১৩ জুলাই ২০২৪, শনিবার, ১২:২৫

কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাজধানীতে ভয়াবহ পানিবদ্ধতা ॥ তলিয়েছে দেশের বহু এলাকা

শুক্রবার ভোর ছয়টা থেকে অন্তত দুই ঘণ্টার তুমুল বৃষ্টিতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এদিন সকালে মানুষের কর্মব্যস্ততা না থাকায় রাস্তায় যানজটের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন কাজে যারা ঘর থেকে বের হয়েছিলেন তারা সীমাহীন ভোগান্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন। আবহাওয়া অফিস বলছে, এই তুমুল বৃষ্টিপাত ভারতের কলকাতা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ঢাকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় হয়েছে। আবহাওয়া অফিস বলছে শুক্রবার বাংলাদেশের মোট আটটি আবহাওয়া স্টেশনে ভারী এবং আটটি স্টেশনে অতিভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবহাওয়া অফিস বলছে, সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে ঢাকায়। যা এই বর্ষা মৌসুমে সর্বোচ্চ। এর আগে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ২৭ মে ২২৪ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড হয়। ঢাকার বাইরে শুক্রবার সকাল নয়টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে কক্সবাজারে, ৩০৯ মিলিমিটার এবং তারপরই রয়েছে সন্দ্বীপ। এই সময়ে সন্দ্বীপে ২১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যখন ২৪ ঘণ্টায় ৮৮ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়, তখন সেটিকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত বলে। রাজধানীতে টানা বৃষ্টি পাতে ডুবে যায় অন্তত ২৭টি এলাকার রাস্তাঘাট। অলি-গলি সবখানে পানি। তবে পানি নেমে গেলেও নগরবাসীদের ভোগান্তি ছিল চরমে।

অতিভারী বৃষ্টিপাত হওয়া এলাকাগুলোর মাঝে আছে টাঙ্গাইল, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী, কক্সবাজার, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া এবং কুষ্টিয়া (কুমারখালী)। সকাল থেকে টানা বর্ষণে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার সড়কে পানিবদ্ধতা তৈরি হয়েছে এবং ঢাকার অব্যবস্থাপনার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও শেয়ার করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। শামীমা সুলতানা নামে একজন ঢাকার পূর্ব রাজাবাজার এলাকা প্লাবিত হয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও শেয়ার করে ক্যাপশনে লিখেছেন, "উন্নয়নের জোয়ারে, জলে ডোবা শহরে, ময়লা ফেলি আহারে যেথা ইচ্ছে সেথারে। আরও অনেক ফেইসবুক ব্যবহারকারী ঢাকার এই পানিবন্দী অবস্থার জন্য অনুন্নত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলাকে দায়ী করেছেন। অনেকেই বলেছেন, মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে আগারগাঁও, পুরোটা জ্যাম দেখেছেন। আর, ধানমন্ডি ২৭-এ কোমর সমান পানি পেয়েছেন। আর জায়গায় জায়গায় গাড়ি বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন্নেসা বলেন শুক্রবার সকাল ৬টার পর থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। প্রথম ৩ ঘণ্টায় সকাল ৯টা পর্যন্ত ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এরপর বৃষ্টি আরও ভারী হয়ে পরবর্তী ৩ ঘণ্টায় অর্থাৎ সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। দুপুর ১২টার পরও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল, তবে তা সামান্য। ছয় ঘণ্টায় ঢাকায় রেকর্ড ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি। তিনি আরও বলেন, আজ শনিবারও রাজধানীতে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। তবে দিনভর বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। রোববার থেকে আবার বৃষ্টির প্রবণতা কিছুটা কমতে পারে।

