৩১ ডিসেম্বর ২০১৬, শনিবার, ২:২৯

বাড়িভাড়ায় নৈরাজ্য

ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে বাড়িভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলছে। মালিকেরা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো বাড়িভাড়া বাড়াচ্ছেন। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে ভাড়া বাড়ানো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে ভাড়াটেরা থাকেন আতঙ্কে
বছর ঘুরছে আর বাড়ছে বাড়িভাড়া। বাড়ছে নিত্যপণ্যের দামও। গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৩৮৮ শতাংশ। অথচ একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।
বাড়িভাড়া ও নিত্যপণ্যের দামের এই হিসাব ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)।
অথচ বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে ২৫ বছর আগে আইন হলেও বিধিমালা হয়নি। নেই আইনের প্রয়োগ। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠনের জন্য সর্বোচ্চ আদালত রায়ও দিয়েছিলেন। দেড় বছর পেরোলেও সেই কমিশন এখনো গঠিত হয়নি। এরই মধ্যে প্রতিবারের মতো এবারও বছরের শুরুতে বাড়ির মালিকেরা নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, গ্রিন রোড, গুলশান, বনানী, উত্তরা, ওয়ারী, মালিবাগ, রামপুরা, খিলগাঁও এলাকার অন্তত ২০ জন ভাড়াটের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেছেন, ইতিমধ্যে তাঁদের কাছে এলাকাভেদে ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ পাঠিয়েছেন বাড়ির মালিকেরা।
এ বিষয়ে ক্যাবের সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভাড়াটেরা বাড়ির মালিকদের কাছে জিম্মি। সরকার কখনোই ভাড়াটেদের পক্ষে ন্যায্য পদক্ষেপ নেয়নি। ১৯৯১ সালের যে বাড়িভাড়া আইন আছে, সেটিও কার্যকর নেই।
নির্মাণসামগ্রী, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে বাড়িভাড়া বাড়ানোর বিষয়টিও অযৌক্তিক বলে মনে করেন গোলাম রহমান। তিনি বলেন, ভাড়াটেদের চাহিদার সুযোগ নিয়ে বাড়ির মালিকেরা ভাড়া বাড়িয়ে নিচ্ছেন।
উচ্চ আদালতের রায়ে বাড়িভাড়া কমিশন গঠনের দায়িত্ব ছিল মন্ত্রিপরিষদ সচিবের। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের মুঠোফোনে গত মঙ্গলবার যোগাযোগ করা হয়। তিনি জবাব না দেওয়ায় খুদে বার্তা পাঠানো হয়। খুদে বার্তার জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তাঁর জানা নেই। তিনি খোঁজ নেবেন।
বাড়িভাড়া বাড়ছেই
ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ১৯৯০ সালে পাকা ভবনে দুই কক্ষের একটি বাসার ভাড়া ছিল ২ হাজার ৯৪২ টাকা। ২০১৫ সালে সেই ভাড়া দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৫০ টাকা। ২০০৬ সাল থেকে গত ১০ বছরে ভাড়া বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এ সময় ভাড়া বেড়েছে প্রায় সাড়ে চার গুণ।
গ্রিন রোড এলাকায় দুই কক্ষের একটি বাসায় চার বছর ধরে থাকছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাব্বির হোসেন। তিনি ৮০০-৮৫০ বর্গফুটের এই বাসাটি ১২ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছিলেন। সাব্বির বলেন, প্রতিবছর ১ হাজার টাকা করে ৪ হাজার টাকা ভাড়া বেড়েছে। বাড়িওয়ালা আগামী বছরও ১ হাজার টাকা বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছেন।
ব্যবসায়ী মো. আজমল হায়াত খান পরিবার নিয়ে বনানী ২ নম্বর সড়কের একটি বাসায় থাকেন। ২ হাজার ৬০০ বর্গফুটের বাসাটির মূল ভাড়া ৪০ হাজার টাকা। আজমল হায়াত গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার ভাড়া এক লাফে ৫ হাজার টাকা বাড়ানো হবে বলে জানানো হয়েছে। একবারে এত ভাড়া বাড়ানোটা কতটা যুক্তিযুক্ত জানি না। ভাড়াটের জন্য এটি বিশাল চাপ।’
বাড়িভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে বাড়িওয়ালারা নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, গৃহঋণের সুদ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ইত্যাদি যুক্তি দেখান। কল্যাণপুর এলাকার একজন বাড়িওয়ালা বলেন, ‘সবকিছুর দাম বাড়লে বাড়িভাড়া বাড়বে না কেন? বাড়িওয়ালা অন্যায্যভাবে ভাড়া বাড়াচ্ছেন এটা ঠিক না। বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখেই বাড়িভাড়া বাড়ানো হচ্ছে।’ তবে বাড়িভাড়া নির্ধারিত থাকলে সে হারেই ভাড়া নিতেন বলে তিনি দাবি করেন।
কেবল মাসিক ভাড়া নয়, অগ্রিম হিসেবেও কয়েক মাসের ভাড়া নিচ্ছেন বাড়ির মালিকেরা। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মানোয়ার রহমান কাঁঠালবাগানে গত মাসে তিন কক্ষের একটি বাসায় উঠেছেন। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে মাসিক ভাড়া ৩০ হাজার টাকা। আর অগ্রিম হিসেবে ৯০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
২৫ বছরেও আইনের প্রয়োগ নেই
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত অধ্যাদেশটি প্রথম জারি করা হয় ১৯৬৩ সালে। বর্তমানে প্রচলিত বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি ১৯৯১ সালের। কিন্তু সরকার এখনো এই আইনের বিধি করেনি।
* ২৫ বছরে ঢাকায় বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৩৮৮%
* আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই
* আদালতের নির্দেশ থাকলেও হয়নি বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ কমিশন
