১৪ জুলাই ২০২৪, রবিবার, ৩:০১

চুক্তি ও সমঝোতার আড়ালে কী আছে

-ড. মোহাম্মদ আবদুর রব

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে ২১ জুন দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে নয়াদিল্লি পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সফর ছিল ১৫ দিনের কম সময়ের মধ্যে ভারতের রাজধানীতে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সফর। ৯ জুন মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন তিনি। শেখ হাসিনার এ সফরে ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে ঢাকা ও নয়াদিল্লি। এসব সমঝোতা স্মারকের মধ্যে সাতটি নতুন। অন্য তিনটি নবায়ন করা হয়েছে। প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের পর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী সমুদ্র অর্থনীতি ও সামুদ্রিক সহযোগিতা, রেলওয়ে, সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, একাডেমিক সহযোগিতা, মৎস্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারক বিনিময় করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের সাথে বেশ কিছু চুক্তি করেছে। এ সময়ে দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়, ভারতকে সড়কপথে ট্রানজিট দেয়া, চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয়াসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে চুক্তি হয়েছে, যেগুলোর বেশির ভাগ ভারতের স্বার্থের অনুকূলে।

ভারত প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্কের কথা বললেও বাস্তবে বিপরীত চিত্র দেখা গেছে বহু ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, সীমান্তে নিরপরাধ মানুষ হত্যা ইত্যাদির মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের সাথে আধিপত্যমূলক আচরণ করে আসছে। সরকারের পক্ষ থেকে দুই দেশের সম্পর্কে ব্যাপক অগ্রগতির কথা বলা হলেও তিস্তাসহ বেশ কয়েকটি নদীর পানি বণ্টন, বিশাল বাণিজ্য বৈষম্য নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মনে অস্বস্তি আছে।

আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে উদীয়মান ভারত বাংলাদেশের জনগণের আস্থা অর্জনে সফল হচ্ছে না। এটি অনেকটা অনুভূত হয়েছে মোদি সরকারের বিগত সময়ে। মোদির নতুন শাসনামলে বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশের সাথে বর্তমান আচরণ পরিবর্তন করবে নাকি তার আধিপত্যবাদী মনোভাব ধরে রাখবে তা সময় বলে দেবে। ভারতের সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সুসম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও দেশটির সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বেশ কিছু বিষয় ঝুলে রয়েছে।

চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের বিভিন্ন দিক ও সমস্যা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে আলোচনা ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, তার প্রতিপাদ্য ছিল ভবিষ্যতের জন্য ভারত-বাংলাদেশ অভিন্ন রূপকল্প : অভিন্ন সমৃদ্ধির লক্ষ্যে কানেক্টিভিটি, বাণিজ্য ও সহযোগিতা জোরদার করা। কিন্তু পুরো সমঝোতাগুলো বিশ্লেষণ করলে মনে হতে পারে, এ রূপকল্পে ভারতকে লাভবান করার লক্ষ্য সামনে রেখে ঢাকা-দিল্লি সহযোগিতা কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে, ভারত-বাংলাদেশের স্বার্থে দু’পক্ষ মিলে এটি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সমঝোতা স্মারকের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

নেপালের সাথে অমীমাংসিত ট্রানজিট
এ রূপকল্পে ডিজিটাল অংশীদারত্ব ও ইন্দো প্যাসিফিক নীতির মতো অনেক বড় বড় বিষয় এসেছে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের অংশীদার হবে ও তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবে। যেমন- বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের গেদে থেকে হাসিমারা পর্যন্ত দেশটির উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে মালবাহী ট্রেন চলাচল করবে। এর মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সাথে ভারতের যোগাযোগ আরো বাড়বে, আরো শক্তিশালী হবে। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোসহ ভারতের ভেতর দিয়ে নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আনার ব্যাপারে দিল্লির সম্মতি আছে। তবে এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা বা রূপরেখা আসেনি কোনো পক্ষ থেকে। তাই ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানের সাথে ট্রানজিটের বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে গেল।