গতকাল শুক্রবার দুপুরের দিকে মনোয়ার হোসেন নামের আরেকজন ফকিরাপুল থেকে কাকরাইল যাওয়ার পথের একটি ভিডিও শেয়ার করে বলেছেন, সড়কে কোমর ময়লা পানি। মানুষ সেই পানিতে ভিজে ভিজেই নিজ নিজ গন্তব্যে যাচ্ছে। কেউ কেউ ময়লা পানি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। পানি রিকশার দুই চাকার উপরে উঠে গেছে। তিনি তার ওই পোস্টের ক্যাপশনে কটাক্ষ করে লিখেছেন, ঢাকায় আবিষ্কৃত নতুন খাল।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ঢাকাবাসীর এই ভোগান্তি সহসা কমছে না। কারণ আগামী ২৪ ঘণ্টা ঢাকাসহ সারাদেশে এমন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। এক্ষেত্রে এটি একটানা না হয়ে থেমে থেমে মাঝারি থেকে অতভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। শুক্রবার ভোর ছয়টা থেকে সকাল নয়টা, তিন ঘণ্টায় ঢাকায় ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।

হঠাৎ এত বৃষ্টিপাতেই ঢাকার কারওয়ান বাজার, বনশ্রী, বাড্ডা, হাতিরঝিল, ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, মহাখালী, বিজয় সরণী, মিরপুর ইত্যাদি এলাকার অনেক স্থান রীতিমত পানিতে প্লাবিত হয়ে যায়।

বেড়ে গেল ভাড়া : কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকার বিভিন্ন স্থান প্লাবিত হওয়ার প্রভাব পড়েছে গাড়ি ভাড়ায়। যারা শুক্রবার দিন বিভিন্ন কাজের জন্য ঘর থেকে বের হয়েছিলেন, বৃষ্টি এবং যানবাহনের সংখ্যা কম থাকায় এদিন তাদেরকে রিকশা, সিএনজি, এমনকি রাইড শেয়ারিং অ্যাপেও কয়েক গুণ বেশি ভাড়া গুণতে হয়েছে।

বরকতউল্লাহ সুজন নিউমার্কেট এলাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করেন। সকালে বের হয়েছিলেন অফিস যাওয়ার জন্য। অন্য দিনগুলোতে মগবাজার থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত দেড়শ টাকা সিএনজি ভাড়ায় যাতায়াত করেন। তবে টানা বৃষ্টির কারণে তাকে অতিরিক্ত ৫০ টাকা ভাড়া গুণতে হয়েছে। সুজন বলছিলেন, দেড়শ টাকার ভাড়া সিএনজি চালকরা ৩৫০ টাকা চাচ্ছেন। শেষে ২০০ টাকায় আসতে পেরেছি, তাও প্রায় আধাঘণ্টা অপেক্ষার পর। কোনোভাবে সিএনজি পাওয়া যাচ্ছিল না। ধানমন্ডি থেকে বসুন্ধরা এলাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে সকালে রওনা হয়েছিলেন আসাদুল্লাহ। তিনি বলছিলেন, অন্য সময় আড়াইশ টাকায় যাতায়াত করতে পারতাম। সেই ভাড়া সাড়ে তিনশ টাকা গুণতে হয়েছে পানিবদ্ধতার কারণে। অন্যদিকে, মগবাজার থেকে বারিধারা পর্যন্ত সিএনজি ভাড়া গুণতে হয়েছে ২০০ টাকা, যা আগে ১৫০ টাকায় যাওয়া যেত বলছিলেন সেই এলাকার বাসিন্দা হারুন অর রশিদ। রাজধানীতে অতি বৃষ্টিপাতের কারণে বেশিরভাগ রাস্তায় গাড়ি ছিল না। ফলে শেষ ভরসা ছিল সিএনজি ও রিকশা। কিন্তু রিকশা পেতে অনেককেই ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনেক এলাকায় আবার রিকশাও ছিল না। আবার দুই একটা পাওয়া গেলেও তারা যেতে চায় না গন্তব্যস্থলে। রাজধানীর ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, বায়তুল মোকাররম, শান্তিনগর, মালিবাগ মোড়, আরামবাগ, প্রগতি সরণি, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি রাপা প্লাজা, বংশাল, মিরপুর রোকেয়া সরণি, দয়াগঞ্জ মোড়, সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল, নিমতলী, টয়েনবি সার্কেল রোড, ধানমন্ডি ২৭, এলিফ্যান্ট রোড, মৎস্য ভবন, কাওরান বাজার, বিজয় সরণি, ঢাকা গেট ভিআইপি রোড, মিরপুর মাজার রোডে ভোগান্তি ছিল চরমে। তবে ঢাকার বাইরে থেকে নিবন্ধন পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থীরা বেশ বিপাকে পড়েন। সকালে তাদের পরীক্ষা থাকায় অনেকে সময় নিয়ে বের হলেও রাস্তায় বের হয়ে পড়েন মহাবিপাকে। স্বল্প পথে রিকশাভাড়াও দ্বিগুণ গুণতে হয়েছে। তবে কোমর সমান পানি মাড়িয়ে এই শিক্ষার্থীরা অনেক কেন্দ্রে পরীক্ষায় অংশ নিতে গেছেন।