আইনে বলা হয়েছে, কোনো ভাড়াটের কাছে জামানত বা কোনো টাকা দাবি করতে পারবেন না বাড়িওয়ালা। এক মাসের বেশি অগ্রিম ভাড়া নেওয়া যাবে না। প্রতি মাসে ভাড়া নেওয়ার রসিদ দিতে হবে, নইলে বাড়িওয়ালা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দুই বছর পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো যাবে না। ভাড়াটেদের স্বার্থরক্ষায় এমন আরও অনেক কথাই উল্লেখ আছে এই আইনে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই।
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ কার্যকর করতে ২০১০ সালে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিল। রিট আবেদনের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, আইনটি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আদালতের মাধ্যমে ভাড়া-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির কথা আইনে বলা আছে।
হাইকোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি
এইচআরপিবির রিট আবেদনটির পরিপ্রেক্ষিতে রুল ও চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ১ জুলাই আদালত রায় দেন। রায়ে বলা হয়, বিদ্যমান আইনটি কার্যকর না হওয়ায় ভাড়াটেকে সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না। আইনটি কার্যকরে রাষ্ট্রকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে; অন্যথায় সাধারণ মানুষ এ থেকে পরিত্রাণ পাবে না।
রায়ে সারা দেশে এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বাড়িভাড়া নির্ধারণের জন্য সরকারকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। রায় ঘোষণার ছয় মাসের মধ্যে কমিশন গঠন করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু রায় ঘোষণার দেড় বছর পেরোলেও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠিত হয়নি।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম কমিশন গঠন হলে ভাড়াটেরা অর্থনৈতিকভাবে যে নিষ্পেষিত হচ্ছেন, তা বন্ধ হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেড় বছর হলেও রায়ের কপি পাইনি। আশা করছি সরকার দ্রুত একটি কমিশন করে ভাড়াটেদের স্বার্থ রক্ষা করবে।’
রায়ে আরও বলা হয়েছিল, কমিশনের সুপারিশ প্রতিবেদন আকারে আসার আগ পর্যন্ত সরকার আর্থিক সক্ষমতা সাপেক্ষে প্রতি ওয়ার্ডে ভাড়া নিয়ন্ত্রক (রেন্ট কন্ট্রোলার) নিয়োগের উদ্যোগ নেবে। সেই নির্দেশনাটিরও বাস্তবায়ন হয়নি।
ন্যায্য বাড়িভাড়ার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে বিভিন্ন সংগঠন। ভাড়াটেদের স্বার্থরক্ষা ও অধিকার আদায়ে ১০টি সংগঠন মিলে এ বছরের শুরুতে গঠন করে ‘বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া ফেডারেশন’। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাহারানে সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, বাড়িভাড়া নিয়ে দেশে যে অরাজকতা চলছে, রায় কার্যকর হলে তা বন্ধ হওয়ার আশা ছিল। কিন্তু দেড় বছরেও তা না হওয়ায় ভাড়াটেদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না।
তালিকায় কম, বাস্তবে বেশি
হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণের জন্য ২০০৮ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন ঢাকা মহানগরকে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করে সম্ভাব্য বাড়িভাড়ার তালিকা করেছে। তালিকা অনুযায়ী ধানমন্ডি এলাকায় মূল সড়কের পাশে বাড়িভাড়া বর্গফুটপ্রতি সর্বোচ্চ ১৩ টাকা। সে হিসাবে ১ হাজার বর্গফুটের একটি বাড়ির ভাড়া হওয়ার কথা ১৩ হাজার টাকা। ধানমন্ডি এলাকায় মূল সড়কের পাশে এই আয়তনের একটি বাসার ভাড়া ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।
সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত তালিকার বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মোস্তফা কামাল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের কোন সংস্থা বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের কাজটি করবে, তা আইনে বলা নেই।
উত্তরা এলাকায় মূল সড়কের পাশের ভবনে প্রতি বর্গফুটের সর্বোচ্চ ভাড়া ৯ টাকা এবং সড়কের ৩০০ ফুটের ভেতরে পর্যন্ত সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা। এই হারে উত্তরা এলাকায় বাসা ভাড়া পাওয়া প্রায় অকল্পনীয়।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেসবাহুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনের এই তালিকাটি হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণের জন্য। বাস্তবে বাড়িভাড়া এ তালিকার চেয়ে বেশি। সিটি করপোরেশন তালিকা পুনর্মূল্যায়নে কাজ করছে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের কি না, সে বিষয়ে তিনি অবগত নন।
উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে সড়কের পাশেই একটি বাসায় ভাড়া থাকেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জাকারিয়া হোসেন। তাঁর তিন কক্ষের বাসাটি আনুমানিক ১৪০০ বর্গফুটের। সিটি করপোরেশনের তালিকা অনুযায়ী বাসাটির ভাড়া হওয়ার কথা ১২ হাজার ৬০০ টাকা। জাকারিয়া বলেন, বাসার মূল ভাড়া ২৫ হাজার টাকা। ইউটিলিটি চার্জসহ ৩০ হাজার টাকা পড়ে। এ বছর বাড়িওয়ালা ২ হাজার টাকা ভাড়া বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন।
জাকারিয়া হোসেন বলেন, ‘প্রতিবছরই বাড়িওয়ালাদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ছে। আমরা ভাড়াটেরা নিরুপায়। নতুন বছর এলেই ভাড়া নিয়ে এই নৈরাজ্য শুরু হয়। ভাড়াটেদের স্বার্থ দেখার মতো এ দেশে কেউ নেই।’
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1049901/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BF%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%A8%E0%A7%88%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%