৩১ ডিসেম্বর ২০১৬, শনিবার, ২:২৮

ক্রমেই সক্ষমতা হারাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর: পণ্য খালাসে ঘাটে ঘাটে অপেক্ষা

কনটেইনারবাহী জাহাজগুলোকে এখন গড়ে প্রায় চার দিন গভীর সাগরে অবস্থান করতে হচ্ছে। কনটেইনারভর্তি পণ্য নিয়ে দিনে গড়ে ১০টি জাহাজ বহির্নোঙরে অপেক্ষায় থাকছে। পণ্য খালাসের জন্য কখন বন্দরের জেটি খালি পাওয়া যাবে, মূলত এর জন্যই অপেক্ষা। টানা সাত মাসের (মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত) বেশি সময় ধরে এ অবস্থা চলছে।
২০০৬ সালের পর গত এক দশকে জেটিতে ভেড়ার জন্য কোনো জাহাজকে সাগরে এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়নি। তবে গত বছরে জেটিতে ভিড়তে কনটেইনারবাহী একটি জাহাজকে গড়ে ৩২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। ২০১৪ সালে তা ছিল প্রায় ১৪ ঘণ্টা, ২০১৩ সালে ছিল প্রায় ১৫ ঘণ্টা। এসব তথ্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন প্রতিবছর বাড়লেও বন্দরের সুবিধা বাড়েনি। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর সক্ষমতা হারাচ্ছে।
বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকার সময় ২০০৬ সালের শেষ দিকে টানা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের সেবার মানে বড় ধরনের অবনতি হয়। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর থেকে ২০০৭ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত বন্দরের কার্যক্রম কখনো সাময়িক, কখনো পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ২০০৬ সালে কনটেইনারবাহী প্রতিটি জাহাজকে জেটিতে ভেড়ানোর জন্য গড়ে প্রায় চার দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। পরে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। ২০০৭ সালে জাহাজের অপেক্ষার সময় কমে আসে প্রায় দুই দিনে। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে তা ছিল গড়ে ১১ ঘণ্টা। ২০১০ সালে শ্রমিক অসন্তোষসহ জেটি পরিচালনা সাময়িকভাবে বন্দরের হাতে গেলে আবারও পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়। ওই বছর জাহাজের গড় অপেক্ষার সময় ছিল ৩৪ ঘণ্টা। এরপর ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১৫ ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। ২০১৫ সালে আবার অবনতি হতে থাকে, এ সময় অপেক্ষার সময় দাঁড়ায় প্রায় ৩২ ঘণ্টা।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর জেটিতে জাহাজ ভিড়তে পারলেও বন্দর চত্বর থেকে নির্ধারিত সময়ে পণ্য খালাস হয় না। কারণ, কনটেইনার খালাসের জন্য চাহিদার তুলনায় প্রয়োজনীয় যন্ত্র (ক্রেন) সরবরাহ করতে পারছে না বন্দর কর্তৃপক্ষ। গত ১১ মাসে বন্দর চত্বর থেকে পণ্য খালাসের জন্য চাহিদার তুলনায় ৫২ শতাংশ যন্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে। এ তথ্য বন্দরের।
এদিকে বন্দর চত্বরে কনটেইনারে পণ্য রাখার ভাড়া গত মঙ্গলবার থেকে দ্বিগুণ করা হয়েছে। জাহাজ থেকে নামানোর পর একটি কনটেইনার বিনা ভাড়ায় চার দিন রাখা যায়। ২০ ফুট লম্বা কনটেইনারের জন্য প্রতিদিন ছয় ডলার করে (সাত দিন পর্যন্ত) বন্দরকে ভাড়া দিতে হয় আমদানিকারককে। এই ভাড়া এখন ১২ ডলার করে দিতে হবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের মুখপাত্র নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ীরা কনটেইনার খালাস না করায় বন্দরের পরিচালন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে কনটেইনার রাখার ভাড়া দ্বিগুণ করা হয়েছে। বন্দর জেটিতে ভিড়তে জাহাজের দীর্ঘ অপেক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, দুই ঈদ এবং গত সেপ্টেম্বর মাসে চার দিন কনটেইনারবাহী ট্রেইলার ধর্মঘটের প্রভাবে জাহাজ ও কনটেইনার-জট হয়েছে। এখন ভাড়া দ্বিগুণ করার কারণে ব্যবসায়ীরা কনটেইনার দ্রুত খালাস করলে এ সংকট কেটে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানো ও ওঠানোর জন্য ১৩টি জেটি রয়েছে। এ ছাড়া আরও ছয়টি জেটি কনটেইনারবিহীন পণ্যবাহী জাহাজের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। গত নভেম্বর মাসে বন্দরের পরিবহন বিভাগ থেকে প্রকৌশল বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কনটেইনার পরিবহন বাড়তে থাকায় প্রতিবছর ন্যূনতম দুটি জেটি নির্মাণ করা জরুরি। এ ছাড়া বছরে আট হাজার একক কনটেইনার রাখার জন্য আরও একটি চত্বর নির্মাণ করা দরকার। নতুন জেটি নির্মাণ করা না হলে বন্দরকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলে চিঠিতে জানানো হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বশেষ জেটি নির্মাণ করা হয় ২০০৭ সালে। এরপর সমুদ্রগামী জাহাজ ভেড়ানোর জন্য আর কোনো জেটি নির্মাণ করা হয়নি। নতুন কোনো জেটি নির্মাণের কাজও শুরু হয়নি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর পর্ষদের সাবেক সদস্য হাদী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত নয় বছরের মধ্যে অন্তত দুটি জেটি নির্মাণ করা গেলে এখনই এত ভয়াবহ সংকটে পড়তে হতো না। একটি জেটি নির্মাণে অন্তত তিন বছর সময় লাগে। যেহেতু তিন বছরের মধ্যে বন্দরে নতুন কোনো জেটি হচ্ছে না, সে কারণে সামনে সংকট শুধু বাড়বে।