সকাল থেকে টানা কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিপাতে ডুবে যায় রাজধানীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানঘেরা এলাকা নিউমার্কেট। নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় থেকে শুরু করে নীলক্ষেত পর্যন্ত সড়কে জমে আছে বৃষ্টির পানি। আর এমন অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন রাস্তার পার্শ্ববর্তী অপেক্ষাকৃত নিচু ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। বৃষ্টির সময় উপচে সড়কের সব পানি প্রবেশ করেছে মার্কেটের ভেতর। ফলে দোকানে রাখা শাড়ি, কাপড়, বই, জুয়েলারিসহ অন্যান্য সবকিছুই ভিজে গেছে। এমন অবস্থায় সব মিলিয়ে প্রায় কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। এদিন একান্তই প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাসা থেকেও বের হননি। আরিফ হাওলাদার নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, হঠাৎ এত বৃষ্টি হবে বুঝতে পারিনি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি এই অবস্থা। দ্রুত দোকানে এসে কিছু জিনিস সরাতে পেরেছি। আর অধিকাংশই পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। শাকিল নামের এক দোকান কর্মচারী বলেন, দোকানের নিচে যত কাপড় রাখা ছিলো বেশিরভাগই ভিজে গেছে। সব কাপড় বাসার ছাদে নিয়ে শুকাতে হবে। পানি এখনো কমেনি। কমার পর দোকান খুললে ভেতরের ক্ষয়ক্ষতি আরও বোঝা যাবে।

নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেন, সবগুলো দোকানের ভেতরেই এখন এক ফিট পরিমাণ পানি। বইপত্র, কাপড়, তৈজসপত্র, জুয়েলারি সবকিছুই পানিতে ভিজে গেছে। আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল।
খুলনায় বসতঘরে পানি : ভারী বর্ষণে তলিয়ে গেছে খুলনা মহানগরীর রাস্তা-ঘাট ও বসতঘর। শুক্রবার সকালের বৃষ্টিতে শহরের বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এরপর থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। সকালে ভারী বর্ষণে দুর্ভোগে পড়েছেন নি¤œবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষ। নগরবাসীর অভিযোগ, কিছুটা ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে যাচ্ছে নগরীর নি¤œাঞ্চল। প্রধান সড়কগুলোয় তৈরি হচ্ছে জলজট।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, মৌসুমী বায়ুর কারণে বৃষ্টি হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় খুলনা শহরে ৯৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। যারমধ্যে শুক্রবার সকাল থেকে বেলা ১২ টা পর্যন্ত ৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আজ সারাদিন বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন থেমে থেমে হলেও বিকালের পর ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। বৃষ্টিতে খুলনা নগরীর খালিশপুর মুজগুন্নী, বাস্তুহারা কলোনী, হাউজিং এলাকা, ফুলবাড়ী গেট, রেলিগেট, মহেশ্বরপাশা, দৌলতপুর, নতুন রাস্তার মোড়, আলমনগর, নেভি চেকপোস্ট, রায়েরমহল, বয়রা বাজার, গল্লামারি, ময়লাপোতা, রয়েল মোড়, টুটপাড়া জোড়া কল বাজার, মহির বাড়ির খালপাড়, রূপসা ঘাট, নতুন বাজারসহ আরও কিছু এলাকা বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজার শহরসহ জেলার ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভোরে কক্সবাজার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সিকদার বাজার এবিসি ঘোনা এবং সদর উপজেলার বিসিক শিল্প এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের বরাতে রকিবুজ্জামান বলেন, বুধবার মধ্যরাত থেকে কক্সবাজার শহরে টানা মাঝারি ও ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে।

https://www.dailysangram.info/post/561161