১ জানুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ২:০৩

সালাহউদ্দিন বাবর

গণতন্ত্রের বিপদ: দেখা অদেখা

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) এবারের নির্বাচন কি গণতন্ত্রের বিপদ থেকে উত্তরণের আভাস? নাকি সাময়িক উপশম? ভবিষ্যৎ তা বলতে পারে। তবে জেলা পরিষদের যে নির্বাচন হয়ে গেল, তা কিন্তু গোটা জাতিকে হতাশ করেছে। নাসিক নির্বাচনে যে আলোর ঝলক দেখা গিয়েছিল, জেলা পরিষদের নির্বাচনে সেই আলোর ঝলকানি আরো উজ্জ্বল তো হয়নি, বরং ম্লান হয়ে গেছে।
জেলা পরিষদের নির্বাচন ছিল একদলীয়। আরো লক্ষণীয় হলো, যারা প্রার্থী এবং যারা ভোটার তারা সবাই একই দলের। জেলা পরিষদের নির্বাচন পরোক্ষ নির্বাচন এবং নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্যরাই এখানে ভোটার। আর নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্যরা বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। এই প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন। আগে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন হতো নির্দলীয়ভাবে। কিন্তু এবার তা হয়েছে দলীয়ভাবে। উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরাই বিজয়ী হয়েছেন। এসব নির্বাচনের কোনোটিই অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা ভোট ছিনতাই, কেন্দ্র দখল, জাল ভোট এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিজয়ী হয়েছিলেন। তারাই এখন নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে ভোট দিয়েছেন। যেহেতু নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্যরা সবাই ক্ষমতাসীন দলের, তাই অন্য কোনো দল এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়াকে তারা অনর্থক মনে করেছেন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ায় সবাই আশা করেছিল, জেলা পরিষদের নির্বাচনও ভালো হবে। তা ছাড়া জেলা পরিষদের প্রার্থী ও ভোটার একই বলয়ের লোক, তাই এখানে কোনো অনিয়ম হবে না বলেই ধরে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। লক্ষ করা গেছে এবং সংবাদপত্রের রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে যে, ভোট কেনাবেচা হয়েছে, ব্যাপকভাবে টাকা ছড়াছড়ি হয়েছে, ভোটারদের ভূরিভোজে আপ্যায়ন করা হয়েছে। সাংবাদিকেরা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে টাকা-পয়সার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জেলা পরিষদের নির্বাচনে টাকা ছড়ানোর যে অভিযোগ উঠেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।’ নির্বাচনে টাকা চালাচালি এক বড় অনিয়ম। ৬১টি জেলা পরিষদের মধ্যে ২১টি জেলায় চেয়ারম্যান বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। স্থানীয় এমপিদের এলাকা থেকে চলে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ও নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সে নির্দেশ অমান্য করে এমপিরা নির্বাচনে প্রচারকাজে অংশ নিয়েছেন প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে। তারা নির্বাচনে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে ভূমিকা রেখেছেন। এ ছাড়া নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি গুলিবর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। নাসিক নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশন কিছুটা তৃপ্তিবোধ করছিল। কিন্তু জেলা পরিষদের নির্বাচন ছিল কমিশনের মেয়াদকালের শেষ নির্বাচন। অথচ এটাও সুষ্ঠুভাবে হয়নি। এই কমিশনের অধীনে প্রথম ও শেষ নির্বাচনের কোনোটিই সুষ্ঠু হয়নি। তাই বলা যায়, এই কমিশন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
আমরা নাসিক নির্বাচনেই ফিরে আসি। নির্বাচনে তিনটি পক্ষ থাকে, এ নির্বাচনে পক্ষ ছিল সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দল তথা বিএনপি। নাসিক নির্বাচনে প্রথম পক্ষ তথা সরকার, যে কারণেই হোক নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করার চেষ্টা করেছে। আর তাতেই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি দ্বিতীয় পক্ষ। দলটি নির্বাচনে কোনো অনিয়ম করেনি, তাদের কোনো নেতিবাচক ভূমিকা ছিল না। তৃতীয় পক্ষ নির্বাচন কমিশন, তারা মূলত কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন গেয়েছে। এ নির্বাচনে তাদের আসলে কোনো ভূমিকা ছিল না। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার প্রেক্ষাপটে তারা কোনো কৃতিত্ব দাবি করতে পারে না। নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। গণতন্ত্রের ওপর দিয়ে বহু আপদ-বিপদ গেছে। ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশালব্যবস্থা ছিল গতন্ত্রের ওপর প্রথম আঘাত। শুধু আঘাত নয়, ভয়ঙ্কর আঘাত। এর পর দুই দফা সামরিক শাসন। গণতন্ত্র আর সামরিক শাসন পরস্পর দুই মেরুতে। এক দফা ফকরুদ্দীন-মইন উদ্দিনের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদের একদলীয় নির্বাচন। আর তা ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন। নির্বাচনের নামে সেটা হয়েছে প্রহসন। এসব নির্বাচনের আগে ও পরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন। সেসব নির্বাচনের কোনোটিই অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। এসব নির্বাচন প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের জন্য ছিল বিপজ্জনক। গণতন্ত্রের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হলো, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এই নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী মাসে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন কমিশন নিজেদের উদ্যোগে শক্ত অবস্থান নিয়ে নাসিক নির্বাচন সুষ্ঠু করেছেÑ এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি প্রার্থী এবং ভোটারদের সহযোগিতায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ক্ষমতাসীনেরাই বরাবর নির্বাচনকে কলুষিত করার চেষ্টা করেন। নির্বাচনে যত অনিয়ম-অপকর্ম হয়ে থাকে, তা ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেই হয়। এবার তারা সেটা করেননি। কোনো হস্তক্ষেপ তাদের ছিল না। এটা প্রশংসার দাবি রাখে।
২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে যে নির্বাচন হয়েছিল এবং এর আগে ও পরে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব নির্বাচন হয়েছে, তার কোনোটিই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়নি। কারচুপি, ভোট ছিনতাই, কেন্দ্র্র দখলসহ বহু অনিয়ম সেসব নির্বাচনে হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের সদিচ্ছা ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আগামী নির্বাচনগুলোতে সরকারের ভূমিকা কী হয়, সেটাই দেখার বিষয়। সরকারি দলের এসব অনিয়মের জন্যই নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি উঠেছিল। এই নির্বাচনের পর এ কথা বলা যাবে না যে, ভবিষ্যতে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে অথবা গণতন্ত্র বিপদমুক্ত হয়েছে। গণতন্ত্র আর জনমত অবাধে প্রকাশ করার সুযোগ পরস্পর পরিপূরক। যেখানে জনগণের মতপ্রকাশের অবাধ সুযোগ থাকে না, সেখানে গণতন্ত্র ভঙ্গুর। এ পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র বিপদগ্রস্ত হয়ে থাকে। গণতন্ত্রের ভাষা, গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার, গণতান্ত্রিক আচরণ, সহিষ্ণুতা, জবাবদিহিতাÑ এসব যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকে না। গণতন্ত্রের চর্চা ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য আমাদের দেশে নেই। তাই এ কথা বলা যাবে না যে, গণতন্ত্র বিপদমুক্ত হয়ে গেছে। এই অবস্থা বিরাজ করতে থাকলে ভবিষ্যতের জন্যও আশাবাদী হওয়া যায় না।
গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদ। কিন্তু জাতীয় সংসদ বর্জন, একতরফা নির্বাচন, এসব কারণে জাতীয় সংসদ বলতে গেলে অকার্যকর। এখন তো সংসদ একদলীয় হয়ে আছে। সংসদের মূল ভূমিকা পালন হচ্ছে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের জবাবদিহিতা একটি বড় বিষয়। যেহেতু সংসদে কেবল এক দলের, অর্থাৎ ক্ষমতাসীনেরা সংসদে একা; তাই জবাবদিহিতা আর কী হবে? সরকারের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করার আর কোনো জায়গা নেই। রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে, বাংলাদেশে দুর্নীতির কী হাল, এর পরিণতি কী হবে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুর্নীতির সোপানে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়, তা দেখবে কে? গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে ভাষা প্রয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গণতান্ত্রিক অঙ্গনে যে ভাষা এখন প্রয়োগ হচ্ছে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে যা বলা হচ্ছে, তা প্রতিপক্ষের প্রতি অসম্মানজনক ও কটাক্ষপূর্ণ। এমন ভাষা প্রয়োগের কারণে পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি হয়। কথায় কথায় এমন সব বিশেষণ প্রয়োগ লক্ষ করা যায়, যা প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান তো নয়ই, বরং তারা অসম্মানিত এবং তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার কথা। এটা রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিবেশকে কলুষিত করে থাকে। এটা সৌজন্য, সহমর্মিতা ও সহ-অবস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের কোনো ঐতিহ্য আমরা তৈরি করতে পারিনি। অথচ পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি, সৌজন্যবোধ জাগ্রত করার ক্ষেত্রে শিষ্টাচার বড় ভূমিকা রাখে। ক্ষমতাসীন ও তার প্রতিপক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক ইস্যু তথা জনগণের কল্যাণ নিয়ে দ্বিমত ও প্রতিযোগিতা থাকতে পারে, কিন্তু বাইরে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় থাকা অপরিহার্য। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে এই শিষ্টাচার সব সময়ই লক্ষ করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিতর্কিত ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচনের পর পরাজিত প্রার্থী হিলারি সাথে সাথে নিজের পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান। প্রেসিডেন্ট ওবামা নির্বাচনের পর বলেছেন, ‘ট্রাম্পকে আমাদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন।’ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে জন্মের পর থেকে পরস্পর বৈরী সম্পর্ক। কিন্তু সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের জন্মদিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এই সৌজন্য আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেই। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সহিষ্ণুতার অভাব প্রচণ্ড। ক্ষমতাসীনেরা অন্য দলগুলোর প্রতি সহিষ্ণুতা ও সৌজন্য কিছুই দেখায় না। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে যে, রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং হতাহতের ঘটনা ঘটে। ছাত্ররাজনীতিতে এমন সংঘর্ষ প্রায়ই সংঘটিত হয়। সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয়, সংগঠনগুলোর নিজেদের মধ্যেও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়ে থাকে। এতে অহরহ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বিবদমান সংগঠনগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে মামলাও করে থাকে। ফলে পরস্পরের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়। একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য এসব আচরণ সত্যিই অত্যন্ত ক্ষতিকর।
জেলা পরিষদ নির্বাচনের পর দেশের কেন্দ্রীয় সরকার এবং সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এখন আওয়ামী লীগের কব্জায়। এক দলের হাতে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো চলে গেলে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি সৃষ্টি হয়ে থাকে। ক্ষমতাসীনদের আর কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না তখন। ক্ষমতা এক হাতে পুঞ্জীভূত হলে ক্ষমতাসীনেরা স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। ক্ষমতা এক কেন্দ্রে চলে আসা যদি জনসমর্থনের মাধ্যমে হয়ে থাকত, তবুও না হয় একটা কথা ছিল। কিন্তু তা তো সেভাবে হয়নি। যেসব নির্বাচনের মাধ্যমে এক কেন্দ্রে ক্ষমতা জমা হয়েছে, সে নির্বাচনগুলোর কোনোটিই সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ ছিল না। এর অর্থ দাঁড়ায়, জনমতের ভিত্তিতে এখন ক্ষমতার চর্চা হচ্ছে না। এটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। আর তা গণতন্ত্রের ভঙ্গুরতার একটি বড় উদাহরণ।