সমুদ্রপথে কনটেইনারে পণ্য আমদানি-রপ্তানির ৯৮ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবহন করা হয়। বাকি ২ শতাংশ হয় মোংলা বন্দর দিয়ে। এ হিসাবে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে বিকল্প না থাকায় ব্যবসায়ীদের বন্দরের ওপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই। সময় বেশি লাগলে বা খরচ বেশি হলেও কার্যত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই পণ্য পরিবহন করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরের পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা বাড়ানোর দরকার ছিল আরও বহু আগে। কিন্তু বাণিজ্য বাড়লেও সে অনুযায়ী জেটি, যন্ত্রপাতি ও ইয়ার্ড যোগ না হওয়ায় এখন ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি বেড়েছে। বন্দরে পণ্য পরিবহনে এখন যে অবস্থা, তাতে ভবিষ্যতে
পণ্য পরিবহনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এর ফলে যে খরচ বাড়ছে, তা ভোক্তার ওপরই পড়বে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ২১ লাখ ৩৮ হাজার কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়েছে।
বছর শেষে এ সংখ্যা ২৩ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। বন্দরের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহার করে বছরে ২১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ একক কনটেইনার পরিবহনের স্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে বন্দরের। স্বাভাবিক এই ক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে গত অর্থবছরেই। কনটেইনার পরিবহন যত বাড়ছে, ততই বন্দরের সেবা পেতে ভোগান্তি পেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কনটেইনার পরিবহনের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রথমত খুব দ্রুত চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালের গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা দরকার। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরে যেসব টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা আছে, সেগুলো থেকে অন্তত একটি টার্মিনাল বেছে নিয়ে দ্রুত নির্মাণকাজ শুরু করা উচিত।
এদিকে সমুদ্রপথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশমুখী কনটেইনারের পণ্য পরিবহনের ভাড়া বাড়াচ্ছে বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে এমসিসি ট্রান্সপোর্ট সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড ১২ ডিসেম্বর এক বিজ্ঞপ্তিতে গ্রাহকদের বলেছে, আগামী বছরের ২ জানুয়ারি থেকে এশিয়ার দেশগুলো থেকে বাংলাদেশমুখী সব ধরনের আমদানি পণ্যের কনটেইনারে ১০০ ডলার বা প্রায় ৭ হাজার ৮০০ টাকা সারচার্জ (বাড়তি ভাড়া) আরোপ করা হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজজটের কারণে বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলো সারচার্জ আরোপ করা শুরু করেছে বলে জানান পণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান তারা ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থাপনা অংশীদার মেজবাহ উদ্দিন। অবশ্য এমসিসি ট্রান্সপোর্টের এ দেশীয় প্রতিনিধিরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজজটের সঙ্গে ওই সারচার্জ আরোপের কোনো সম্পর্ক নেই।
জাহাজজটের সঙ্গে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়ার সম্পর্ক কী, জানতে চাইলে বাংলাদেশ কনটেইনার শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন আহমেদ সাহেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কনটেইনারবাহী জাহাজ জেটিতে ভিড়তে এখন চার থেকে পাঁচ দিন সময় লাগছে। এতে প্রতিটি জাহাজের ৪০ থেকে ৫০ হাজার ডলার বাড়তি খরচ হচ্ছে। এই খরচ পুষিয়ে নিতে বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলো ভাড়া বাড়াচ্ছে।
কনটেইনারে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় পোশাকশিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ। পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বন্দরের সেবা নিয়ে নানা সমস্যা মোকাবিলা করছেন তাঁরা। এর কোনো সমাধান হচ্ছে না। বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো, যন্ত্রপাতি সংযোজন, জেটি নির্মাণ—এসব কাজ এগোচ্ছে না। কাঁচামাল দ্রুত হাতে না পাওয়ায় উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে। বন্দরের সেবাব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি না হলে পোশাকশিল্প খাত বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হারাবে। তখন বিদেশি ক্রেতারা বিকল্প খুঁজে নেবে।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1049859/%E0%A6%AA%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%87-%E0%A6%98%E0%A6%BE%E0%A6%9F%E0%A7%87-%E0%A6%98%E0%A6%BE%E0%A6%9F%E0%A7%87-%E0%A6%85%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE