২ জানুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ১:৪৭

রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান

সীমান্ত চৌকিতে হামলাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চালানো ভয়াবহ অত্যাচার-নির্যাতন বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় রোহিঙ্গাদের ওপর এভাবে দমন-পীড়ন অনেককেই অবাক করেছে।


দীর্ঘ দিনের সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসা সু চি সরকারকে সময় দেয়ার জন্য পশ্চিমা দেশগুলো প্রথম দিকে নীরব ভূমিকা পালন করেছিল। তবে মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ সীমা ছাড়িয়ে গেলে এর বিরুদ্ধে মালয়েশিয়া তীব্রভাবে প্রতিবাদ জানায়। এরপর ইন্দোনেশিয়ার উদ্যোগে ইয়াঙ্গুনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আশিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে সু চির বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে সু চি রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পাঠানোর অনুমোদন দেন। এ ছাড়া রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু নিয়ে কথা বলতে বাংলাদেশে বিশেষ দূত পাঠাতে সম্মত হন তিনি।


ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি ইয়াঙ্গুন থেকে ঢাকায় এসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সাথে টেকনাফের কুতুপালংয়ে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু ক্যাম্প এবং অপর একটি অনিবন্ধিত শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। তিনি মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেন, তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শুনেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করে তিনি স্বীকার করেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের উৎসে, অর্থাৎ মিয়ানমারেই সমাধান করতে হবে। এ জন্য রাখাইন রাজ্যের উন্নয়নে মিয়ানমার সরকারের সব ধরনের প্রচেষ্টাকে সমর্থন দেয়ার জন্য আঞ্চলিক নেতা ও অন্যান্য অংশীদারের প্রতি আহ্বান জানান মারসুদি।


গত ৯ অক্টোবর রাখাইনে তিনটি সীমান্ত চৌকিতে চালানো হামলায় ৯ জন সীমান্তরক্ষী নিহত ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ লুট হয়। এর পর থেকে জঙ্গি দমনের নামে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক অভিযান শুরু হয়। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চালিয়ে রোহিঙ্গাদের ঘরছাড়া করা হয়। সহিংসতায় ৮৬ জনের মৃত্যুর খবর স্বীকার করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে নিহতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। বাংলাদেশের হিসাবে তা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমারের বনে-জঙ্গলে পালিয়েছে।


এ দিকে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ভারে ইতোমধ্যে জর্জরিত বাংলাদেশ আর নতুন করে শরণার্থী নেয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী ছিল না। টেকনাফের নিবন্ধিত দুই উদ্বাস্তু ক্যাম্পে ৩৩ হাজার এবং দেশে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে বলে সরকারের ধারণা। তাই মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সাম্প্রতিক দমন-পীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গাদের বাধা দেয়ার জন্য সীমান্তরক্ষীদের নির্দেশ দেয় সরকার। ফলে রোহিঙ্গা বোঝাই বেশ কিছু নৌকা নাফ নদীর মাঝপথ থেকেই ফিরিয়ে দেয়া হয়।
মিয়ানমার পরিকল্পিতভাবে রাখাইন প্রদেশ থেকে মুসলিম রোহিঙ্গাদের নির্মূল করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। তারা বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন এলাকা থেকে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী মার্মা, ¤্রাে ও খুমি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে উত্তর রাখাইনের মুসলিম রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে পুনর্বাসন করছে। এগুলো সীমান্তসংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘নাটাল’ এলাকা হিসেবে পরিচিত। নাটালে বসতি গড়লে নগদ অর্থ ছাড়াও ৩০ একর জমি ও তিন বছরের মধ্যে নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। মিয়ানমারের বিভিন্ন কারাগার থেকে অন্তত ১৫ হাজার মানুষকে এসব এলাকায় বসতি গড়ার শর্তে মুক্তি দেয়া হয়েছে। মিয়ানমার সরকারের সাথে হাতমিলিয়ে রাখাইনের মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষও নাটালের সুবিধা নিচ্ছে। তারা হেডম্যান হিসেবে পরিচিত। রাখাইনে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি, গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং প্রয়োজনের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখে ধুলো দেয়ার জন্য সুদূরপ্রসারী এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।


আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে গত ৩ ও ৪ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ডেনমার্ক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাতিসঙ্ঘ সংস্থার প্রতিনিধিদের উত্তর রাখাইন পরিদর্শনে নিয়ে যায় মিয়ানমার সরকার। কিন্তু সে সময় পরিকল্পিতভাবে তাদের কেবল নাটাল এলাকাগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাভাবিক কারণেই এসব এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর দমন-পীড়নের কোনো চিহ্ন নেই। নাটাল এলাকা পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধিদলটি ফিরে আসার সময় হঠাৎ করেই পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা জঙ্গল থেকে বের হয়ে এসে তাদের প্রাণ বাঁচানোর আকুতি জানায়। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এ সময় কয়েকজনকে আটক করে। কিন্তু মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়ক রেনেটা লক ডেসালিয়ান (এক সময় বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করেছেন) এর প্রতিবাদ জানান এবং আটককৃতদের ছেড়ে না দিলে পরিদর্শন অসমাপ্ত রেখেই রাজধানী নেপিডোতে ফিরে যাওয়ার হুমকি দেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আটককৃত রোহিঙ্গাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
রাখাইন এলাকা পরিদর্শন শেষে মিয়ানমারে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়ে প্রতিনিধিদলটি অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার চিত্র বা ভিকটিমদের সাথে কথা বলার সরাসরি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে পারেননি। জাতিসঙ্ঘের আবাসিক প্রতিনিধি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের একটি স্বাধীন, বিশ্বাসযোগ্য ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এরপর রাখাইনে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চালানো দমন-পীড়ন, হত্যা, ধর্ষণের অভিযোগ তদন্তে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চির উদ্যোগে একটি তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের দফতর রাখাইনে সীমান্ত চৌকিতে হামলার প্রেক্ষাপট, পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে নেয়া পদক্ষেপ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান নিয়ে অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু কমিশনের প্রধান করা হয় মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেনারেল (অব:) মিন্ট সিউকে, যিনি সাবেক সামরিক জান্তা সরকারের সহযোগী ও সেনা গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে আগে থেকেই বিতর্কিত ছিলেন। তাই কমিশনের প্রতিবেদন ‘আইওয়াশ’ হবে বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ধারণা ছিল। বাস্তবে হয়েছেও তাই।
রাখাইন রাজ্য সরেজমিন পরিদর্শন শেষে গত ১৪ ডিসেম্বর দেয়া প্রাথমিক প্রতিবেদনে মিয়ানমার সরকার গঠিত তদন্ত কমিশন বলেছে, আইন মেনেই নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করছে। সীমান্ত চৌকিতে হামলার প্রতিক্রিয়ায় সরকারি কর্তৃপক্ষ আইনানুগ পদক্ষেপ নিয়েছে। সেখানে সেনাবাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
এর কয়েক দিন পর জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রা’দ আল হুসেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন ও জালিয়াতি’ অ্যাখ্যা দিলেও সেখানে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের প্রবেশের আবেদন ধারাবাহিকভাবে খারিজ করছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এটি নির্যাতিতদের জন্য অপমানজনক এবং আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চল পরিদর্শনে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনের আবেদন এখনো গৃহীত না হওয়ায় তীব্র হতাশা ব্যক্ত করেন হাইকমিশনার। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের যদি লুকানোর কিছু না থাকে, তাহলে কেন তারা সেখানে পর্যবেক্ষকদের যেতে বাধা দিচ্ছে? তিনি বলেছেন, অনুমতি দেয়ার এই ধারাবাহিক ব্যর্থতায় আমাদের শঙ্কা, সেখানে ভয়াবহ কিছু হয়ে থাকতে পারে।
মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চিকে বিরোধপূর্ণ উত্তর রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনের আহ্বান জানানোর সপ্তাহখানেক পর গতকাল রোববার এক বিবৃতিতে তিনি এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/183557

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/183557