ভারতের স্বার্থে রেল ট্রানজিট
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্প্রতি ভারত সফরের সময় ভারতের সাথে যে ক’টি বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের ট্রেন চলাচলবিষয়ক সমঝোতা। এ সমঝোতা স্মারক সম্পর্কে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা বলেছেন, রেলওয়ের জন্য সমঝোতা স্মারকটি ছিল দুই দেশের রেলওয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপনসংক্রান্ত। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে ছয়টি আন্তঃসীমান্ত রেলসংযোগ রয়েছে; কিন্তু এ রেলসংযোগ চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশে ট্রানজিট পাওয়া যাবে। রেল ট্রানজিটের অংশ হিসেবে আগামী মাসের কোনো একসময় বাংলাদেশ রেলওয়ের পথ ব্যবহার করে গেদে-দর্শনা থেকে হলদিবাড়ি-চিলাহাটি ক্রসবর্ডার ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট পর্যন্ত একটি পণ্যবাহী ট্রেন পরীক্ষামূলক চালানো হবে। (ট্রান্সক্রিপ্ট অব স্পেশাল ব্রিফিং বাই ফরেন সেক্রেটারি অন স্টেট ভিজিট অব প্রাইম মিনিস্টার অব বাংলাদেশ টু ইন্ডিয়া, ২২ জুন ২০২৪, মিনিস্ট্রি অব এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স, ইন্ডিয়া)

যদিও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের রেল ট্রানজিটকে ‘উভয় দেশ, উভয় সমাজ, উভয় অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে উপকৃত করবে’ বলে দাবি করেছেন; কিন্তু বাংলাদেশ কিভাবে এ ট্রানজিট থেকে উপকৃত হবে তা ব্যাখ্যা করেননি। এতে একমাত্র ভারত কৌশলগতভাবে লাভবান হবে। কারণ তারা চিকেন নেক করিডোর এড়িয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে যেতে পারবে, মালামাল আনা-নেয়া করতে পারবে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যখন মালগাড়ি যাবে তখন এর ভেতরে কী থাকবে না থাকবে, তা ঢাকার জানার অধিকার থাকবে কি না এ বিষয়গুলো স্পষ্ট নয়। তা ছাড়া নানা সঙ্কটে জর্জরিত বাংলাদেশ রেলওয়ে ভারতীয় রেলের ভার কতটা বহন করতে পারবে, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়।

সিঙ্গেল লাইনের রেলপথ হওয়ায় এখনই সক্ষমতা সঙ্কটে ভুগতে থাকা দর্শনা-চিলাহাটি রেলপথে ভারতীয় মালবাহী ট্রেন চলতে দেয়া হলে বিদ্যমান ট্রেনগুলোর শিডিউল বিপর্যয় ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়বে। এ ছাড়া এ রেলপথের বেশির ভাগ অংশ পুরনো। এমনিতে বাংলাদেশের ব্রডগেজ রেলপথের ভারবহনের ক্ষমতা (২২ দশমিক ৫ টন) ভারতের রেলপথের ভার বহনের ক্ষমতার (২২ দশমিক ৮২ টন) চেয়ে কিছুটা কম। দর্শনা-চিলাহাটি রেলপথের বেশির ভাগ অংশ পুরনো হওয়ায় এ ভার বহনের ক্ষমতা আরো কমেছে। এ রকম অবস্থায় ভারতীয় মালবাহী ট্রেন নিয়মিত চলতে শুরু করলে বাংলাদেশের অংশের রেলপথ তার ভার কতটা বহন করতে পারবে, সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। (পুরনো রেলপথ, চলছে সক্ষমতার চেয়ে বেশি ট্রেন, বণিক বার্তা, ২৪ জুন, ২০২৪)

এই রেল ট্রানজিট যে শুধু বাংলাদেশের একটি রেলপথ ব্যবহার করে হবে তা নয়; ১৬ জুন টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক খবর থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৪টি নতুন রুটের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে সংযোগ তৈরি করা হবে, যার দৈর্ঘ্য হবে ৮৬১ কিলোমিটার। টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, ভারতের সামরিক ও বেসামরিক পণ্য পরিবহনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘চিকেন নেক’ রেলপথ নিয়ে ২০১৭ সালে ডোকালাম অঞ্চল ঘিরে ভারত ও চীনের মধ্যকার বিরোধে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল দিল্লি। কারণ চিকেন নেক করিডোর এ বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের কাছে অবস্থিত। এ কারণে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে চিকেন নেক করিডোরের নির্ভরশীলতা কমাতে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বিকল্প রেল নেটওয়ার্ক তৈরি করবে ভারত।

(নিউ রেললাইন্স ফর নর্থ ইস্ট ভায়া বাংলাদেশ টু বাইপাস ‘চিকেনস নেক’, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ১৬ জুন, ২০২৪)
১৪টি নতুন রুটে বাংলাদেশের রেলপথ দিয়ে ভারতীয় ট্রেন চলাচল শুরু হলে অবকাঠামো সঙ্কটে জর্জরিত বাংলাদেশ রেলওয়ের কী অবস্থা হবে, তা সহজে অনুমেয়। এমনকি ভারতের রেল চলাচলের সুবিধায় যদি বাংলাদেশের রেলের অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়, সে জন্য ভারত যদি ঋণও দেয়, সে ক্ষেত্রেও তা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হবে। কারণ ঋণের অর্থ সুদাসলে দেশের জনগণের করের টাকা থেকে পরিশোধ করতে হবে। তার ওপর দেখা যাবে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে যেসব স্থানের রেলপথের অবকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজন, সেসব স্থানের বদলে অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে ভারতের ট্রানজিট সুবিধা মাথায় রেখে। এভাবে বাংলাদেশের জনগণের করের টাকায় ভারতকে রেল ট্রানজিট দিয়ে ঢাকার কী লাভ হবে? এর আগে ভারতকে বাংলাদেশের নৌপথ, স্থলপথ ও বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে কী লাভ হয়েছে? এসব ট্রানজিট ও করিডোর থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখানো হলেও বাস্তবে আগের সড়ক ট্রানজিট ও করিডোর থেকে কী অর্জন হয়েছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া যায় না। কানেক্টিভিটি প্রসঙ্গে অনেকে ইউরোপের উদাহরণ দিয়ে থাকেন। কিন্তু অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামরিক ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর পারস্পরিক শক্তিসামর্থ্যরে মধ্যে যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা রয়েছে, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কি তা রয়েছে? ২০১০ সালে শেখ হাসিনার ঘোষণায় মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দেয়া হলেও ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটানে যাওয়ার ট্রানজিট পায়নি। বিদ্যমান সমস্যার সমাধান না করে সরকার ভারতকে একের পর এক স্থল-নৌ-রেলবন্দর ব্যবহারের সুবিধা দিচ্ছে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতার নামে নিরাপত্তা ঝুঁকি
বাংলাদেশের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াতে ভারত আগ্রহী জানিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরো বাড়াতে প্রতিরক্ষাসামগ্রী উৎপাদন থেকে শুরু করে আধুনিকীকরণে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমরা সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ ও শান্তিপূর্ণ সীমান্তে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে একমত হয়েছি। ভারত মহাসাগরের ক্ষেত্রে দুই দেশের ভিশন এক রকম।’ ইন্দো-প্যাসিফিক ওশান উদ্যোগে যোগদানের জন্য বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে ভারত স্বাগত জানায় বলে তিনি জানান। প্রেস কনফারেন্সে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যে সামরিক নিরাপত্তার বিষয়ে ভারতের বেশ আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। বাইরেও এটি নিয়ে আলোচনা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, চীনকে মাথায় রেখে ভারত নিজের সামরিক চিন্তাভাবনায় বাংলাদেশকে সংযুক্ত করতে চাইছে। ভারত নিজের প্রতিরক্ষায় বাংলাদেশকে তার মতো করে তৈরি করতে আগ্রহী এবং আপাতদৃষ্টে বাংলাদেশও যে তাতে সায় দিয়েছে, এমনটি ভাবলে তা অমূলক হবে না। প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বকে উৎসাহিত করে, দুই দেশ বাংলাদেশী সশস্ত্রবাহিনীর আধুনিকীকরণে প্রতিরক্ষা শিল্প সহযোগিতা খুঁজবে। যৌথ সামরিক মহড়া, প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতার উন্নয়নও করা হবে। অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ হলো প্রতিরক্ষা সম্পর্ক।

বাংলাদেশ অতীতে ভারতের প্রতিরক্ষাসামগ্রী আমদানিকারক দেশের তালিকায় ছিল না। এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল ভারত বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা প্রয়োজন মেটানোর মতো আধুনিক ও মানসম্পন্ন অস্ত্রশস্ত্র উৎপাদন করেনি। কিন্তু তার নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রধান আঞ্চলিক প্রতিযোগী চীনের বাংলাদেশে প্রভাবের একটি বড় অংশজুড়ে ছিল প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্পর্ক। এ সম্পর্ক এক দিকে অর্থনৈতিক বিকাশে সহায়ক হয়, অন্য দিকে প্রতিপক্ষ দেশটির দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা নির্ভরতা তৈরি করে, যার বিশেষ প্রভাব থাকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর। এ বিষয় সামনে রেখে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিশেষ করে বাংলাদেশের সাথে প্রতিরক্ষা ও সামরিক নিরাপত্তা চুক্তি ও সহযোগিতা এবং প্রতিরক্ষাসামগ্রী রফতানির ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে। ইতঃপূর্বে বাংলাদেশের উপকূলে ভারতীয় নজরদারি রাডার স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিম্নমানের কিছু অস্ত্রও কিনেছে। সামরিক নিরাপত্তা সহযোগিতার নামে বাংলাদেশ ভারত থেকে নিম্নমানের সামরিক সরঞ্জাম কিনবে, যা বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা দুর্বল করে দেবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ভারত ও চীনের মধ্যকার আঞ্চলিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পড়বে, যা দীর্ঘমেয়াদে ঢাকার জন্য নেতিবাচক হবে।

অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন অমীমাংসিত
দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ইস্যুর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ‘পানিবণ্টন চুক্তি’। অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল ইস্যু। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের শেষ মুহূর্তে আর এগোয়নি বহুল আলোচিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি। দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে তা ঝুলে আছে। তিস্তা বাংলাদেশ ও ভারতের তিন কোটির বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে জড়িত। এর মধ্যে দুই কোটির বেশি মানুষ বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে তিস্তার অববাহিকায় বসবাস করে। তিস্তার প্লাবনভূমি দুই হাজার ৭৫০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তীর্ণ। লাখো মানুষ কৃষি, খাদ্য উৎপাদন, মাছ ধরা ও গৃহস্থালি দৈনন্দিন পানির চাহিদা ও জীবিকা নির্বাহে তিস্তা নদীর ওপর নির্ভর করে। এ চুক্তির বিষয়ে ভারতের দিক থেকেও অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু এবার ঘোষণায় এ চুক্তি নিয়ে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। নদীর অংশীদার হিসেবে পানির হিস্যা বাংলাদেশের অধিকারের বিষয়। কিন্তু তিস্তার ক্ষেত্রে যখন বিষয়টি থমকে আছে, তখন আরো ৫৩টি নদীর ক্ষেত্রেও সে প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের অধিকার হারানোর আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

২০১১ সালে নদী নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ যে ফ্রেমওয়ার্ক করা হয়েছিল, সেখানে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা নদীর অববাহিকাভিত্তিক সমাধানে নজর দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এবার ভারত সরকার যা বলেছে, তা স্পষ্ট নয়। দিল্লি বলেছে, যৌথ নদী কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে তথ্য আদান-প্রদান ও অন্তর্বর্তীকালীন পানিবণ্টনের রূপরেখা প্রণয়নকে অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাবে। এটি দিয়ে বোঝা যাচ্ছে না, তিস্তার বিষয়টি কোন অবস্থায় আছে। ফলে তিস্তার বিষয়ে একধরনের অস্বচ্ছতা থেকে গেল। একমাত্র গঙ্গা চুক্তি ছাড়া আরো যে ৫৩টি যৌথ নদী আছে, সেগুলোর কোনোটি নিয়ে বাংলাদেশ চুক্তি করতে পারেনি। এ দিকে ২০২৬ সালে গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির মেয়াদও শেষ হবে। ফলে এ চুক্তি নবায়ন করতে হবে ২০২৬ সালের আগে।
বাংলাদেশে ভারতের যে টেকনিক্যাল টিম পাঠানোর কথা বলা হচ্ছে, তারা বাংলাদেশের অংশে কাজ করবে। তিস্তা অববাহিকা নিয়ে বাংলাদেশের আগের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে গিয়ে ভারতের একক স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বৈঠকের যৌথ ঘোষণায় কোনো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।

সীমান্ত হত্যা বন্ধে ধোঁয়াশা
দুই দেশের সম্পর্কের আরেকটি অস্বস্তির দিক সীমান্ত হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’-এর হিসাব অনুযায়ী, শুধু ২০২৩ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে মারা গেছেন ৩০ বাংলাদেশী নাগরিক। ২০২২ সালে সীমান্তে নিহতের সংখ্যা ছিল ২৩ জন। এর মধ্যে ১৬ জন মারা গিয়েছিলেন বিএসএফের গুলিতে। ২০২১ সালে সংখ্যাটি ছিল ১৭। সীমান্তে প্রাণহানি বন্ধ করার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের এপ্রিলে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয় দুই দেশের মধ্যে। সেখানে সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনাগুলোতে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার না করতে সহমতও হয়। কিন্তু তার পরও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড থামেনি। এমনকি ঈদের দিন বিএসএফ নিরস্ত্র বাংলাদেশীকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেছে। প্রধানমন্ত্রী পর্যায় থেকে শুরু করে ভারতের পক্ষ থেকে অঙ্গীকার ছিল সীমান্ত হত্যা বন্ধের। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে বৈঠকে সীমান্ত হত্যা নিয়ে কোনো ঘোষণা আসেনি, এমনকি বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। মোটা দাগে বাংলাদেশের সমস্যাগুলো সমাধানে ভারতের দিক থেকে যে উদ্যোগের প্রয়োজন, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না তার কোনো উল্লেখ নেই। আর আলোচনা হলেও ঘোষণাপত্রে প্রতিফলন নেই। সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের দিক৬ থেকে স্পষ্ট ঘোষণা, কার্যক্রম ও রূপরেখা উল্লেখ না থাকায় সীমান্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভারত ঠিক কী চাচ্ছে তা ধোঁয়াশাপূর্ণ।

