১৪ জুলাই ২০২৪, রবিবার, ৬:২৩

ইআরএফের সেমিনারে ড. আহসান এইচ মনসুর

দেশে টাকাও নেই ডলারও নেই, থালাবাটি বেচে কোরমা পোলাও খাচ্ছে ব্যাংক

ঋণ আদায় না করে ঋণের সুদকে আয় দেখিয়ে মুনাফা দেখাচ্ছে ব্যাংক। সেই মুনাফার অর্থ থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে। সরকারকে ট্যাক্সও দিচ্ছে। আসলে কোনো আয়ই হয়নি, আমানতের অর্থ লুটে খাচ্ছে। ঘরের থালাবাটি বেচে কোরমা পোলাও খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এভাবে আর কতদিন চলতে পারবে? আমানত শেষ হবে, গ্রাহকের অর্থ আর ফেরত দিতে পারবে না। অপর দিকে আার্থিক দুরবস্থার কারণে দিন দিন বাংলাদেশ ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে। এমনকি ধীরে ধীরে ঋণ পাওয়ার সক্ষমতাও কমছে। অন্য দিকে বাজেট বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় করতে পারছে না সরকার। এখন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকাও নেই ডলারও নেই। কিভাবে বাস্তবায়ন হবে। তাই দেশের আর্থিক খাতের সঙ্কট মোকাবেলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো বিকল্প নেই।

দেশের ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা ও সার্বিক অর্থনৈতিক চিত্র তুলে ধরে এমনই হতাশাজনক মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। গতকাল বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার কারণ শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি এ কথাগুলো বলেন। সেমিনারটি আয়োজন করে দেশের অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)।

সেমিনারে আহসান এইচ মনসুর বলেন, পর্যাপ্ত ডলার না থাকার কারণে জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। যদি স্বাস্থ্য ভালো না থাকে তাহলে ভার বহন করা যায় না। ব্যাংক খাতের দুর্বলতার কারণে এখন ব্যাংক ব্যক্তি খাতকেও ঋণ দিতে পারছে না আবার সরকারকেও ঋণ দিতে পারছে না। এখন ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। এ বছর যদি বাড়ে তাহলে সেটা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হতে পারে। সেই হিসাবে এ বছর আমানত আসবে এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো। নতুন অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ছে তা কিভাবে দিবে ব্যাংক? সরকার এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলে ব্যক্তি খাত টাকা কোথায় পাবে। কিন্তু বাজেটে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ২৭ শতাংশ। কিন্তু এ পর্যন্ত ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘুরাফেরা করছে। যদি ব্যাংক খাতের আমানতের প্রবৃদ্ধি না বাড়ে আবার সরকারকে ঋণ দিতে হয় তাহলে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কিভাবে অর্জন হবে। তিনি আরো বলেন, নির্বাচনের আগে বলা হয়েছিল আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার আনা হবে। কিন্তু ছয় মাস পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্তু কিছুই হয়নি। এটা খুবই হতাশাজনক। দেশের স্বার্থেই এখন ব্যাংক খাতের সংস্কার খুবই জরুরি। আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে সেটা ভালো। কিন্তু নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সংস্কার দরকার। আমরা তো আমানত খেয়ে ফেলেছি। এভাবে ব্যাংক কতদিন চলবে? ব্যাংক খাত নিয়ে স্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার। সেটা করতে হবে সরকারকেই। বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে নয়। ব্যাংক খাতে আজকে যে এই অবস্থা হলো তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।

তিনি বলেন, আমানতের অর্থ লুটে খাচ্ছে কয়েকটি গোষ্ঠী। সরকারের সহযোগিতায় তারা পুষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের কারণেই এখন আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। আর্থিক খাতের ক্লিনিং করতে হবে জানিয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো সমাধান না করে জিইয়ে রাখছে। অর্থাৎ ঘরের দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা ঝাড়ু দিয়ে কার্পেটের নিচে রেখে দিচ্ছে। এতে করে কি আসলে দুর্গন্ধ দূর হবে? না, এটা আবার দুর্গন্ধ ছড়াবে। ব্যাংককে মন্দ ঋণ, অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ পাচার লুকিয়ে এ খাতের সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। এ জন্য আর্থিক খাতের ক্লিনিংয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। এ উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংককেও দায়ী করতে হবে।

আর্থিক খাতে সবচেয়ে বেশি তথ্য লুকানো হচ্ছে অভিযোগ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, দেশের সবচেয়ে বেশি তথ্য লুকানো হয় আর্থিক খাতে। যেখানে সঠিক তথ্য সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ১১ শতাংশ খেলাপি ঋণ দেখাচ্ছে। আসলে বাস্তবে খেলাপি বা মন্দ ঋণ ২৫ শতাংশ। এভাবে আর বেশিদিন চলতে পারবে না।

ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম। প্রবন্ধ উপস্থান করেন ইআরএফের জ্যেষ্ঠ সদস্য ওবাইদুল্লাহ রনি ও সানাউল্লাহ সাকিব।

মূল প্রবন্ধে বক্তারা বলেন, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ধরে রাখতে কঠোর নীতির পরিবর্তে একের পর এক নীতি সহায়তার নামে ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারীদের সহায়তা দেয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে মেয়াদি ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় এবং ৯-৬ এর মতো নীতি গ্রহণ করে অর্থনীতিকে বিপর্যয়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। দেশের মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরস্থিতি এবং ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলার বিষয়টি সবার জানা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার কাজে ব্যর্থ হয়েছে বলে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ বলেছেন। আবার যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ে সবাই এখন অস্বস্তিতে আছে। সর্বশেষ সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত ১৩ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। তারা বলেন, ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ কমে ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮.০৬ বিলিয়ন থেকে এখন ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। তবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নে নেমেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ ডলার সঙ্কট। অথচ অর্থপাচারকারী, মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বক্তারা বলেন, বেনামি ঋণসহ বিভিন্ন কারণে কয়েকটি ব্যাংকের ভঙ্গুর অবস্থার তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। বর্তমানে শরিয়াহভিত্তিক ৫টিসহ ৭টি ব্যাংক বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণ তো দূরে থাক, দীর্ঘদিন ধরে চলতি হিসাবে ঘাটতি নিয়ে চলছে। গত মে পর্যন্ত এসব ব্যাংকের ঘাটতি ছিল প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি হিসাব ঋণাত্মক রেখে কোনো ব্যাংক লেনদেন করতে পারার কথা না।

অথচ ব্যাংকগুলোকে বিশেষ উপায়ে লেনদেন করতে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমনকি নতুন ঋণ বিতরণও অব্যাহত আছে। একই সাথে এসব ব্যাংকের অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে জুন ও ডিসেম্বর শেষে ঘাটতির চেয়ে বেশি জামানতবিহীন বিশেষ ধার দেয়া হচ্ছে। এই প্রবণতা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতির বিপরীতমুখী অবস্থান হিসেবে দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে না পারার বিষয়টি সবার জানা। বর্তমান গভর্নর যোগদানের পরই এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন ১০টি দুর্বল ব্যাংক আলাদাভাবে নিবিড় তদারকি করা হবে। এসব ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক পর্যায়ের একজন করে কর্মকর্তাকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা বেড়ে গত মার্চ শেষে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা হয়েছে। মোট ঋণের যা ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। কাগজে-কলমে এটা দেখানো হলেও প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা বলে বিভিন্ন বক্তব্যে উঠে আসছে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে নানা ছাড় দিয়ে কম দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/849461