বাংলাদেশের সব শ্রেণীর মানুষ গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। গণতন্ত্রের প্রাণতুল্য নির্বাচনকে তারা উৎসব হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের যত আন্দোলন হয়েছে, তার প্রতিটিতে লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, পৃথিবীর কম দেশেই এমনটি দেখা যায়। একনায়কের শাসন এবং স্বৈরাচারী সরকারপ্রথার বিরুদ্ধে যত আন্দোলন এখানে হয়েছে, তার প্রতিটিতে দেশের লাখ লাখ সাধারণ মানুষ অংশ নিয়ে তাকে সফল করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, জনতার এই আত্মত্যাগের প্রতি দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনোই আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল থাকেনি। ক্ষমতায় গিয়ে তারা অতীতের মতো সেই একই কায়দায় অগণতান্ত্রিক পথে চলেছে। জনগণ প্রতারিত হয়েছে। দেশে অপশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সম্প্রতি একটি কথা ব্যাপকভাবে শোনা যাচ্ছে, ‘দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে।’ এ ব্যাপারে নানা উদাহরণ তুলে ধরা হচ্ছে। অবশ্যই এটা আশাবাদ ও খুশির বিষয়। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে, হতদরিদ্র মানুষ দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে, জীবনমান উন্নত হবে, মানুষ স্বাস্থ্য শিক্ষার সুযোগ পাবেÑ এসব সুখের বিষয় সন্দেহ নেই। কিন্তু উন্নয়নের কথা যত শোনা যায়, ঠিক ততটাই কম শোনা যায় গণতন্ত্রের কথা। উন্নয়ন না গণতন্ত্র কোনটা প্রথম? এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, একটি সুস্থ সমাজের জন্য উভয় স্লোগানই পাশাপাশি উচ্চারিত হতে হবে। গণতন্ত্র না থাকলে উন্নয়ন পরিপূর্ণ নয়, আবার উন্নয়ন না হলে গণতন্ত্র ফলপ্রসূ হয় না। দুটোকেই পাশাপাশি চলতে হবে।
উন্নয়নের সাথে অর্থের এবং অর্থের সাথে দুর্নীতি সম্পর্কযুক্ত। গণতন্ত্রের একটি অর্থ, জবাবদিহিতা। যে সমাজে গণতন্ত্র নেই, সেখানে জবাবদিহিতা নেই। জবাবদিহিতার অনুপস্থিতির অর্থ দুর্নীতির প্রসার ঘটা। বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপদগ্রস্ত বিধায় এখানে দুর্নীতির প্রসার ঘটেছে বেশি। দেশী ও বিদেশী সংস্থাগুলো বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম প্রধান হচ্ছে বাংলাদেশ। দুর্নীতি নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের কর্মী-সমর্থকেরাই সব সময় দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকে। দেখা যায়, একটি দল ক্ষমতার বাইরে গেলেই তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে এবং কোর্ট-কাচারি হয়ে থাকে। এই রেওয়াজ হামেশাই। দুর্নীতির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সব পর্যায়ে জবাবদিহিতা প্রয়োজন। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা উন্নয়ন সহযোগী ও ঠিকাদার শ্রেণীর দুর্নীতি রোধের জন্য জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য, যা এখন নেই।
গণতন্ত্রের সুফল পেতে হলে আইনের শাসন অপরিহার্য। যেখানে মানুষ বঞ্চিত হবে, সেখানেই আইনের আশ্রয় নেয়ার প্রয়োজন হয়। আইনের শাসন যদি সহজ না হয় এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত না থাকে; তবে জনগণ সর্বত্র প্রতারিত হয় এবং বিচারপ্রার্থী হতে পারবে না। আর এ জন্য বিচারব্যবস্থা অবশ্যই স্বাধীন ও বন্ধনমুক্ত হতে হবে। প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এখনো দেশে নিশ্চিত হয়নি। বিচার বিভাগ থেকে এ অভিযোগ অহরহ উচ্চারিত হয়ে থাকে, যা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে আছে।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অবশ্যপ্রয়োজনীয় বিষয়। এটা কোনো তত্ত্ব নয়, বাস্তবতা। মতপ্রকাশের সুযোগ না থাকলে এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে গণতন্ত্র পরিপূর্ণ ও বিকশিত হতে পারে না। প্রতিটি রাজনৈতিক এবং ক্ষমতাসীন শাসক কর্তৃপক্ষকে এটা উপলব্ধি ও অনুশীলন করতে হবে।
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/183700