। কিন্তু ১৯৯৭ সালের চুক্তিতে কোথাও বলা হয়নি যে, তাদের স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ওই চুক্তির কোথাও ‘শান্তিচুক্তি’ কথাটিও লেখা নেই। ফলে উপজাতিদের দাবি অযৌক্তিক। এখানকার ভূমি ৩ ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। সমতল, উঁচু টিলা ও পাহাড়। এখানে সমতলে এক একর ভূমির রাজস্ব মাত্র ৩ টাকা, উঁচু টিলার রাজস্ব ২ টাকা আর পাহাড়ের ১ টাকা। এই রাজস্ব আদায় করেন হেডম্যান ও কারবারিরা। আমরা জমির রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছি জমির ব্যবহারের ভিত্তিতে খাজনা বা রাজস্ব নির্ধারণের। ১৯১৭ সালের সিএস রেকর্ডের একটি কাগজের ভিত্তিতে জমির কাজকর্ম পরিচালনা করে আসছি। আমি মনে করি ভূমি সমস্যার সমাধান হলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, সশস্ত্র সংগঠনগুলো স্বাধীনতা চাচ্ছে কি না আমার জানা নেই। তবে তারা ভূমি, বন ও পুলিশি ক্ষমতা পেতে চায়। আমি মনে করি এর অর্থ হলো সার্বভৌমত্ব চাওয়া। রাষ্ট্রের কোনো সম্পত্তি আঞ্চলিক পর্যায়ে দেয়া উচিত নয়। জেলা প্রশাসক বলেন, পার্বত্য জেলার মূল সমস্যা হলো ভূমি। এখনো এটা জরিপ করা হয়নি। যার কারণে নানা সমস্যা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চিঠি দিয়ে এরইমধ্যে পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে ভর্ৎসনা পেয়েছি। সংশ্লিষ্টরা জানান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় বর্তমানে ৫১ ভাগ পাহাড়ি বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী আর ৪৯ ভাগ বাঙালি জনগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। দেশের এক-দশমাংশ এলাকায় মাত্র ১৬ লাখ লোকের বসবাস। ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পাহাড়িদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে সরকার। এই চুক্তির ৭২টি দফার মধ্যে ৪৮টি দফার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাকি দফাগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে। ধরতে গেলে উপজাতিদের দেয়া দফাগুলোর সবই বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=47161&cat=3/%E0%A6%AD%E0%A7%82%E0%A6%AE%E0%A6%BF-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%89%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%A4-%E0%A6%B9%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A7%9C