বঙ্গোপসাগরে ভারতের অবাধ প্রবেশের সুযোগ
সমুদ্র সহযোগিতার অন্তর্গত সুনীল অর্থনীতি বা ‘ব্লু ইকোনমির’ নামে বাংলাদেশের জলসীমায় ভারত অবাধ বিচরণ করার সুযোগ পাবে। গভীর সমুদ্র এলাকা থেকে তেল ও গ্যাস আহরণে উপযুক্ত কৌশল বাংলাদেশ এখনো গ্রহণ করেনি। ভারতে সাথে এ সহযোগিতা স্মারকে ভারত বাংলাদেশের জলসীমায় বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে, সমুদ্র সম্পদ জরিপ করতে পারবে। যেগুলো যেকোনো রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর বিষয়। ভারতকে সমুদ্র সহযোগিতার নামে দেশের সমুদ্র সম্পদের স্পর্শকাতর তথ্য ভারতের হাতে তুলে দেবে সরকার। অথচ ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ ইতোমধ্যে ভারতের সাথে থাকা সমুদ্র জলবিষয়ক চুক্তি বাতিল করেছে।

রেল ট্রানজিট বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব
শক্তি-সামর্থ্যে ভারত তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে বৃহৎ হওয়ায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো এমনিতে নিরাপত্তা শঙ্কায় ভোগে। ভারতের থেকে বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট। আওয়ামী শাসনামলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অনেকটা একতরফাভাবে চলছে। যদিও ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে একটি আদর্শ পরিবেশ বিরাজ করছে। ভারতের যা কিছু চাওয়ার ছিল, বাংলাদেশ প্রায় সব কিছু পূরণ করেছে প্রায় বিনিময় ছাড়া। উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাদের কোনো কোনো নেতাকে ভারতের কাছে সমর্পণ করা হয়। এখন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রেনযোগে ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য ও সরঞ্জাম পরিবহনের যে সুযোগ পাচ্ছে সেটি বিশেষ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

ভূ-কৌশলগত প্রভাব : বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সেভেন সিস্টার্সে ভারত সামরিক সরঞ্জাম পরিবহন করে স্বাধীনতাকামীদের দমন করতে চাইলে সেখানকার স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে বাংলাদেশে হামলা করতে পারে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ঘিরে ভারতের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ঢাকা নিশ্চিতভাবে চীন-ভারতের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে আরো বেশি করে জড়িয়ে পড়বে। উত্তর-পূর্ব ভারত সীমান্তে চীনের সাথে সামরিক সঙ্ঘাতে বাংলাদেশের রেল ট্রানজিট ব্যবহার করে যদি ভারতীয় সামরিক সরঞ্জাম পরিবহন করা হয়, তখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এমনকি সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পড়বে। আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আগে সড়ক, নৌ ও বর্তমানে রেল ট্রানজিট দিলেও ভারত শিলিগুঁড়ি করিডোর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ২২ কিলোমিটার দূরত্বের নেপালের সাথে, ৩৫ কিলোমিটার ভুটানের সাথে এবং ১০০ কিলোমিটার দূরত্বের চীনের সাথে বাংলাদেশকে ট্রানজিট দিচ্ছে না কৌশলগত নিরাপত্তার অজুহাতে।

অর্থনৈতিক প্রভাব : বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতীয় রেলগাড়ির মাধ্যমে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে মালামাল ও পণ্য পরিবহনে ভারত অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। কেননা বাংলাদেশের রেল ট্রানজিট দিয়ে পণ্য পরিবহন না করে ভারত যদি শিলিগুঁড়ি করিডোর হয়ে পণ্য পরিবহন করে তাহলে ভারতের পরিবহন ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য রফতানি করে লাভবান হওয়া থেকে বঞ্চিত হবে।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/849325